Thursday 22 July 2010

আঙ্কটাডের বার্ষিক বিনিয়োগ রিপোর্ট প্রকাশ : বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৩৬ ভাগ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই পরিস্থিতি খুবই নাজুক। আগের বছরের তুলনায় ২০০৯ সালে দেশে এফডিআই কমে গেছে ৩৬ শতাংশ। গ্যাস-বিদ্যুত্সহ বিভিন্ন বাধার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড।
তবে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ বলেন, বিনিয়োগের জন্য গ্যাস, বিদ্যুত্ কোনো সমস্যা নয়। তিনি বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগের জন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে উদার পরিবেশ রয়েছে। গতকাল বিনিয়োগ বোর্ডের সম্মেলনকক্ষে বিনিয়োগ নিয়ে আঙ্কটাডের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। বিনিয়োগ বোর্ড এ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ বছরের রিপোর্টটির বিস্তারিত তুলে ধরে বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন। আঙ্কটাডের বিনিয়োগ রিপোর্ট এবং দেশের সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেন বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ। আরও বক্তব্য রাখেন বোর্ডের সদস্য আবু রেজা খান, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মীর্জা আবদুল জলিল, বিনিয়োগ বোর্ডের সচিব সুলতান মাহমুদ। উপস্থিত ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সাল থেকে আঙ্কটাডের পক্ষ থেকে প্রতিবছর বিনিয়োগ বিষয়ে রিপোর্টটি সারাবিশ্বে একযোগে প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট ইস্যুকে রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়। চলতি বছর রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ইনভেস্টিং ইন এ লো কার্বন ইকোনমি’। এটি আঙ্কটাডের ২০তম বিনিয়োগ রিপোর্ট।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ২০০৯ সালে এফডিআই এসেছে ৭০ কোটি ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এর আগের বছরে ছিল ১০৮ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে ছিল ৬৬ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ইক্যুইটি ক্যাপিটাল হিসেবে ২১ কোটি ৮৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার, পুনঃবিনিয়োগ ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণ ১১ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এর মধ্যে গত ২০০৮ সালের তুলনায় ইক্যুইটি ক্যাপিটাল ৭৩ শতাংশ কমেছে।
রিপোর্টে বলা হয়, আগের বছর বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টেলিকমিউনিকেশন খাতে বিনিয়োগ বড় ভূমিকা পালন করলেও এ বছর এই খাতে বিনিয়োগ ৬০ শতাংশের বেশি কমেছে। ২০০৮ সালে টেলিকম খাতে ৬৪ কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার হলেও ২০০৯ সালে এসেছে মাত্র ২৫ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। রিপোর্ট অনুযায়ী টেক্সটাইল ও ওয়্যারিং খাতে ১৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার, ব্যাংকিং খাতে ১৪ কোটি ২৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার, বিদ্যুত্, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামে ৫ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার ডলার, খাদ্যপণ্যে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার, কৃষি ও মত্স্য খাতে ১ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার, অন্যান্য খাতে ৮ কোটি ৩৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার এফডিআই এসেছে।
গতকাল প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৯ সালে সারাবিশ্বে বিনিয়োগের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেলেও ২০১০ সালের প্রথমদিকে এসে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। ২০০৯ সালে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ কমেছে ৪৩ শতাংশ। আর ২০১০ সালের প্রথম তিন মাসে সেটা ২০ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৮ সালে বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে ২০০৯ সালে এসে এফডিআই কমে যাওয়ার হার ৩৭ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এফডিআই কমেছে ৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে উন্নয়নশীল ও দুর্যোগপ্রবণ অর্থনীতিতে কমেছে ২৭ শতাংশ।
এবারের রিপোর্টে বিদেশি বিনিয়োগে শীর্ষে আছে ব্রিটেন। সেখানে এফডিআই’র পরিমাণ ৮ কোটি ৮০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে হংকং, তৃতীয় স্থানে মিসর ৭ কোটি ২৭ লাখ ১০ হাজার ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ৬ কোটি ৭০ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, আন্তঃমহাদেশীয় কোম্পানিগুলো (টিএনসি) একদিকে যেমন সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে তেমনি তারা কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিনিয়োগও করছে। এটা একদিকে সমস্যা অন্যদিকে সমাধানের মতো। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় উত্পাদন প্রত্রিক্রয়া, সরবরাহ ও অন্যান্য সেবাকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত করতে পারে।
