Tuesday 9 August 2011

নতুন কায়দায় ক্রসফায়ার : আটকের পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে নির্জন স্থানে

নাছির উদ্দিন শোয়েব
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে এখন নতুন কৌশলে দেশে ক্রসফায়ার করা হচ্ছে। কিছুদিন ধরে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্প শোনা যায় না। ক্রসফায়ার সংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো প্রেস বিজ্ঞপ্তিও মিডিয়ায় পাঠানো হচ্ছে না। ক্রসফায়ারের দুর্নাম ঘোচাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ভিন্ন কৌশল নিয়েছে।
তবে ক্রসফায়ার ঠিকই চলছে। আটক করে নেয়ার পর পাওয়া যাচ্ছে লাশ। এক এলাকা থেকে আটক করে অন্য কোনো এলাকায় নিয়ে ক্রসফায়ার করা হয়। সম্প্রতি গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জে ছয় যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। লাশ শনাক্তের পর স্বজনদের অভিযোগে প্রমাণিত হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই যুবকদের আটক করে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সম্প্রতি উদ্ধার করা কয়েক যুুবকের লাশের পরিচয় পাওয়ার পর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আটক করে নেয়ার পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে দূর-দূরান্তে প্রিয়জনের লাশ পাওয়া গেছে। তারা আরও বলেন, নতুন কৌশলে এদেরকে ক্রসফায়ার করা হয়েছে।
গত শুক্রবার গাজীপুরে পুবাইলের নারায়ণপুর বাইপাস সড়ক এলাকার নাগদা ব্রিজের নিচ থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অজ্ঞাত পরিচয় দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের মাথা ও গলায় গুলির একাধিক চিহ্ন রয়েছে। একই দিন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলীতে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশ থেকে উদ্ধার হয় অপর এক যুবকের লাশ। এর আগে গত ১২ জুলাই গাজীপুরে দু’জন এবং ১৩ জুলাই অজ্ঞাত পরিচয় একজন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। গত শুক্রবার দুই যুবকের লাশ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বজনরা জানান, নিহত যুবকদ্বয় হচ্ছে মিজানুর হোসেন (২৫) ও জুয়েল সরদার (২০)। তারা দু’জন বন্ধু। মিজানের বাসা রাজধানীর ৩৬-বি/৩, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এবং জুয়েলের বাসা ৩১/১, দয়াগঞ্জ সরদারবাড়ি এলাকায়। গত রোববার গাজীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে স্বজনরা লাশ দুটি শনাক্ত করেন। সিরাজদিখান থেকে উদ্ধার হওয়া গুলিবিদ্ধ লাশটি দয়াগঞ্জের রাজীবের (৩৫)। তিনি নিহত জুয়েলের চাচাতো ভাই। স্বজনদের অভিযোগ, এই তিনজনকে একই সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশ মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর দু’জনের লাশ গাজীপুরে এবং একজনের লাশ সিরাজদিখান এলাকায় পাওয়া যায়।
জানা যায়, গত ৩১ জুলাই সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর দয়াগঞ্জ বাজার মোড় থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিজান, জুয়েল, রাজীব ও রাজনকে স্থানীয় লোকজনের সামনেই আটক করার পর পিটিয়ে আহত করে। এরপর তাদের হাতকড়া পরিয়ে একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এসময় রাজন পালিয়ে যায়। মিজানের বড়ভাই মনির বলেন, ছোটভাইকে আটকের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা গেন্ডারিয়া থানায় যায়। কিন্তু থানা পুলিশ মিজানের কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। পর দিন তিনি গেন্ডারিয়া থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ তা নিতে চায়নি। থানা থেকে বলা হয়, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আটক করেছে। এরপর তিনি র্যাব, গোয়েন্দা দফতর ও ডিএমপির কয়েকটি থানা এবং হাসপাতালের মর্গে গিয়ে খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও সন্ধান পাওয়া যায়নি। এরপর গাজীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে গিয়ে মিজানের লাশ শনাক্ত করি।
