Tuesday 26 April 2011

অনিয়ম দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়ে এনটিআরসিএ বিলোপের সিদ্ধান্ত

রিয়াজ চৌধুরী

অনিয়ম-দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়ে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে একটি পৃথক শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, যা শিক্ষকদের প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিবন্ধন ও প্রত্যয়নের ব্যবস্থা করা ছাড়াও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। তবে তা বাস্তবায়ন হতে সময় লাগবে বলে জানা গেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার স্তরভিত্তিক বেসরকারি শিক্ষকের জন্য উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা, জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে ন্যূনতম শিক্ষক মান নির্ধারণ করা, তুল্যমানের একটি স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিবন্ধন ও প্রত্যয়নের ব্যবস্থা করা এবং তাদের তালিকা বা পুল তৈরি করা এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলেও অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। অনৈতিক অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এনটিআরসিএ থেকে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষক ভুয়া এনটিআরসিএ’র সনদ দিয়ে চাকরি করছেন। নিয়মিত এ বিষয়ে মাউশিতে অভিযোগ আসছে। কিন্তু মাউশির একটি অসাধুচক্র অনৈতিক পন্থায় ভুয়া সনদধারী শিক্ষকদেরও এমপিওভুক্ত করছে। এসব অনিয়মের পাশাপাশি অন্যান্য কারণেও সংস্থার ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। দুর্নীতি ও অনিয়মে বেসামাল হয়ে সংস্থাটিকে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতিতে এনটিআরসিএকে বিলুপ্ত করে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি পৃথক শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে যাতে শিক্ষক নিয়োগে কোনো ত্রুটি থাকবে না। দুর্নীতি-অনিয়ম থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নিতে হবে। পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবেন, তাদের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ শূন্য থাকবে, সেই শূন্যপদের তালিকা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ফলে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব আর থাকবে না। তাহলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে।
এনটিআরসিএ সূত্রে জানা গেছে, সংস্থায় ভুয়া সনদধারী ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের সংখ্যাই বেশি। এনটিআরসিএ’র নিয়োগ কমিটি গত বছরের ১৮ মে দুজন সহকারী পরিচালক নিয়োগের সুপারিশ করে। কিন্তু সংস্থার তত্কালীন চেয়ারম্যান কবীর উদ্দিন আহমেদ সরকারি নিয়মনীতি, সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রবিধানমালা এবং এনটিআরসিএ আইন ২০০৫-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ৬ জন সহকারী পরিচালক নিয়োগ দেন। গত বছরের ডিসেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ অনিয়ম প্রমাণিত হয়। পরে সংস্থার ৩২তম নির্বাহী কমিটির সভায় ৫ জন সহকারী পরিচালকের নিয়োগ বাতিল করার জন্য ঐকমত্য পোষণ করা হয়। কিন্তু এ নিয়োগ আর বাতিল করা হয়নি। এদিকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এনটিআরসিএ’র ৩৫তম নির্বাহী বোর্ডের সভায় সংস্থার এমএলএসএস মো. রাকিব হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারণ তার নিয়োগকালীন দাখিলকৃত সনদপত্র ছিল ভুয়া। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড তার সনদপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর প্রমাণ পেয়েছে বলেও সভায় তথ্য উপস্থাপন করা হয়। অন্যদিকে ৬ষ্ঠ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ফল নিয়ে চলছে বিতর্ক। অভিযোগ রয়েছে, এ পরীক্ষায় শতকরা ৪ দশমিক ৫৭ ভাগ প্রার্থী উত্তীর্ণ হলেও সরকারিভাবে পরীক্ষায় পাসের হার ১৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে সংস্থায় তোলপাড় চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিআরসিএ’র এক কর্মকর্তা জানান, ৬ষ্ঠ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় ফল জালিয়াতি হয়েছে। এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান, একজন সদস্য (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) ও একজন উপ-পরিচালক কোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে ফলাফল পরিবর্তন করেছেন। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রায় তিনশ’ জনকে পরীক্ষায় পাস করিয়েছেন। এছাড়া আবশ্যিক বিষয়গুলোতে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান) বেশিরভাগ প্রার্থী ফেল করায় তাদেরকে গ্রেস নাম্বার দিয়ে পাস করানো হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি ওপেন সিক্রেট বলে ওই কর্মকর্তা জানান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করত ঢাকা বোর্ডের কম্পিউটার সেন্টার। