Friday 1 June 2012

Friday, 25 May, 2012 2:38:52 PM মানবতাবিরোধী অপরাধ: সাক্ষী নিয়ে পাল্টাপাল্টি বিতর্ক ফজলুল হক নিজস্ব প্রতিবেদক বার্তা২৪ ডটনেট http://www.barta24.net/?view=details&data=Cook&web=0&menu_id=64&news_id=47280#.T8DF6m1R5Ls.facebook
ঢাকা, ২৫মে: মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য যে সব সাক্ষী আনার কথা ছিল, তাদেরকে আনতে না পারায় প্রসিকিউটদের নিয়ে নানা যুক্তি-তর্ক সৃষ্টি হয়েছে বিশেজ্ঞদের মাঝে। বিশেষ করে জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশন। তবে নিজেদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা ঢাকতে তারা বিভিন্ন সময়ে নিচ্ছেন নানা কৌশল। আইন বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলক আ স ম রব, মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, ওয়ার ক্রাইমস্ ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটির আহবায়ক ডা. এম এ হাসান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রধান শাহরিয়ার কবির প্রসিকিউশনের দক্ষতা ও সামর্থ্য নিয়ে যেসব প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেগুলো বাস্তব হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। সাঈদীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৬৮জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৮ জনের পর আর বাকি সাক্ষীদের হাজির করতে না পেরে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে আদালতে আবেদন এবং তা মঞ্জুর হওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে বলে তারা মনে করছেন। প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন, এই বিচারকে বিতর্কিত করতেই এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মতে, প্রসিকিউশন ও ট্রাইব্যুনালের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে জনগণের বহুল প্রত্যাশিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেমন বিতর্কিত হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলেও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আইনজীবীরাও বলেছেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী না আনতে পারলে প্রসিকিউশনের উচিত ছিল আদালতকে তা সাফ জানিয়ে দেয়া। কিন্তু সাক্ষী না এনে তদমত্ম কর্মকর্তার কাছে দেয়া বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে দেখানোর কারণে আসামীদের পক্ষেথেকে ও বিচার হোক যারা না চায় তাদের মতো বিরোধী শক্তি বিতর্কের সুযোগ পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। ‘সাঈদীর সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আমরা ন্যায়বিচার করবো না’ বলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দেয়া বক্তব্য নিয়েও ট্রাইব্যুনালে বাইরে এসে ডিফেন্সের পক্ষে থেকে ধূম্রজাল তৈরি করা হয়েছে। এই সব নিয়েও বিশিষ্টজনদের পক্ষ থেকে নানা মন্তব্য ও সমালোচনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বিরোধীদের পক্ষ থেকে। এছাড়া, প্রসিকিউশন প্রখ্যাত কলাম লেখক ও বিশিষ্ট জাদুশিল্পীর সাক্ষ্যর বিষয়ে বেঠিক পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন বলে তারা বলেন। বিশিষ্ট কলাম লেখক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির সাঈদীর মামলার সাক্ষী না হলেও প্রসিকিউশন তাকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করলে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে পারবেন না বলেও তাদের আবেদনে ট্রাইব্যুনালকে জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, “আমি কখনোই সাঈদীর মামলার সাক্ষী ছিলাম না, কিন্তু এ বিষয়ে প্রসিকিউটররা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একই ঘটনা ঘটেছে প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ ও অধ্যাপক জাফর ইকবালের ক্ষেত্রেও। কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা ছাড়াই প্রসিকিউশন তাদেরকে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর তালিকায় উপস্থাপন করে অনুপস্থিত দেখিয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রসিকিউশন সাঈদীর মামলায় অধ্যাপক জাফর ইকবালকে সাক্ষী করার জন্য বেশ কয়েক ধর্না দিলেও তিনি সাফ ‘না’ করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে জাফর ইকবাল বলেছেন, “আমি চাই আমার বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হোক, কিন্তু এ ঘটনায় সাঈদী জড়িত কিনা, তা না জেনে আমি কিভাবে সাক্ষ্য দেবো।” মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সহায়ক মঞ্চের অন্যতম উপদেষ্টা বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, “সাক্ষী আনতে অবশ্যই তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরদের আন্তরিক থাকা উচিত, পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্যকে সাক্ষ হিসেবে গ্রহণ করা আইনীভাবে যথার্থ নয়।” ‘আমরা বিচার করবো না’ - ট্রাইব্যুনালের এমন মন্তব্যকেও সৈয়দ আমিরুল ইসলাম অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেছেন, “পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে নেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন, মধ্যযুগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।” আর, ‘আমরা