Wednesday 23 November 2011

জনপ্রশাসনে চলছে চরম অরাজকতা : ২৪ বছরের সিনিয়র জুনিয়র একই পদে কাজ করছেন

কাদের গনি চৌধুরী

জনপ্রশাসনে পদোন্নতিবন্ধ্যত্ব কাটছে না। শুধু সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাজ করছেন ১৬টি ব্যাচের কর্মকর্তারা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ২৪ বছরের সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তারা একই পদে কাজ করছেন। একই ব্যাচের কোনো কোনো কর্মকর্তা যখন সচিব হিসেবে ক্ষমতা এনজয় করছেন, তখন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাজ করছেন ওই ব্যাচেরই অনেকে। দলীয় কালার না থাকায় এসব কর্মকর্তা বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও এমন নজির নেই।
উপ-সচিব পদেও একইভাবে ৯টি ব্যাচের ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। চাকরিজীবনের ১২ বছরের জুনিয়র ও সিনিয়র কর্মকর্তাকে একই পদে কাজ করতে হচ্ছে। এর ফলে প্রশাসনজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড থাকছে না। বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সময়মত পদোন্নতি দিতে না পারা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত সুস্থ ধারা না থাকায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ২০০৬ সালের ২৫তম বিসিএসের কর্মকর্তারা যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন ২৪ বছর আগের ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা। ’৮২ ব্যাচের ৯ জন, ’৮৪ ব্যাচের ১১, ’৮৫ ব্যাচের ১৭, ’৮৬ ব্যাচের ৪০, ’৯১ (জানুয়ারি) ব্যাচের ৪৮, ’৯১ (ডিসেম্বর) ব্যাচের ৫৩, ১১তম ব্যাচের ৬৮, ১৩তম ব্যাচের ১১০, ১৫তম
ব্যাচের ১০৮, ১৭তম ব্যাচের ৬৩, ১৮তম ব্যাচের ৯১, ২০তম ব্যাচের ২৭৪, ২১তম ব্যাচের ১৭০, ২২তম ব্যাচের ২৬৮, ২৪তম ব্যাচের ২৯১ এবং সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া ২৫তম ব্যাচের ৭৫ কর্মকর্তা একই পদে কাজ করছেন।
উপসচিব পদে ’৮২ ব্যাচের পাশাপাশি ১২ বছরের জুনিয়র ৯৪ সালের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এদের মধ্যে ’৮২ ব্যাচের ৩৩, ’৮৪ ব্যাচের ১৯৬, ’৮৫ ব্যাচের ৫০৯, ’৮৬ সালের ২০৬, ৯১ (জানুয়ারি) ব্যাচের ৮১, ’৯১ (ডিসেম্বর) ব্যাচের ১৪৫, ১১তম ব্যাচের ১৫০ এবং ১৩তম ব্যাচের ১৪ কর্মকর্তা রয়েছেন। যুগ্ম সচিব পদে কাজ করছেন ’৮২ (রেগুলার), ’৮২ (স্পেশাল) ও ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা।
এদিকে প্রশাসনে ৯টি ব্যাচের ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা উপ-সচিব। উপ-সচিবের ৮৩০টি পদের বিপরীতে এখন অতিরিক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ৭১০ জন। এটিও প্রশাসনের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন রেকর্ড। পদের তুলনায় এত বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। বড় বড় ব্যাচের চাপ সামাল দেয়াসহ রাজনৈতিক পছন্দ ও অপছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গত কয়েক বছরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পদের বাইরে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ পদ নেই, তবু পদোন্নতি দিতে হয়েছে। এসব অতিরিক্ত কর্মকর্তার চাপ সামাল দিতে গিয়ে ২০০৬ সাল থেকে প্রশাসনে উপ-সচিবের সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টি করা হয়। মোট ৪৫০ উপ-সচিবের পদকে সুপারনিউমারি দেখিয়ে বছর বছর সংরক্ষণ করে বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। যারা সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে (পূর্বপদ) বসেই কাজ করছেন।
একই পদে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার কারণে সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনে এটাই এখন বড় সঙ্কট। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারাও সিনিয়র সহকারী সচিব এবং তার চেয়ে ১৬ ব্যাচ জুনিয়র ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও সিনিয়র সহকারী সচিব। দেখা গেছে, ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে প্রবেশ করেছেন ১৯৮৩ সালে। আর ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে এসেছেন ২০০৬ সালে। অর্থাত্ ’৮২ ব্যাচ যখন সহকারী কমিশনার, তখন ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের কারও কারও জন্মও হয়নি। প্রায় সমসাময়িক চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ১৯৮৪ ও ’৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা। ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ১৯৮৬ সালে এবং ’৮৫ ব্যাচ ১৯৮৮ সালে। ৬৫০ কর্মকর্তার বড় ব্যাচ ’৮২ বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তারা উপ-সচিব হয়েছেন ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে। সাড়ে চারশ’ সংখ্যার ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা ২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে উপ-সচিব হন। ’৮৫ ব্যাচ ও ’৮৬ ব্যাচ ২০০৬ সালে। বর্তমান সরকারের সময় উপ-সচিব পদে দু’দফায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ৩ শতাধিক কর্মকর্তাকে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়, যেখানে ১৩তম ব্যাচের কয়েকজন পদোন্নতি পান। ’৮২ বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তাদের উপ-সচিব হতেই ২০ বছর পার হয়ে গেছে। এ ব্যাচের ৩১ কর্মকর্তা বর্তমানে উপ-সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন। তারা তিন দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। অনেকে প্রাপ্য পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে গেছেন। এ ব্যাচের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এখন সচিব। অথচ অন্যরা পদোন্নতি না পেয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপ-সচিবের চেয়ারে কাজ করছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে উপ-সচিবদের মধ্যে তিনটি সিনিয়র ব্যাচের ২৩১ কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত অবস্থায় পড়ে আছেন। এরা হলেন ’৮২ নিয়মিত ব্যাচের ৩ জন, ’৮২ বিশেষ ব্যাচের ৩১ জন এবং ১৯৮৪ ব্যাচের ১৯৭ জন। ১৯৮৪ ব্যাচের যেসব কর্মকর্তা ২০০৩ সালে উপ-সচিব হয়েছেন, তারা যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেন ২০০৬ সালে। অথচ পাঁচ বছরেও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি; দু’দফায় বঞ্চিত হয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির তালিকায় রয়েছেন ’৮১ ব্যাচ ৯৫%, ’৮২ নিয়মিত ব্যাচ ৯৬%, ’৮২ বিশেষ ব্যাচ ৯০% ও ’৮৪ ব্যাচ ৫২%। এতে দেখা যায়, যুগ্ম সচিব পদে সবচেয়ে কম পদোন্নতি পেয়েছেন ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা। অপরদিকে ১৯৮৫ ব্যাচের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা ২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ অক্টোবর উপ-সচিব হওয়ার তিন বছর পর ২০০৯ সালে এসে যুগ্ম সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু গত দু’বছরেও তারা পদোন্নতি পাননি। এরই মধ্যে ’৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তারাও যুগ্ম সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত ও নতুন করে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা গেলে ঢাউস উপ-সচিব পদসংখ্যার ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে। তা না হলে প্রশাসন ভারসাম্যহীন হয়ে আরও অচল ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে।
প্রশাসনে পদোন্নতির অপেক্ষায় দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তা : প্রশাসনে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেতে দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তা অপেক্ষায় রয়েছেন। ওপরের দিকে পদোন্নতি আটকে যাওয়ায় জুনিয়র কর্মকর্তারা পদোন্নতির জ্যামে আটকে পড়েছেন। এর ফলে প্রশাসনে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দেয়ায় তাদের বসানোর জায়গা পাচ্ছে না সরকার।
এদিকে সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও ’৮৪ ও ’৮৫ ব্যাচেরই প্রায় ৮০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ’৮৪ ব্যাচের ২২৩ আর ’৮৫ ব্যাচের রয়েছেন ৫৫০ জন। ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এরই মধ্যে চাকরিজীবনের ২৬ বছর পার করে দিয়েছেন তারা। তাদের চাকরির বয়স আছে গড়ে তিন থেকে পাঁচ বছর। এই সময়ের মধ্যে আর পদোন্নতি পাবেন বলে মনে করছেন না অনেকেই। ’৮৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তারা উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান ২০০৩ সাল থেকে। ২০০৫ সালের মধ্যে প্রায় সবার পদোন্নতি হয়ে যায়। এরপর এ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২২৭ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে পদোন্নতি পাওয়া এসব কর্মকর্তা এরই মধ্যে দুই বছর পার করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কেউই অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাননি। এ নিয়ে তাদের মধ্যেও চরম হতাশা বিরাজ করছে।

No comments:

Post a Comment