Sunday 1 January 2012

ইশতেহারের সিকিভাগও বাস্তবায়ন হয়নি










এমরান হোসাইন
ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। পাঁচ বছর মেয়াদি সরকারের ৩ বছরে নির্বাচনী ইশতেহারের সিকিভাগও বাস্তবায়ন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানো, পদ্মা সেতু নির্মাণ, রাজধানীর যানজট নিরসন, দুর্নীতি রোধ, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত, প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত, পুঁজিবাজারের বিকাশ, প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ শত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিলেও তিন বছরের মধ্যে এগুলো পূরণ হয়নি। রংপুরকে বিভাগ করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, জাতীয় শিক্ষানীতি ও নারীনীতি প্রণয়নসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হলেও এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের তীব্র আপত্তি রয়েছে। সরকারের বাকি দু’বছরে এসব প্রতিশ্রুতি পূরণ নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণসহ কিছু কিছু প্রকল্পের নাম উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা জানিয়ে দিয়েছেন, তারা শুরু করতে পারলেও সরকারের চলতি মেয়াদে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারবেন না। এদিকে নির্বাচনের আগে জনগণকে দেয়া এসব ওয়াদা পূরণে সরকারের নজর না থাকলেও সরকারদলীয়দের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও বিরোধী দলের প্রতি নিপীড়নমূলক অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়েছে অনেকটা তড়িঘড়ি করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্ষমতার মেয়াদ হলেও এই সরকার তার ইশতেহারের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার শেরাটন হোটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘দিনবদলের সনদ’ নামে ২৪ পৃষ্ঠার একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ইশতেহারের লিখিত প্রতিশ্রুতির বাইরেও নির্বাচনী বক্তৃতায় জনগণকে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো, কৃষকদের বিনামূল্যে সার প্রদানসহ বেশকিছু বিষয়ে ওয়াদা দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ক্ষমতার আসার পর সরকার এসব মৌখিক ওয়াদা অস্বীকার করার পাশাপাশি ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বিষয়েও কোনো অগ্রগতি নেই।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে। ইশতেহারের অগ্রাধিকারের ৫টি বিষয়ের প্রথমটিতে বলা হয়—চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। প্রধান এই প্রতিশ্রুতি পূরণেও তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম কমানো তো দূরের কথা, এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ব্যর্থ হয়েছে। গত তিন বছরে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। জিনিসপত্রের দামের জন্য জনগণের দুর্ভোগের কথা সম্প্রতি স্বীকার করেছেন সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান। দফতর বদলে বেসরকারি বিমান চলাচলমন্ত্রী হওয়ার পর আগের দায়িত্ব পালনে নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি অকপটে স্বীকার করেন, তার অনেক ক্ষেত্রে সফলতা থাকলেও দ্রব্যমূল্যের জন্য দেশের মানুষ কষ্ট পেয়েছেন।
সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় মোটা চালের কেজিপ্রতি মূল্য ২৫ থেকে ২৭ টাকার মধ্যে থাকলেও বর্তমানে এর দাম ৩৫ থেকে ৩৭ টাকার মধ্যে। ওই সময়ে নাজিরশাইল চালের দাম ৪০ থেকে ৪২ টাকা থাকলেও বর্তমানে এর বাজারদর ৫৪ থেকে ৫৭ টাকা। ২৩ টাকা কেজির আটা এখন ৩০ টাকা। ৩০ টাকা কেজির চিনি হয়েছে ৬৫ টাকা। ৯০ টাকা দরের সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে ১৩৫ টাকা। অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও সমহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে ইশতেহারে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ‘জড়িত’ সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরকার এক্ষেত্রে কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বরং তথাকথিত ওই সিন্ডিকেট এখন খোলস পাল্টে সরকারের ছত্রছায়ায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সড়ক, রেল, নৌ, বিমান পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী সেতু, টানেল নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪ লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রেলপথ সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত এর কিছুই হয়নি। ক্ষমতা গ্রহণের পর পদ্মা সেতুকে সরকার তার প্রধান অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প উল্লেখ করে কার্যক্রম শুরু করে। গত তিন বছরে এর পেছনে সরকারের খরচও হয় প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেতুর দরপত্র প্রক্রিয়াকালে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এ সেতু নির্মাণে ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ঋণ স্থগিত করে। বিশ্বব্যাংকের দেখাদেখি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাইকাও ঋণ সহায়তা বন্ধ রেখেছে। দুর্নীতির কারণে যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে এ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়েও দেয়া হয়। বর্তমানে এ সরকারের মেয়াদে পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নিলেও ৩ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ১৯ মাসে কাজ হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। বাকি ১৭ মাসে এ কাজ শেষ করা সম্ভব নয় বলে খোদ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। এ প্রকল্পের বিষয়ে নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে তারা মাত্র ৪২ কিলোমিটার অংশ দৃশ্যমান করতে পারবেন। উল্লেখ্য, সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৮০ কিলোমিটার।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে ডজনখানেক প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। ইশতেহারে ঢাকায় পাতাল রেল/মনোরেল, সার্কুলার রেলপথ এবং এলিভেটেড (উড়াল সড়ক) রাস্তা নির্মাণ করে গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, ঢাকার চতুর্দিকে বৃত্তাকার (অরবিটাল) জলপথ, বেড়িবাঁধ, সড়ক, রেলপথ নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ বছরের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও এখন পর্যন্ত এ কাজের অগ্রগতি কেবল ওই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনই! এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে টেন্ডারের দেন-দরবারের ক্ষেত্রে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। মেট্রোরেল স্থাপন প্রকল্পটি আটকে গেছে এর রুট ঠিক করার মধ্যে। এর রুট নিয়ে বিমানবাহিনী, সংসদ ভবন কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে।
