Friday 30 July 2010

গার্মেন্ট শিল্পে ফের অস্থিরতা : পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে মহাখালী রণক্ষেত্র



স্টাফ রিপোর্টার |
নতুন মজুরি কাঠামোর প্রতিবাদে পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে গতকাল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মহাখালী, গুলশান ও বনানী এলাকা। শ্রমিকরা এই এলাকায় ৫ ঘণ্টা বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ ও ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ দফায় দফায় বেধড়ক লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরাও পুলিশের ওপর বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তারা নাসা গার্মেন্টসহ বিভিন্ন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে তৈরি পোশাক রাস্তায় এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া একটি গাড়িতে আগুন দেয়, অন্তত ১০টি বাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। শ্রমিকরা গুলশান, বনানী, মহাখালী ও তেজগাঁও এলাকায় ব্যাংক, শপিংমল, সরকারি-বেসরকারি ভবন, দোকাটপাট ও বিভিন্ন গার্মেন্ট ভবনে ভাংচুর করেছে। সংঘর্ষ চলাকালে ৪ ঘণ্টার বেশি সময় এসব এলাকার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ যানজট দেখা দেয় এবং মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও গুলশান থানায় ৪টি মামলা করা হয়েছে। এতে ২১ জন এজাহারভুক্ত আসামিসহ দেড় হাজার শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। এ খবরে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।