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো বায়োমেট্রিক্স নামক একটি প্রতিষ্ঠান ফলাফল তৈরির কাজটি করে। জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক এনটিআরসিএ’র এক সদস্যের (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাই জালিয়াতচক্র কম্পিউটারের গোপন নম্বর, কোড নম্বর জানত। যে কারণে ফলাফল ইচ্ছেমত পরিবর্তন করতে কোনো সমস্যা হয়নি। এদিকে পরীক্ষায় বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থী যতটা অবজেক্টিভ প্রশ্নের উত্তরে টিক মার্ক দিয়েছেন, তার চেয়ে কয়েক নম্বর বেশি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে এ পরীক্ষায় যারা পাস করেননি, তারা রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। গত ২০ মার্চ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থীরা বলেন, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের অবহেলা, উদাসীনতা, দুর্নীতি, খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ত্রুটির কারণে ষষ্ঠ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন পরীক্ষায় আমরা পাস করতে পারিনি। এ পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানান তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন দক্ষিণ বনশ্রী মডেল হাইস্কুলের তিন শিক্ষিকার (তিনজনই সরকারদলীয় নেতার স্ত্রী) বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ নিয়ে এমপিওভুক্তির সুবিধা নেয়ার অভিযোগ আসে মাউশিতে। কিন্তু এই সনদ জালিয়াতির দায়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। উল্টো যাদের বিরুদ্ধে সনদপত্র জালিয়াতির অভিযোগ আসে, তাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করছেন সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীসহ সারাদেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে ভুয়া সনদ দিয়ে অনেকে চাকরি করছেন। এমনকি এমপিওভুক্তির সময় মাউশি কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এনটিআরসিএ’র সনদ যাচাই-বাছাইও করেন না।
সনদ জালিয়াতির বিষয়ে এনটিআরসিএ সদস্য (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) ও যুগ্ম সচিব ছামেনা বেগম আমার দেশকে বলেন, এনটিআরসিএ’র সনদ জালিয়াতচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ৬৪ জেলা প্রশাসক এবং সব জেলা শিক্ষা অফিসারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সংস্থার নিজস্ব ও স্থায়ী অফিস নেই। আইন বিষয়ক একজন কর্মকর্তাও নেই, নেই পর্যাপ্ত জনবলও। তাই আমরা ইচ্ছা করলেই দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। তিনি জানান, ভুয়া সনদের বিষয় চিহ্নিত হওয়ার পর এমএলএসএস মো. রাকিব হোসেন চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এখন তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ৬ষ্ঠ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ফল পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, ফল ঠিকই আছে; কোনো অনিয়ম হয়নি।
মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর মো. নোমান উর রশিদ আমার দেশকে বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের লাগাম টেনে ধরতে সরকার সংস্থাটিকে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষানীতিতে একটি পৃথক শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশও করা হয়েছে। তবে তা বাস্তবায়ন হতে সময় লাগবে। কত সময় লাগতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় শিক্ষা নীতি হুট করেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এটা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। সেক্ষেত্রে কত বছর লাগবে এখনই বলা মুশকিল।
মাউশি পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর দীপক কুমার নাগ আমার দেশকে বলেন, প্রায়ই এনটিআরসিএ’র ভুয়া সনদ চিহ্নিত করছে মাউশি। তবে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার যেসব শিক্ষকের এনটিআরসিএ’র সনদপত্র জাল বা সন্দেহজনক মনে হয়, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এনটিআরসিএ’তে পাঠানো হয়। এতে সনদপত্র জাল প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের এমপিও স্থগিত করা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রচলিত বিধি অনুসারে দেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়োগ প্রদানের দায়িত্ব পালন করে থাকে। দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ বেতন সরকার প্রদান করলেও পরিচালনা পর্ষদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া বহুক্ষেত্রে নানারকম অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটে। এমনই প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এনটিআরসিএ। কিন্তু সেই সংস্থাও অনিয়ম-দুর্নীতির বেড়াজাল হতে বেরুতে পারেনি।

No comments:

Post a Comment