Saturday 24 July 2010

“বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট” শিরোনামের আন্তর্জাতিক বিবৃতি

আমিনুল মনসুর
‘দ্য কোয়ালিশন ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমক্রেসি ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংস্থার বিবৃতি গত কয়েকদিনে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে বহুল প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশ নামক দেশটাকে একসময় বেশিরভাগ পশ্চিমারা আলাদা করে চিনতেন না, বাংলাদেশীদেরকে মনে করতেন ‘ইনডিয়ান’, সে অবস্থা সম্ভবত আর থাকছে না। পত্রপত্রিকা আর সংবাদমাধ্যমগুলোর এমন অবদানের পর বাংলাদেশকে এখন থেকে অনেকে সহজেই চিনতে পারবেন। যেমনভাবে একজন সচেতন নাগরিকের জন্য সোমালিয়া, কঙ্গো কিংবা রোয়ান্ডা কে চেনা কঠিন না। ইদানিং অনেক রাজনীতি বিশ্লেষককে বলতে শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে ব্যার্থ রাষ্ট্র প্রতিপন্ন করার জন্য অনেকে ষড়যন্ত্র করছে। অন্যদিকে এ বিবৃতিটিতে যা বলা হয়েছে সে বাস্তবতাকেও সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এ ধারাবাহিকতায় বলতে হয়, ঐ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যদি সত্যি হয়ে থাকে তখন সেই ব্যার্থ রাষ্ট্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান থেকে যাচ্ছে ।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এ বিবৃতিটি আমেরিকার কংগ্রেস সদস্য এবং ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতি কোয়ালিশনটির আহবান। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং মানবাধিকার কর্মীদের এ সংগঠনটি কংগ্রেস এবং ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) কে বাংলাদেশে চলমান বিরোধীদলের উপর সরকারী নির্যাতন এবং যথেচ্ছ গ্রেফতারের প্রতিবাদ করতে আহবান জানিয়েছে। তারা উল্লেখ করেছে, মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ২০০৮ এর ডিসেম্বরে ক্ষমতায় এসেছে। এর আগে দু’বছর সামরিক শাসনের কবলে ছিলো বিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার দশ শতাংশ ধারণকারী এ দেশটি।

এখানে সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ বিবৃতিটির বাংলা অনুবাদ করা যাক। “কোয়ালিশন মনে করছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বাকস্বাধীনতা এবং ভিন্নমত পোষণের অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করছে। বিগত আঠারো মাসে বর্তমান সরকার পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল নিষিদ্ধ করার কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এর সাথে সাথে সরকারী দল স্বাধীন বিচার ব্যাবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং প্রচুর বিরোধী দলীয় নেতা ও ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করেছে। ২৯ জুন, ২০১০ তারিখে দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল এবং ডেপুটি সেক্রেটারী জেনারেলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইতোমধ্যেই এ গ্রেফতারকে অন্যায় ও অযৌক্তিক হিসেবে মতপ্রকাশ করেছে।
কোয়ালিশনের একজন সদস্য রেভারেন্ড গ্যারিল্যান্ড হেগলার বলেন ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্র এবং মুক্ত শাসনের অধিকার ও মুল্যবোধের প্রতি আমাদের সরকার দ্বিমত পোষণ করতে পারেনা। যদি এ স্বৈরশাসনকে সমর্থন করা হয়, তাহলে তা হবে আমেরিকান হিসেবে আমাদের গর্বিত ঐতিহ্য এবং বিশ্বনাগরিকের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। স্রষ্টায় বিশ্বাসী হিসেবে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখা আমাদের দায়িত্ব মনে করি।’

অন্যদিকে ‘আমেরিকান মুসলিম টাস্কফোর্স ফর সিভিল রাইটস এন্ড ইলেকশনস’ নামের জাতীয় সংগঠনটিও একই ইস্যুতে তাদের মত প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছে যে, সরকারী এই নিপীড়ন বাংলাদেশে আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্থ করবে। একই সাথে এর ফলে এ অঞ্চলে বিরাজমান অস্থিরতা মারাত্বক ভাবে বৃদ্ধি পাবে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী একজন বাংলাদেশী ভিন্নমতাবলম্বী, যিনি তাঁর পরিবারের উপর নির্যাতনের আশংকায় নাম প্রকাশ করতে চান নি, বলেন ‘এ সরকারের নিবর্তন নির্যাতনের নীতি কে যদি আমেরিকার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ সমর্থন করে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশী জনগণের বিশাল একটা অংশের গণতান্ত্রিক অধিকারের অবমাননাই হবে। এতে করে ভিন্নমতসহিষ্ণুতা, মতবৈচিত্র এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদলের ধারাই ব্যাহত হবে’।”

কোয়ালিশন নিজেদের কর্মকান্ডকে বাংলাদেশী জনগণের জন্য মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র বিকাশের চলমান কর্মসূচী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা জানিয়েছে যে, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো আমেরিকান জনগণ এবং সরকারকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রসঙ্গে যথার্থ নীতি গ্রহণে সচেতন করা। বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য তারা জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত সংস্থা ‘ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল’ এর প্রতিও আহবান জানিয়েছে।

একজন সচেতন বাংলাদেশীকে যে বিষয়টি চিন্তিত করবে তা হলো, উপরের এ বিবৃতিটি বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা এবং গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। সংবাদসংস্থা পিআরনিউজওয়ার এটি প্রচার করে। তাদের বরাত দিয়ে বিশ্ববিখ্যাত সংবাদসংস্থা ফর্বস, ফক্স বিজনেস এবং ইয়াহু নিউজ এটি হুবহু প্রচার করেছে। এ কয়েকদিনে দ্য ষ্ট্রিট, ইউএস পলিটিক্স, বষ্টন বিজ জার্ণাল, নিউজ ব্লেজ, সান হেরাল্ড, সেন্টার ডেইলী সহ বিভিন্ন আমেরিকান সংবাদ সংস্থার ওয়েব সাইটে বিবৃতিটি দেখা যাচ্ছে। শ্রমিক সমস্যা, দুর্নীতি, প্রাকৃতিক দুযোর্গ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এসব মিলিয়ে বারবার আমাদের প্রিয় দেশটির নেতিবাচক পরিচয় পাচ্ছে বিশ্ববাসী। এ পরিস্থিতিতে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারের উচিত, ভাবমুর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে ব্যাস্ত থাকার পরিবর্তে দেশে ন্যায় বিচার, আইনের শাসন এবং সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। সরকারী দলে থাকার কারণে আওয়ামী লীগের দায়ভারই সবচেয়ে বেশি, তারা এগিয়ে আসলে বিরোধী দলগুলোও গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে বাধ্য হবে। তখন আর বাংলাদেশী হিসেবে আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোতে দেশ নিয়ে এ ধরণের নেতিবাচক সংবাদ দেখে আমাদেরকে লজ্জিত হতে হবে না।

লেখকঃ গবেষক, ইমেইল, aminulmansur@yahoo.com

http://www.sonarbangladesh.com/articles/AminulMansur

No comments:

Post a Comment