Wednesday 23 February 2011

শেয়ারবাজারে ধসের পর ধস : ৫ মিনিটে ৬শ’ পয়েন্ট পতন : অনির্দিষ্টকালের জন্য লেনদেন বন্ধ : অর্থমন্ত্রী চুপ


বিশেষ প্রতিনিধি

শেয়ারবাজারে ধসের পর ধস চলছে। টানা ৬ কার্যদিবসে অস্বাভাবিক দরপতনে শেয়ারবাজার এখন অনেকটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গতকাল নির্দিষ্ট সময়ের ২ ঘণ্টা পর লেনদেন শুরু হয়ে মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় সূচক ৬০১ পয়েন্ট কমে গেলে তাত্ক্ষণিকভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসসি) লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিনিয়োগকারীরা রাজপথে নেমে এলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে তাদের তাড়িয়ে দেয়। গ্রেফতার করা হয় ২২ জনকে। আহত হন অনেকে। শেয়ারবাজারে ধসের প্রতিবাদে মতিঝিল কিছু সময়ের জন্য রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এছাড়া রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করেন। চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে।
ডিএসসিতে আবার কবে লেনদেন শুরু হবে সুনির্দিষ্ট করে কেউ কিছু না বললেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বলেছে, রোববার লেনদেন হবে না। ওইদিন ঠিক হবে কখন আবার লেনদেন শুরু হবে।
টানা চার কার্যদিবস দরপতনের পর এসইসি মঙ্গলবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিএসসি সূচকের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঠেকাতে ২২৫ পয়েন্ট উত্থান বা পতনের সঙ্গে সঙ্গে ডিএসসিতে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। বুধবার এটা কার্যকর করা হয়েছিল। গতকাল নির্দিষ্ট সময়ের ২ ঘণ্টা পর বেলা ১টায় লেনদেন শুরুর মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচক ৬০১ পয়েন্ট পড়ে গেলে লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়। ২২৫ পয়েন্ট সূচক পতনের পর কেন লেনদেন বন্ধ হয়নি এর জবাবে ডিএসসির সভাপতি শাকিল রিজভী বলেছেন, ডিএসসির সার্কিট ব্রেকার স্বয়ংক্রিয় করা যায়নি। আগের দিন এটা ম্যানুয়েলি করা হয়েছিল। গতকাল এত দ্রুত দরপতন হয় যে, নির্দিষ্ট সার্কিট ব্রেকারে ম্যানুয়েলি সেটা করা সম্ভব হয়নি। লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরপরই হাজার বিনিয়োগকারী রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে।
অব্যাহত দরপতনের কারণে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর এবং এসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন।
এদিকে গতকাল শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ হওয়ার পর বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন তথ্য বিশ্লেষণ করে ৬টি হাউসে অস্বাভাবিক হারে শেয়ার বিক্রির প্রমাণ পাওয়ায় এসব হাউসের লেনদেন কার্যক্রম ১ মাসের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে এসইসি। একই সঙ্গে এসব হাউসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সব কার্যক্রম থেকে বিরত রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শেয়ারবাজারে এক সপ্তাহের মধ্যে দফায় দফায় বড় বড় ধসের পর বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছেন না। শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা অর্থমন্ত্রী কিংবা সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে না। গত দু’দিনে অর্থমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করলেও মিডিয়ায় কোন মন্তব্য করেননি। দিন দশেক আগে বিদেশ যাওয়ার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্যবসা করতে গেলে লাভ-ক্ষতি মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। লাভ হলে মিষ্টি খাবেন, আর ক্ষতি হলে রাস্তায় নামবেন তা হবে না। দরপতন হতে পারে এ মনোভাব নিয়েই ব্যবসা করতে হবে। আর গতকাল অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান খুলনায় শেয়ারবাজারে ধস ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, বাজার ধসে সরকারের মাথাব্যথার কোন কারণ নেই। শেয়ার ব্যবসায়ীদের দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি বলেন, দ্রুত লাভের আশায় অল্প পুঁজি খাটিয়ে যারা নিজেরা লাভবান হতে চায় তাদের জন্য মন কাঁদে না।