আঙ্কটাড বলছে, গত বছরে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ৮২টি দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ১০৯টি নতুন দ্বৈতকর চুক্তি স্বাক্ষরসহ আরও ২০টি অন্যান্য চুক্তি হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ৪টি। কর ও বাণিজ্য বাধা সংত্রক্রান্ত ৩২টি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপুটসে (আইসিএসআইডি)।
অনুষ্ঠানে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হতে পারে। আমলাতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকারের কারণে প্রায় দুই বছর দেশে বিনিয়োগ আসেনি। এ ধরনের সরকারের সময় কেউ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের ধারা যদি ৫ বা ১০ বছর অব্যাহত থাকে তাহলে অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও এফডিআই প্রবৃদ্ধি দুটোই বাড়বে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশি বিনিয়োগও বাড়বে। অনির্বাচিত সরকার বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বেটার বিজনেস ফোরামসহ নানা কিছু করেছে। কিন্তু কোনোটাই সফল হয়নি।
বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিদেশি বিনিয়োগে বড় বাধা কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদ্যুত্, গ্যাস নিয়ে কোনো বিনিয়োগকারী আমার কাছে সমস্যার কথা উল্লেখ করেননি। তারা কেউই আমাকে বলেননি যে এটা সমস্যা। দেশের ভালো ভাবমর্যাদা, ভালো পরিবেশ, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুলতা কোনো সমস্যা নয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জিডিপি ১০০ বিলিয়ন হওয়া সম্ভব। বর্তমানে জিডিপিতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। এটাকে কম ও ধীর বলে অভিহিত করা যায়। আমরা এটাকে ১ থেকে ৪ শতাংশে উন্নীত করতে চাই। আমি বলছি ভালো, ভালো। কিন্তু যে বিনিয়োগ করবে সে যদি বিশ্বাস না করতে পারে তাহলে তো বিনিয়োগ আসবে না।
দেশে বিনিয়োগের জন্য অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ভালো ও উদার পরিবেশ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত দেশে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীর ক্ষতি হয়নি। কারও বিনিয়োগ বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। সব দেশ মন্দার কারণে বিপর্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি সুরক্ষিত রয়েছে। রফতানির কয়েকটি খাত ছাড়া আর কোনো খাতে মন্দার প্রভাব পড়েনি। তাই ২০১০ সালে বিদেশি বিনিয়োগসহ সব ধরনের বিনিয়োগ বাড়বে।
এসএ সামাদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গ্যাস-বিদ্যুতের কোনো সমস্যার কথা এ পর্যন্ত আমাকে বলেননি। তবে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কথা তারা বেশি বলেছেন। এটা আমাদের বড় দুর্বলতা। পদ্ধতিগত জটিলতা আরও সহজ করতে হবে। অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজও করা লাগে, যা দরকার নেই। তবে এখানে বিনিয়োগ বোর্ডের একা কিছু করার নেই। আমলাতন্ত্রের জটিলতার কারণেও বিনিয়োগকারীরা নিরুত্সাহিত হচ্ছে। আমরা ইচ্ছে করলে একটা ওয়ার্ক পারমিটও দিতে পারি না।
বিনিয়োগ বোর্ডের সদস্য আবু রেজা খান বলেন, বিদ্যুত্ ও গ্যাসের কারণেই বিদেশি বিনিয়োগ থমকে যাচ্ছে তা ঠিক নয়। আমরা অনেক প্রস্তাব পাচ্ছি। যেখানে জমি একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মজুরিসহ নানা কারণে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ভালো স্থান হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সবাইকে তো ইপিজেডে জায়গা দেয়া যাবে না। এজন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
এদিকে বিনিয়োগ বোর্ডের সচিব সুলতান মাহমুদ জানান, সর্বশেষ হিসাবে চলতি বছরে অর্থাত্ ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত ৬ মাসে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রকল্পের সংখ্যা ৭৮৪টি। টাকায় বিনিয়োগের পরিমাণ ১৭ হাজার ৫৭৮ কোটি ১০ লাখ ৮২ হাজার টাকা বা ২৫৩ কোটি ৪৮ লাখ ৬৭ হাজার ডলার। ২০০৯ সালে প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৯৫টি, ২০০৮ সালে ছিল ১ হাজার ৬১৩টি। যৌথ ও বিদেশি বিনিয়োগে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সংখ্যা ৯৩টি। ২০০৯ সালে ছিল ১২৯ এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৪৫টি। ২০১০ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ডলার, ২০০৯ সালে ছিল ৬৬ কোটি ৩৭ লাখ ৭২ হাজার ডলার, ২০০৮ সালে ছিল ২৫৬ কোটি ৬৯ লাখ ২৫ হাজার ডলার। মোট বিনিয়োগের দিক দিয়ে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ২৮৭ কোটি ৯৪ লাখ ৭৬ হাজার ডলার। ২০০৯ সালে তা ছিল ৩২৫ কোটি ২১ লাখ ৪২ হাজার ডলার, ২০০৮ সালে ছিল ৫৬৮ কোটি ৮০ লাখ ৮৯ হাজার ডলার। কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে ২০১০ সালে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৬২১ জন, ২০০৯ সালে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৭৮২ জন এবং ২০০৮ সালে ৯ লাখ ৯৩ হাজার ৮৮৩ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/23/35831

No comments:

Post a Comment