মহাজোট সরকার তার বিদ্যুত্ খাতে সবচেয়ে সফল বলে দাবি করলেও তিন বছরে তার প্রতিশ্রুতির অর্ধেক বিদ্যুত্ও উত্পাদন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১১ সাল নাগাদ ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এ সময়ে তারা আড়াই হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পেরেছে বলে দাবি করছে। তবে এ সময় অনেক পুরনো বিদ্যুেকন্দ্রে উত্পাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
এদিকে সফলতার (সরকারের দাবি মতে) এ বিদ্যুত্ খাত এখন সরকারের গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধছে। বিনা টেন্ডারের সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল উচ্চমূল্যে বিদ্যুত্ ক্রয় করতে গিয়ে সরকারকে বড় অংকের ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। সরকারি তথ্যমতে, জ্বালানিভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র হতে বিদ্যুত্ ক্রয়ের জন্য চলতি অর্থবছরের প্রথম দু’মাসে (জুলাই-আগস্ট) ১ হাজার ২৩৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু বিদ্যুত্ খাতেই সরকারকে বছরে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। তেল ও গ্যাস খাত মিলিয়ে এ ভর্তুকি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে। সরকারের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে মাশুল দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুত্ খাতের দুর্নীতি থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের রেহাই দিতে সরকার এ সংক্রান্ত একটি ইনডেমনিটি বিলও সংসদে পাস করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েক দফায় প্রতিটি জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩ দফায়। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় দু’দফায় আর সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও মহাজোট সরকার গত ৬ মাসে তিন দফায় তেলের দাম বাড়িয়েছে। ইশতেহারে আওয়ামী লীগ জাতীয় কয়লানীতি প্রণয়ন করার কথা বললেও এখনও পর্যন্ত তা হয়নি।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ঘোষিত ১৪ দলের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি এবং ২২ নভেম্বর গৃহীত ২৩ দফা অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির আলোকে এবং বিগত ৭ বছরের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে এই কর্মসূচি (ইশতেহার) প্রণীত হয়েছে। ১৪ দলের ৩১ দফা ও ২৩ দফার প্রধান দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে প্রণীত এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ওপর ভর করে দেশের জনমত উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এই সরকার। এমনকি সরকারের শরিকদের অনেকেই এ ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে ছিলেন। হাইকোর্ট আগামী দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার প্রতি মত দিলেও সরকার তা গ্রহণ করেনি। এ ক্ষেত্রে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের সময়টাও দেয়নি সরকার।
আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে অগ্রাধিকারের ২নং ধারায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করার কথা বললেও এ সরকারের হাতেই এর স্বাধীনতা খর্ব হতে চলেছে। সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদে যে বিল উত্থাপন করেছে তাতে কমিশনের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, দুদক নখরবিহীন বাঘে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো ভূমিকা রাখতে না পারলেও বিরোধী মতের হয়রানিতে সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘স্বাধীন’ এ কমিশন। আসল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারলেও বিরোধীদলীয় মতের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির নামগন্ধ পেলেই তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইশতেহারের অগ্রাধিকারের ৫নং ধারায় বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে নামকাওয়াস্তে মানবাধিকার কমিশন গঠন ছাড়া আর কোনো কিছুই করতে পারেনি সরকার। মানবাধিকার কমিশন গঠন হলেও এ প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে এর কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা তো দূরের কথা, বিচার বিভাগ দলীয়করণে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের পরিবর্তে এটা আরও বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে নতুন সংস্করণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে গুপ্তহত্যা। ন্যায়পাল নিয়োগ তো হয়ইনি, বরং বিগত চারদলীয় জোট সরকার যে কর ন্যায়পাল নিয়োগ দিয়েছিল এ সরকার তা বাতিল করেছে।