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যায়। তিনি বলেন, সরকারের মদদপুষ্ট একটি সিন্ডিকেট কৃত্রিম অবস্থার সৃষ্টি করে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টাকা চুষে নিয়ে যাচ্ছে। অতীতে ’৯৬ সালেও তারা একই কাজ করেছিল। আওয়ামী লীগ দু’বার ক্ষমতায় থাকার সময়ে একই ধরনের ঘটনাই প্রমাণ করে এর সঙ্গে তারা জড়িত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য এম কে আনোয়ার মন্তব্য করেছেন, ’৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়করা এবারও টাকা লুট করে নিচ্ছে।
ডিএসসি’র সভাপতি শাকিল রিজভী বলেছেন, ব্যাংকগুলো শেয়ার মার্কেটে খেলে খেলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টাকা নিজেরা লাভ করে উঠিয়ে নিয়েছে। কলমানি মার্কেটে তারা এ টাকা ১৮০ ভাগ সুদে খাটাচ্ছে। মানি মার্কেট থেকে শেয়ার মার্কেটের টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি। পুঁজিবাজারে দরপতনে জড়িতদের শাস্তিরও দাবি করেন ডিএসই’র সভাপতি।
সরকারের অর্থ উপদেষ্টা শেয়ারবাজার নিয়ে বর্তমান সরকারের মাথাব্যথার কারণ নেই বলে মন্তব্য করলেও অতীত ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক অবস্থা চললে সরকার ও নিয়ন্ত্রকরা বসে থাকে না। সরকারি কোষাগার থেকে মার্কেটে বিভিন্ন উপায়ে বিনিয়োগ করা হয়। দেশে দেশে সরকারি ও বেসরকারি ফান্ড আছে। এরা বিভিন্ন লিস্টেড ও প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার কিনে। অবসর গ্রহণের পর সংশ্লিষ্টরা এ থেকে সুবিধা পায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের শাসনামলে পেনশন ফান্ডের টাকা গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তখন সরকার থেকে উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়েছিল। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বেইল আউট ফান্ড তৈরি করে শেয়ার মার্কেটকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে।
টানা ছয়দিন দরপতনের পর বন্ধ শেয়ারবাজার : শেয়ারবাজারে টানা ছয় কার্যদিবস দরপতন হয়েছে। গতকাল নির্দিষ্ট সময়ের ২ ঘণ্টা পর ১টায় লেনদেন শুরুর ৫ মিনিটের মাথায় ৬০১ পয়েন্ট সূচক পড়ে যায়। পরে গড় হিসাব করে এই দরপতন ৫৮৭ পয়েন্ট রেকর্ড করা হয়। এর আগের দিন বুধবার নির্দিষ্ট সময়ের ২ ঘণ্টা পর লেনদেন শুরু করে ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট লেনদেন শেষে সূচক ২২৫ পয়েন্ট পড়ে গেলে লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় লেনদেন শুরু হয়ে বেলা ১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ২৩৭ পয়েন্ট দরপতনের পর এসইসি ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ করে দেয়। এর আগে সোমবার ডিএসসিতে মূল্য সূচকের পতন হয়েছিল ৫৭ পয়েন্ট। রোববার সূচকের পতন হয়েছিল ১৪১ পয়েন্ট। যদিও সেদিন এক পর্যায়ে সূচক ৩১৬ পয়েন্ট কমে গিয়েছিল। আর গত বৃহস্পতিবারে পতন হয়েছিল ১১৫ পয়েন্ট। ডিএসসি’র লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪৮টি কোম্পানির মধ্যে ১৭৭টির দামই কমেছে গতকাল। বেড়েছে ৬৭টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৪টির। গতকাল ডিএসসি’তে মাত্র ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে, যা গত ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে (১০ জানুয়ারি, মাঝপথে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার দিন বাদে) ডিএসসি’তে গত ১৫ এপ্রিল সর্বনিম্ন ৭৭২ কোটি ২৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। জানুয়ারি মাসে ১২ কার্যদিবসের মধ্যে ৯ কার্যদিবসেই সূচকের পতন হয়েছে। এর মধ্যে ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পর পর দুদিন সূচকের বড় ধরনের পতন হয়। এর মধ্যে ৯ ডিসেম্বর একদিনে ডিএসসিতে সূচকের পতন হয় ৬০০ পয়েন্ট। পরদিন ৫০ মিনিটের মাথায় সূচক ৬৬০ পয়েন্ট পড়ে গেলে ডিএসসি’র ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়। এসইসি, ডিএসসি এবং সরকারের প্রতিনিধি যৌথ বৈঠকে বসে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ শেষে পরদিন পুনরায় লেনদেন শুরু হয়। ১১ জানুয়ারিতে অস্বাভাবিক হারে সূচক ১ হাজার পয়েন্ট বাড়ে। পরদিন আরও প্রায় ২শ’ পয়েন্ট বাড়লেও এরপর থেকে পর পর তিন কার্যদিবস সূচকের পতন অব্যাহত রয়েছে। ডিএসসি’র সূচক গত ৫ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ যেখানে প্রায় ৯ হাজার পয়েন্টে পৌঁছেছিল, কয়েক দফায় তা কমে গতকাল দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১২৩ পয়েন্টে।
