Tuesday 31 May 2011

ক্ষমতা তোষণে ‘স্বাধীন’ দুদক










অলিউল্লাহ নোমান

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন সরকারের ভিন্নমত হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও ক্ষমতাসীনদের তোষণ করাই যেন দুদকের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিনাটেন্ডারে কোটি কোটি টাকার কাজ বরাদ্দ দেয়া, সরকারি দলের লোকদের টেন্ডারবাজি, শেয়ারবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়া—কোনো কিছুই দুদকের নজরে নেই। এসব কিছু দুদক পর্যবেক্ষণও করছে না। দুদকের নজরে নেই সরকারি দলের সদস্যদের সন্দেহজনক সম্পদ। অপরদিকে সরকারের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের সন্দেহজনক সম্পদের খোঁজে দুদক ব্যস্ত রয়েছে। দুর্নীতির ছিটেফোঁটা অভিযোগ নেই এমন ব্যক্তিদেরও সম্পদের হিসাব চেয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বেনামি চিঠি আমলে নিয়ে, কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠির সূত্র ধরে সম্পদের হিসাব বিবরণী চাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। শুধু সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি নয়, হয়রানি করা হচ্ছে মামলা দিয়েও। ক্ষমতার তোষণ করতেই বা সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে এসব কাজ করছে ‘স্বাধীন’ দুদক।
খোদ দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দৈনিক আমার দেশকে বলেন, বিনাটেন্ডারে কোনো কাজ দেয়া হচ্ছে বা টেন্ডারে দুর্নীতি হচ্ছে এমন কোনো বিষয় দুদকের নজরে বা পর্যবেক্ষণে নেই। এ ধরনের কোনো অভিযোগও তাদের কাছে কেউ দায়ের করেনি। সরকারের কেউ কোনো দুর্নীতি করছে বলে দুদকের জানা নেই। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে দুদক বিবেচনা করে দেখবে বলে উল্লেখ করেন দুদক চেয়ারম্যান।
শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে দুদক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে কি-না জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আমার দেশকে জানান, শেয়ারবাজারের বিষয়টি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। এছাড়া তদন্ত কমিটির রিপোর্টও আনুষ্ঠানিকভাবে দুদকের কাছে সরকার পাঠায়নি। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, শুনেছি অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন মিডিয়ায় বক্তব্যে জানিয়েছেন দুদকের কাছে দুটি মামলা পাঠাবেন। এখনও পাঠাননি। দুদকের কাছে কোনো মামলা পাঠালে, তফসিলভুক্ত অপরাধ হলে অবশ্যই তদন্ত করা হবে। তবে এখনও এ ধরনের কোনো কিছু তাদের কাছে নেই বলে উল্লেখ করেন দুদক চেয়ারম্যান। এজন্য শেয়ারবাজার থেকে টাকা ওঠানোর বিষয়ে দুদকের আপাতত কিছু করণীয় নেই। সন্দেহজনক সম্পদের ধারণা থেকে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমতের লোকদের সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি বা মামলা দায়ের প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি কিছুটা ইতস্তত করে বলেন, সন্দেহজনক সম্পদের বিষয়ে দুদক কোনো চিঠি দেয় না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। সরকারি দলের অনেকের এবং এমনকি খোদ দুদকের অনেক কর্মকর্তা, যাদের সন্দেহজনক সম্পদ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি কিছুটা থমকে যান। একপর্যায়ে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সে যে-ই হোক দেখা যাবে।
গত সোমবার রাতে দুদক চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশ-এর বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন। এর আগে সোমবার বিকালে সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলে একান্ত সচিব মোখলেসুর রহমান জানান, স্যার অনেক ব্যস্ত। তখন অবশ্য এ প্রতিবেদকের উপস্থিতিতেই বিভিন্ন পেশার সাধারণ দর্শনার্থীকে দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে দেখা গেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক বসেও সাক্ষাতের অনুমতি না পেয়ে রাতে প্রথমে বাসার ল্যান্ডফোনে যোগাযোগ করা হয়। তখন বলা হয়, স্যার বাসায় নেই। একপর্যায়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তখন তিনি কথা বলেন।
এদিকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৭টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য বিনাটেন্ডারে দলীয় লোকদের বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব কুইক রেন্টাল বরাদ্দ পাওয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে উচ্চমূল্যে বিদ্যুত্ কেনার। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি কুইক রেন্টালও বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে পারেনি। বিনাটেন্ডার ও সরকারের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবে উচ্চমূল্যে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুত্ কেনার চুক্তির কারণে বছরে রাষ্ট্রের ৩ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগও ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে।
বিনাটেন্ডারে কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র ছাড়াও সরকারের অন্যান্য কাজের টেন্ডারেও রয়েছে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি। দলীয় লোকদের বিনাটেন্ডারে কাজ দিতে সরকার ক্রয়নীতিরও সংশোধন করেছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সংবাদ ছাপা হচ্ছে। অথচ দুদক চেয়ারম্যান বলছেন বিনাটেন্ডার বা টেন্ডারে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তাদের নজরে কিছু নেই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৮ এপ্রিল টেন্ডার নিয়ে শৈলকূপায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে। গত মার্চ মাসে বরিশাল সিটি করপোরেশনে টেন্ডারের আগেই ১১২ কোটি টাকার কাজ বরাদ্দ দেয়া হয় ঠিকাদারকে। ২০১০ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার নির্মাণকাজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিনাটেন্ডারে। গত বছরের ৮ এপ্রিল টেন্ডার দখল নিয়ে পঞ্চগড়ে যুবলীগের হাতে ছাত্রলীগকর্মী খুন হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শৈলকূপায় দরপত্র আহ্বানের আগেই রাস্তা পাকা করার কাজ শুরু হয়। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির খবর সরকার সমর্থক বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকেও ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।
দেশে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত টাকা পাচারের ঘটনা হচ্ছে শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে পাচার করেছে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মহল। ইতোমধ্যে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও সরকারি দলের অনেকের নাম উঠে এসেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, তারা বিরোধী দলের সদস্য বা সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যস্ত রয়েছেন। সরকারের দুর্নীতি ও অনিয়ম দেখার সময় এখন তাদের নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখন সরকার তোষণে ব্যস্ত আছি। কী করলে সরকার খুশি হবে, সেদিকেই কর্তাদের নজর। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি দলের নেতাদের দুর্নীতির মামলা হাইকোর্ট বিভাগে খারিজ হয়ে গেলে দুদক আপিল করে না। বিরোধী দলের কারও মামলা হাইকোর্ট বিভাগে খারিজ হলে সঙ্গে সঙ্গে আপিল করা হয়। এমনকি কারও জামিন হলে সেটা বাতিল করার জন্যও আপিল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সবাই।
ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়ে দুর্নীতি মামলা, ফ্রিগেট ক্রয়ে দুর্নীতি মামলা, নভোথিয়েটার নির্মাণে দুর্নীতি মামলাসহ ৯টি মামলা হাইকোর্ট বাতিল করার পর দুদক কোনোটির বিরুদ্ধে আপিল করেনি। একইভাবে সরকারি দলের নেতা গডফাদার হিসেবে খ্যাত নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, হাজী সেলিমসহ অনেকের দুর্নীতি মামলা সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে খারিজ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও দুদক কোনো আপিল করেনি। অপরদিকে বিরোধীদলীয় নেতার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানসহ বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সেনানিয়ন্ত্রিত জরুরি সরকারের দায়ের করা মামলা নিম্ন আদালতে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগও রয়েছে দুদকের।
ক্ষমতা তোষণে ব্যস্ত থাকার পরও সরকার আইন সংশোধন করে দুদকের হাত-পা বেঁধে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুমোদন ছাড়া দুদক সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারের কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না—এই আইন পাসের অপেক্ষায় রয়েছে জাতীয় সংসদে। দুদকের বিদ্যমান আইনে সংশোধনী এনে জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাব করেছে সরকার

No comments:

Post a Comment