সুবিচার করবো না’ বলে মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষতা হারিয়েছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী। জয়নাল আবেদীন বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে সাক্ষীর নামে সরকারের মনগড়া কথাই লিখে দিয়েছেন। এখন সাক্ষী না পেয়ে এগুলোকেই সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করে একটি প্রহসনের বিচারের আয়োজন চলছে।” এ ধরনের তৎপরতা আইনের শাসনের জন্য শুভ নয় বলে মন্তব্য জয়ানাল আবেদীনের। কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বলেন, “আমরা বিচার করবো না- এ ধরনের বক্তব্য কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” তিনি বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে বলে এই বিচারের কর্তাব্যক্তিরাই এ ধরনের মন্তব্য করছেন।” তিনি আরো বলেন, “ভোটের রাজনীতিতে সুফল পেতেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে।” এ বিচারে সরকারের আন্তরিকতা নেই বলেও মন্তব্য করেছেন কাদের সিদ্দিকী। তার মতে, “সাক্ষীকে আদালতে না এনে পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্য জবানবন্দি হিসেবে নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম ঘটলো। এর ফলে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে বিতর্কের অস্ত্র তুলে দেয়া হলো।” ইতোমধ্যে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকেও কঠোর ভাষায় ১৫ জনের বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটির তিন সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এমকে আনোয়ার সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের এসব আচরণকে জংলী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “পুলিশ কার কাছ থেকে কি বক্তব্য নিলো, সেটি যাচাই বাছাই বা জেরার সুযোগ না দিয়ে সরাসরি জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করার নজির পৃথিবীর ইতিহাসের কোথাও নেই।” এ ধরনের বিচার মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, “আমরা বিচার করবো না, ট্রাইব্যুনালের এ ধরনের উক্তি হলো বর্বর উক্তি।” তিনি বলেন, “এর ফলে স্পষ্ট হয়ে গেছে, তারা ন্যায়বিচার করবেন না।” জানা গেছে, মাওলানা সাঈদীর সাক্ষ্য আনা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রসিকিউটররা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সাক্ষী না আনতে পারার পেছনে পাঁচটি কারণ তারা চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে বড় একটি কারণ হলো, তদন্ত কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা। কারণ ৪১ বছর আগের ঘটনাগুলোর সাথে তারা গ্রেফতারকৃত রাজনৈতিক নেতাদের কোনো সম্পৃক্ততা যথার্থভাবে দেখাতে পারছেন না। এজন্য, সংশ্লিষ্ট সাক্ষীও তারা আনতে পারছেন না। সূত্রটি আরো জানিয়েছে, সাঈদীর সাক্ষী আনতে না পারার অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে বেশ কিছু কৌশল তারা হাতে নিয়েছেন। তবে ডিফেন্স টিমের দাবি হচ্ছে, সাঈদীর মামলার মতো অন্য অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্যকেই তারা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন। আর সাঈদীর মাধ্যমেই তা জায়েজ করে পরবর্তীদের জন্যও একই আবেদন করার মাধ্যমে প্রসিকিউটররা আরো বেশি সমালোচনায় পড়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি ও জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযম, বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রস্তুতি চলছে বলে আসামিপক্ষের দাবি। এক্ষেত্রে বিশেষ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মতিউর রহমান নিজামীর নিজামীর নির্বাচনী এলাকায় সাক্ষীদেরকে হুমকি দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটররা। তবে যাদেরকে প্রাথমিকভাবে সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করার চিন্তা করেছিল প্রসিকিউশন, তারাও কোনো ধরনের সহযোগিতা করছে না বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রের দাবি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম নেতা শাহরিয়ার কবির বার্তা২৪ ডটনেটের সঙ্গে আলাপ কালে প্রসিকিউশনের এসব তৎপরতায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, “আমি পরিষ্কার করে প্রসিকিউশন ও তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি যে একজনের বিষয়ে সাক্ষী দেব ট্রাইব্যুনালে এবং সেটি আপনাকেও বলেছি।” এ সময় তিনি বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক প্রত্যেকের এলাকাতেই অনেক সাক্ষী পাওয়া যাবে। তারা তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে সাক্ষী হিসেবে অনেককেই আনবেন বলে আমার ধারণা। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রকৃত ভিকটিম রয়েছেন।” এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে আটক জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫ সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার আদেশর পর ডিফেন্সের রিভিয়ু আবেদন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ও আসামি পক্ষ পাল্টা-পাল্টি যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেছেন। বার্তা২৪ ডটনেট/এফএইচ/জিসা