৬ ব্রোকারেজ হাউসে লেনদেন বন্ধ : এদিকে গতকাল শেয়ারবাজারের লেনদেন বন্ধ হওয়ার পর বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন তথ্য বিশ্লেষণ করে ৬টি হাউসে অস্বাভাবিক হারে শেয়ার বিক্রির প্রমাণ পাওয়ায় এসব হাউসের লেনদেন কার্যক্রম ১ মাসের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে এসইসি। একই সঙ্গে এসব হাউসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সব কার্যক্রম থেকে বিরত রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্রোকারেজ হাউসগুলো হলো—ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (আইআইডিএফসি), পিএফআই সিকিউরিটিজ, এনসিসি ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক এবং এলায়েন্স সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট। এসব হাউস থেকে বাজার থেকে কম দরে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করার কারণে মাত্র ৫ মিনিটের লেনদেনে গতকাল বাজারের সূচকের বড় ধরনের পতন হয়েছে বলে মনে করছে এসইসি। এসইসির সদস্য ইয়াছিন আলী সাংবাদিকদের জানান, আজ (গতকাল) লেনেদেন অস্বভাবাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। লেনদেন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর পরই এসইসির কর্মকর্তারা সার্ভিলেন্সে গিয়ে দিনের সব লেনদেন পরীক্ষা করে দেখেন। লেনদেন পরীক্ষা করে ৬টি ব্রোকারেজ হাউস থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের আগ্রাসী বিক্রির কারণে ৬টি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন আগামী ১ মাসের জন্য বন্ধ করা হয়েছে।
গতকালও শেয়ারবাজারে লেনদেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুই ঘণ্টা পিছিয়ে বেলা ১টা থেকে শুরু হয়। বেলা ৩টা পর্যন্ত লেনদেন কার্যক্রম চালুর কথা থাকলেও মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৫৮৭ পয়েন্টের পতন ঘটে। শেয়ারবাজারের লেনদেনের ক্ষেত্রে গত বুধবার সূচকের ওপর যে সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হয় তার সীমা অতিক্রম করে যাওয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন। সার্কিট ব্রেকার অনুযায়ী, একদিনে সূচকের ২২৫ পয়েন্টের হ্রাস বা বৃদ্ধি পেলে তাত্ক্ষণিকভাবে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ডিএসই সূচক গণনার ক্ষেত্রে ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণের কারণে সার্কিট ব্রেকারের নির্ধারিত সীমার অনেক নিচে গিয়ে লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, সূচক পরিমাপের ক্ষেত্রে যে সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় তার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ডিএসই সাধারণ সূচক প্রতি ৫ মিনিট অন্তর অন্তর সমন্বিত হয়। গতকাল ৫ মিনিট লেনদেনের পর সূচকের সমন্বয় হতেই তা সার্কিট ব্রেকারের সীমা অতিক্রম করে যায়। ফলে দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে এসইসির সদস্য ইয়াছিন আলী বলেন, ডিএসই সূচকের ক্ষেত্রে যে সফটওয়্যার ব্যবহার করে তাতে লেনদেনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সূচকের পরিমাপ নির্ধারিত হয় না। ৫ মিনিট অন্তর অন্তর সূচকের সমন্বয় ঘটে। আর এ সমন্বয় করার সময়ই দেখা গেছে প্রথম ৫ মিনিটে সূচকের পতন হয়েছে ৫৮৫ পয়েন্ট। তিনি আরও বলেন, যদি লেনদেন চলাকালে সূচকের ২২৫ পয়েন্টের হ্রাস বা বৃদ্ধি হতো তাহলে তাত্ক্ষণিকভাবে লেনদেন বন্ধ হয়ে যেতো।