ইশতেহারে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকারের কার্যক্রমে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশন থেকে একটি সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে প্রস্তাবাকারে জমা দিলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বললেও মহাজোট সরকার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। সংসদ কার্যকর হওয়ার পরিবর্তে এটা পরিণত হয়েছে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও সরকারি দলের স্তুতিবন্ধনের কেন্দ্রস্থলে। বিরোধী দলকে সংসদে আনার ব্যাপারে সরকারের কোনো কার্যকর তত্পরতা নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেয়ার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে বিশেষ কমিটিতে এ ধরনের প্রস্তাব এলেও অজ্ঞাত কারণে তা গৃহীত হয়নি। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত তথা সংসদে প্রত্যক্ষ ভোটে নারীর জন্য ১০০ আসন সংরক্ষিত করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বিগত জোট সরকার সংরক্ষিত যে ৪৫টি আসন করেছিল তার থেকে মাত্র ৫টি বাড়িয়ে ৫০টি করেছে এই সরকার। আর এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভোটের প্রতিশ্রুতি থাকলেও এ সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উত্স প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও গত ৩ বছরে একবারও সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তবে নানামুখী চাপে সম্প্রতি মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা ও চরম দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৫ ও ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও তিন বছরে এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো অর্জন সরকারের নেই। বেকারত্ব বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪ কোটি লোক বেকার বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
ইশতেহারে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলার কথা বলা হলেও ঘটেছে উল্টোটা। বিরোধী দল থেকে কোনো কর্মসূচি দেয়া হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে হরহামেশাই। বিরোধী দল দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকার দলীয় ক্যাডারদেরও মাঠে দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে সরকারি দলের কর্মসূচি চলছে পুলিশি প্রটেকশনে।
ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকারে গিয়ে তা বেমালুম ভুলে গেছে। গত তিন বছর প্রশাসনে চলেছে নগ্ন দলীয়করণ। মেধা যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে হয়েছে পদোন্নতি ও বদলি। অপরদিকে সরকার দলের আনুগত্যে বিশ্বাসী নয়, এমন অজুহাতে অনেক মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাকে দিনের পর দিন ওএসডি করে রেখেছে। কাউকে কাউকে দেয়া হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর। ইশতেহারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করার কথা বলা হলেও তিন বছরে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা বলা হলেও দেশের খাদ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। গত তিন বছরে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে সরকারকে।
নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ ও পানিসম্পদ রক্ষায় কার্যকর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকার নিজের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দিয়েছে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও করতে পারেনি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশের প্রাপ্যতা, হিস্যা ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান পানি সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ একটি সমন্বিত পানিনীতি প্রণয়ন এবং আঞ্চলিক পানি নিরাপত্তা গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিলেও, এ বিষয়ে ৩ বছরে সরকারের কোনোই উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়নি।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেও এটা নিয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর তীব্র আপত্তি। ইশতেহারে এক বছরের মধ্যে (২০১০ সালের মধ্যে) প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তি ১শ’ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হলেও ৩ বছরে তা করতে পারেনি এ সরকার। শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। গত ৩ বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলেছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের দখলের মহোত্সব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে হয়েছে চরম দলীয়করণ। শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন কাঠামো ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন এবং স্বতন্ত্র কর্মকমিশন গঠনের কথা বলা হলেও ৩ বছর ধরে সরকার এটা নিয়ে কেবল ঘোষণার মধ্যে রয়েছে। স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার প্রতিশ্রুতিও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। রাজধানী ঢাকার প্রতি থানায় সরকারি মাধ্যমিক হাইস্কুল ও প্রতি উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুুতিও পূরণ করতে পারেনি সরকার।
ইশতেহারে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি নবায়ন, ওষুধনীতি যুগোপযোগী ও প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়নের কথা থাকলেও তা হয়নি। প্রতিশ্রুতি অনুসারে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত নারীনীতি পুনর্বহাল করা হলেও এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের তীব্র আপত্তি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বড় ধরনের ফাঁক রয়েছে। ইশতেহারের পরিশিষ্ট অংশে রূপকল্প (ভিশন) অনুযায়ী বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে যে ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অনেকটাই প্রতারণার শামিল। আওয়ামী লীগ যে ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার মধ্যে মাত্র ৭টি সরকারের মেয়াদে অর্থাত্ ২০১৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা হলেও ইশতেহারে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই এই সরকারের মেয়াদের পরে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২১ সাল পর্যন্ত, যা বাস্তবায়নে আরও দুটি সরকারের প্রয়োজন হবে। তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রদান, রংপুরকে বিভাগে উন্নীতকরণ ও বিগত আওয়ামী লীগ আমলের কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরায় চালু করেছে।

No comments:

Post a Comment