মনির বলেন, তারা দুই ভাই। উত্তর যাত্রাবাড়ীতে পারিবারিক ওয়ার্কশপ আছে তাদের। তারা দুই ভাই মিলে ওই ওয়ার্কশপ চালাতেন। মনির বলেন, কয়েক বছর আগে দয়াগঞ্জে মোহন নামের একজন খুন হয়। সেই হত্যা মামলায় ছোট ভাই মিজানকে উদ্দেশ্যমূলক আসামি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমার ভাইকে বেআইনিভাবে মেরে ফেলেছে। আমার ভাইয়ের কোনো অপরাধ ছিল না। নিহত জুয়েলের এক আত্মীয় বলেন, জুয়েল ফ্রিজ মেরামতের কাজ করতো। গত ৩১ জুলাই সকালে চাচাতো ভাই রাজীবের সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে কাছেই বাজারে যাওয়া মাত্র অস্ত্রধারী ৭/৮ জন লোক তাদের মারধর করে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। পরে সিরাজদিখান সদর হাসপাতালের মর্গে রাজীব এবং গাজীপুরে জুয়েলের লাশ পাওয়া যায়।
নিহতদের স্বজনের দাবি—কেন এই নিরপরাধ যুুবকদের হত্যা করা হলো? তাদের কী অপরাধ? তাদের নামে কোনো অভিযোগ নেই। নিহতদের আত্মীয়স্বজন আরও বলেন, যারা ওদের আটক করে গুলি করে হত্যা করল তারা আইন প্রয়োগকারী কোন সংস্থার লোক তাও জানা যায়নি। থানা পুলিশ বলছে, গোয়েন্দা পুলিশের কথা। অন্যদিকে গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। র্যাব থেকেও আটকের কথা স্বীকার করা হয়নি। ওরা যদি সত্যিই অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে আটক ও হত্যার ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লুকোচুরি কেন?
দেশে ক্রসফায়ার নিয়ে আলোচিত ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত গড়িয়েছে। চলতি বছর মে-তে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও র্যাব নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। র্যাবকে খুনিবাহিনী আখ্যা দিয়ে এটাকে ভেঙে দেয়ার দাবি জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এ দাবি জানিয়ে বলেন, বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে র্যাব ভেঙে দিতে হবে। র্যাবের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। র্যাব এখন অপরাধ সংঘটনে ভাড়া খাটছে। তিনি বলেন, র্যাবের পদস্থ কর্মকর্তারা সরকারকে কোনো পাত্তাই দেয় না।
এছাড়াও গত বছরের মাঝামাঝি ক্রসফায়ার নিয়ে উদ্বেগ ছড়ালে মানবাধিকার সংগঠন ছাড়াও বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। গত বছরের ১৭ নভেম্বর ক্রসফায়ারের একটি ঘটনা নিয়ে সুয়োমোটো রুল জারি করেন বিচারপতি আবদুর রহমান ও বিচারপতি ইমদাদুল হক সমন্বয় গঠিত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। আদালত স্বণোদিত হয়ে মাদারীপুরের লুত্ফর খালাসি ও খায়রুল খালাসি নামে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যার ঘটনাটি কেন বিচারবহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সরকার ও র্যাবের কাছে জানতে চেয়ে ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেন। দুই সহোদরকে র্যাব আটক করার পর তাদের হেফাজতে হত্যা করা হতে পারে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশের ৩৬ ঘণ্টা পর তাদের মৃত্যুর খবর জানা যায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের মহাসচিব সাইফুল ইসলাম দিলদার বলেন, আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের শতকরা ৬৫ ভাগই ভালো মানুষ। সমাজের একটি কুচক্রি মহল হীনউদ্দেশ্য হাসিল করতে তাদের ক্রসফায়ারের শিকার বানায়। এতে প্রকৃত অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গত ৬ মাসে গড়ে প্রতি ৪ দিনে একজন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৩৭ জনই ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। এর মধ্যে র্যাব ২৪ জনকে, পুলিশ ৮ জনকে, র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে ৩ জন এবং র্যাব ও কোস্টগার্ডের যৌথ অপারেশনে ২ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। নিহত ৪৯ জনের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগ কর্মী, ৩ জন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) সদস্য, ২ জন পূর্ব বাংলার কমিউনিউস্ট পার্টির সদস্য, ৪ জন গণবাহিনীর সদস্য, ২ জন যুবক, একজন ৫২ বছর বয়সী ব্যক্তি, একজন ঢাকার নর্দার্ন কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র, একজন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, একজন ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, একজন ওষুধ ব্যবসায়ী, একজন কাপড়ের দোকান কর্মচারী, একজন পশু ডাক্তার, একজন শ্রমিক, একজন কয়েদি, ২ জন হাজতি এবং ২৬ জন কথিত অপরাধী বলে জানা গেছে।

No comments:

Post a Comment