গত কয়েকদিনের টানা দরপতনে টানা বিক্ষোভ চলছে শেয়ারবাজারে। গতকালও শেয়ারবাজারে বিক্ষোভ, ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা রণক্ষেত্র, আটক ২২ : লেনদেন বন্ধ হওয়ার পরপরই রাস্তায় নেমে পড়ে বিনিয়োগকারীরা। তারা বিক্ষোভ মিছিল করে রাস্তায় কাগজ জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন পুলিশের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করলে মতিঝিল শাপলাচত্বর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এসময় ১৫-২০টি গাড়ি ভাংচুর করে তারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ সেখান থেকে ২২ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
এদিকে দরপতনের খবরে ধানমন্ডি সাতমসজিদ, কারওয়ানবাজার ও মিরপুর এলাকাতেও বিক্ষোভ করে বিনিয়োগকারীরা। দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ওই বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। ২টা নাগাদ পুলিশ লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কারওয়ানবাজারে রাস্তা অবরোধ করার চেষ্টা করলে পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল থেকেই মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে মোতায়েন ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। এ ছাড়াও পরিস্থিতি সামাল দিতে আগে থেকেই দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন ছিল। এছাড়াও র্যাব সদস্যরাও ছিল টহলে। প্রস্তুত ছিল জলকামান। তবে জলকামান ব্যবহার করা হয়নি। দুপুর ১টা ১০ মিনিটের দিকে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে পড়লে প্রথমে পুলিশ তাদের বেরিকেড দেয়। তারা যেন জমায়েত হতে না পারে সে চেষ্টা করে পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই শত শত বিনোয়াগকারী রাস্তার দু’পাশ থেকে মিছিল বের করে। পূর্ণিমা সিনেমাহলের ওপর থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয় পুলিশের ওপর। এরপর বিনিয়োগকারীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করে। মিছিলে তারা অর্থমন্ত্রী, সিএসসি ও ডিএসসির সভাপতির পদত্যাগ দাবি করে। তারা হরতাল হরতাল বলেও স্লোগান দেয়। এসময় পুলিশ তাদের ধাওয়া করলে সবাই সমবেত হয়ে পুলিশকেও ধাওয়া দেয়। পরে দাঙ্গা পুলিশ লাঠিচার্জ করলে বিনিয়োগকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এসময় তারা রস্তায় বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করে। বিনিয়োগকারীদের দমিয়ে রাখতে কয়েক দফা টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যস্ততম মতিঝিল এলাকা যানবাহনশূন্য হয়ে পড়ে। পুলিশ বিনিয়োগকারীদের বেপরোয়াভাবে লাঠিচার্জ করে এবং ২২ জনকে আটক করে পুলিশ মতিঝিল থানায় নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কয়েকজন রয়েছে পথচারী। পুলিশ ধাওয়া করে যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই আটক করেছে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দৌড় দেয়ায় তাদের আটক করে গাড়িতে তোলা হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও আশপাশের সড়কে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের যানচলাচল। আগের দিনেও ঠিক একই ধরনের ঘটনায় শতাধিক যানবাহন ভাংচুর হওয়ায় গতকাল মতিঝিলে যানবাহন পার্কিং কম ছিল। সড়ক বন্ধ থাকায় দৈনিক বাংলা মোড় থেকে কমলাপুর এবং ফকিরাপুল থেকে আর কে মিশন রোড পর্যন্ত সড়ক অনেকটাই ফাঁকা ছিল। দুপুর ১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ওইসব সড়কে গাড়ি চলাচল না করায় আশপাশের রাস্তায় ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে না পেরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে।
মতিঝিল থানার ওসি সালাহউদ্দিন জানান, আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের দমাতে পুলিশকে কঠোর থাকতে নির্দেশ রয়েছে। রাস্তায় যানচলাচলে বাধা দেয়া ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগে ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে এদের মধ্যে কেউ নিরপরাধ হলে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। ওসি সালাহউদ্দিন আরও বলেন, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা করা হবে। এদিকে মতিঝিল থানার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) নাসির উদ্দিন বলেন, বুধবারের ঘটনায় দু’জন আটক ও অজ্ঞাত ৯ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। নতুন করে আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও পৃথক মামলা করা হবে বলে জানান এসআই নাসির। পুলিশ জানায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বিকাল সাড়ে ৩টায় মতিঝিল এলাকায় ফের গাড়ি চলাচল শুরু হয়।
বাজার পরিস্থিতি : গতকাল বেলা ১টায় লেনদেন শুরুর পর থেকেই বাজারে ব্যাপক আকারে দরপতন হতে থাকে। দ্রুত পতন ঘটে লেনদেনে অংশ নেয়া প্রায় সবকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আস্থার সঙ্কট তৈরি হওয়ার কারণে তারা দ্রুত বাজারে তাদের শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। ফলে বাজারে বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতার অভাবে শেয়ারের দামের পতন ঘটে। গতকাল লেনদেন হওয়া ১৮২টি কোম্পানির মধ্যে দাম কমে যায় ১৮০টির। বেড়েছে মাত্র ৮টির এবং অপরবির্তিত ছিল ২টির দাম। অবশ্য ৬টি ব্রোকারেজ হাউস থেকে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে বলে এসইসির প্রাথমিক তদন্তে ধরা পড়েছে। গতকাল সূচকের অস্বাভাবিক দরপতনের পেছনে এটি একটি বড় কারণ বলে মনে করছে তারা। এ জন্য ওই ব্রোকারেজ হাউসগুলোর লেনদেন কার্যক্রম ১ মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। অবশ্য গতকাল ৫ মিনিটে শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়েছে ৬৮ কোটি ৮ লাখ টাকার শেয়ার। ১০ হাজার ৪৩৩টি হাওলায় এ সময়ে হাতবদল হওয়া শেয়ারের সংখ্যা ছিল ৫৮ লাখ ৭৬ হাজার ৩৫৮টি।
এসইসির ব্রিফিং : শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেলা সাড়ে ৫টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে এসইসি। এতে এসইসির সদস্য ইয়াছিন আলী বলেন, অস্বাভাবিক হারে শেয়ার বিক্রির কারণে ৬টি ব্রোকারেজ হাউসকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রম ১ মাস বন্ধ থাকবে। তাত্ক্ষণিকভাবেই এসব ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্রোকারেজ হাউসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আগে কারণ দর্শানো নোটিশ ও শুনানির জন্য ডাকা হয়। কিন্তু আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে তাদের লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছি এবং এ সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। এখন তাদের শুনানির জন্য ডাকা হবে এবং তাদের বক্তব্য শোনার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যে ৬টি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে সেসব হাউসের বিনিয়োগকারীদের ডিপি সাসপেন্ড করা হয়নি বলে জানান ইয়াছিন আলী। তিনি বলেন, এসব হাউসের বিনিয়োগকারীরা লিংক একাউন্টের মধ্যে অন্য ব্রোকারেজ হাউসে ট্রান্সফার করে লেনদেন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন।
সব বড় দরপতনের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে : গত ৮ ডিসেম্বর থেকে গতকালের আগ পর্যন্ত যতগুলো বড় ধরনের দরপতন হয়েছে তার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ৮ ডিসেম্বরে বড় ধরনের দরপতনের পর চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল এসইসি। এক মাসের সময় দিয়ে এ কমিটিকে তদন্ত কাজের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হওয়ায় কমিটির মেয়াদ আরও দেড় মাস বাড়ানো হয়েছে। আর এ কমিটি ৮ ডিসেম্বরের পর যে কয়টি বড় ধরনের দরপতন হয়েছে সব কয়টির কারণ অনুসন্ধান করবে বলে জানিয়েছেন এসইসির সদস্য ইয়াছিন আলী।
সার্কিট ব্রেকার নতুন আতঙ্ক : শেয়ারবাজারের লেনদেনে বড় ধরনের উত্থান-পতন ঠেকাতে সূচকের সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। বরং সূচকের সার্কিট ব্রেকার বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। গতকাল মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এটিকে এখন বাজারের জন্য নতুন আতঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করছেন। তারা মনে করছেন, কারসাজি করে এখন যে কোনো মুহূর্তে বাজার বন্ধ করে দেয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে

No comments:

Post a Comment