বিক্ষোভে অংশ নেয়া শ্রমিকদের দাবি ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা এবং আগস্ট মাস থেকেই সেটা কার্যকর করা। এই দাবিতে গতকাল সকাল থেকেই হাজার হাজার পুরুষ ও নারী শ্রমিক স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিক্ষোভে অংশ নেয়। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। মহাখালী, বনানী ও তেজগাঁও এলাকার গার্মেন্টগুলোতে তাত্ক্ষণিক ছুটি ঘোষণা করা হয়। পুলিশ ও সরকার সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনের একটি অংশ মাইকিং করে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে শ্রমিকদের প্রতিনিধি দল বিজিএমইএ ভবনে আলোচনার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে বলে উল্লেখ করে। শ্রমিকরা এসব অনুরোধ উপেক্ষা করে অবরোধ চালিয়ে যেতে থাকে এবং ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে স্লোগান দেয়। দুপুর ১২টার পরে পুলিশ লাঠিপেটা করে মগবাজার-মহাখালী, মহাখালী-গুলশান, বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন রাস্তা থেকে বিক্ষোভকারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়।
বিক্ষোভ-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিজিএমইএ ভবন ও আশপাশের এলাকা, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, বনানী, মহাখালী, গুলশান, রামপুরা, মিরপুর, পল্লবী, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জসহ গার্মেন্ট কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও যেসব এলাকায় গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিক রয়েছে, ওইসব এলাকায় পুলিশ ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে। অসন্তোষের আশঙ্কায় সাভারের আশুলিয়ায় অর্ধশতাধিক গার্মেন্ট দুপুরের পর ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বলেন, নতুন ঘোষিত মজুরি একটি শুভংকরের ফাঁকি। এখানে ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার নয়; বরং ২ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। বিষয়টির ব্যাখা দিয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সমন্বয়ক তাসলিমা খান বলেন, মজুরি বোর্ড মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে এই মজুরি ঘোষণা করেছে। এখানে মূল মজুরি ২ হাজার টাকা, বাসা ভাড়া ৮শ’ টাকা ও চিকিত্সা ভাতা ২শ’ টাকা ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা কেন, বাংলাদেশের শিল্প কারখানা অধ্যুষিত কোনো এলাকাতেই এক রুমের একটি বাসাও ৮শ’ টাকায় ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির দাবি মজুরি বোর্ডের নতুন এই ঘোষণা বিশ্বাসঘাতকতা, শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। ৮০ শতাংশ গড় বেতন বৃদ্ধির প্রচারণাকেও ভাঁওতাবাজি বলে মনে করছেন শ্রমিকরা।
পুলিশের দাবি, এই বিক্ষোভের পেছনে একটি মহলের ইন্ধন রয়েছে। বিক্ষোভের পর ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে তাত্ক্ষণিকভাবে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিএমপি কমিশনার একেএম শহীদুল হক খান বলেন, পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তিনি কোনো ষড়যন্ত্রে না জড়ানোর জন্য শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
গুলশান জোন পুলিশের সহকারী কমিশনার নুরুল আলম জানান, নতুন মজুরির বিষয়টি টেলিভিশন ও পত্রিকায় দেখেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে শ্রমিকরা। তারা সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে মহাখালী এবং গুলশান শুটিং কমপ্লেক্স পর্যন্ত এলাকায় খণ্ড খণ্ড মিছিল শুরু হয়। এর কিছুক্ষণ পরই শ্রমিকরা ভাংচুর ও হামলা চালায়। তাদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে বাধা দেয়া মাত্রই পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে মহাখালী-গুলশান সড়কের সরকারি তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আশপাশের অফিস ও দোকানে ইটপাটকেল ছুড়ে ভাংচুর চালায়। এ সময় রাস্তায় চলাচল করা যানবাহনেও তারা ভাংচুর শুরু করে। শ্রমিকরা লোহার রড, লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল দিয়ে বিভিন্ন ভবন ভাংচুর করে। শ্রমিকদের অবরোধের কারণে এই রাস্তায় কয়েক ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ শ্রমিকদের তাড়া দিয়ে লাঠিপেটা করে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। দুপুর ১২টার দিকে এই সড়কে আবার যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি ওমর ফারুক জানান, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা গুলশান লিংক রোডে একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে কিছু পোশাক এনে আগুন দেয়। এছাড়াও তারা পুরনো টায়ার রাস্তায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি এসে আগুন নেভায়। নাসা গার্মেন্টের এক কর্মকর্তা জানান, ডেলিভারি দেয়ার জন্য বেশকিছু পোশাক তৈরি করা ছিল। শ্রমিকরা দারোয়ানদের মারধর করে পোশাকগুলো রাস্তায় এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি আরও বলেন, পুলিশ কাছাকাছি থাকলেও পোশাকগুলো রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। পুলিশ সময়মত উদ্যোগ নিলে পোশাকগুলো রক্ষা করা সম্ভব হতো।
সকাল ১১টার দিকে গুলশান-১ থেকে ২ নম্বর পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে ভাংচুর করে। তারা সামনে যা পেয়েছে, তাই ভেঙেছে। এ সময় কয়েকটি দোকান লুট হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় গুলশান-১ নম্বরে নাভানা টাওয়ার, ওয়াশিংটন হোটেল, জব্বার টাওয়ার, উদয় টাওয়ার, বালিয়াড়ি ভবন, হাবিব মার্কেট, কামাল টাওয়ারসহ অর্ধশত মার্কেট ও ভবন ভাংচুর হয়। রড ও শাবল দিয়ে মার্কেটের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে শ্রমিকরা। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ চলাকালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। এ সময় সেখানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গুলশান-১ থেকে ২ নম্বর পর্যন্ত শত শত গাড়ি আটকা পড়ে। ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এ সময় কয়েকটি যানবাহনও ভাংচুর করে। নাভানা টাওয়ারের সামনে একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাস্তায় শ্রমিকরা টায়ার জ্বালিয়ে মিছিল করে। নাভানা টাওয়ারের নিচে একটি চশমার দোকানে ঢুকে ভাংচুর ও লুটপাটও করেছে তারা। এর কিছুক্ষণ পরই আগোরা চেইন শপিংমলে ঢুকে হামলা চালানো হয়।
আলী হোসেন নামে এক শ্রমিক বলেন, মালিকপক্ষ আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ন্যূনতম মজুরি যা নির্ধারণ করেছে তা আমরা নিরুপায় হয়ে মেনে নিয়েছি। কিন্তু তা আগামী মাস থেকে বাস্তবায়ন করলে শ্রমিকদের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হতো না। তারা নভেম্বর থেকে বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়া মানে আমাদের ৩ মাস পিছিয়ে দেয়া। সামনে রমজান মাস, ঈদ ও কোরবানিতে আগের বেতনেই আমাদের কাজ করতে হবে। এরপর দেখা যাবে নভেম্বর মাসেও ওই মজুরি বাস্তবায়ন হয়নি। সব মিলিয়ে এক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে মালিক ও সরকার। শাহআলম নামে এক শ্রমিক বলেন, আমরা পত্রিকা ও টেলিভিশনে খবর দেখেই বুঝতে পেরেছি আন্দোলন থেকে আমাদের দূরে রাখার জন্য আপাতত দায়সারাভাবে একটি বেতন কাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছে। ন্যূনতম বেতন ৩ হাজার টাকা হলেও আমরা মেনে নিতাম। কিন্তু তা না করে আমাদের মজুরি ধরা হয়েছে মাত্র ২ হাজার টাকা আর বাকি ১ হাজার টাকা বাসা ভাড়া ও চিকিত্সা খরচ। তিনি বলেন, এখন ঢাকায় রিকশা চালালেও এক বেলায় ৩শ’ টাকা রোজগার করা যায়। তারপরও এই মুহূর্তেই ঘোষিত কাঠামো বাস্তবায়ন করা হলে আমরা তা মেনে নিতাম। কিন্তু এই সামান্য বেতনও দেয়া হবে তিন মাস পরে। তিনি আরও বলেন, মালিক পক্ষ ও সরকার তাদের অবস্থানেই অনড় থাকলে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। অপর এক নারী শ্রমিক বলেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর আমাদের জন্য যে বেতন কাঠামো দেয়া হয়েছে তা নিয়েও এক ধরনের প্রহসন চলছে। এখন এর সমাধান না হলে ৩ মাস পর আবার আন্দোলন করতে হবে। দুটি ঈদে আমাদের আগের মতোই সেই ন্যূনতম মজুরি গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, আন্দোলন না করলে আমাদের কথা কেউ শোনেন না।
তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকায় ঢাকা ডাইং নামে একটি কারখানার শ্রমিক জুয়েল জানান, নতুন বেতনের কথা তিনি শুনেছেন, তার বেতন কত বাড়বে, আদৌ বাড়বে কিনা সেটা তিনি নিশ্চিত নন। তবে তার কয়েক সহকর্মী বলেছেন, এতে তাদের কোনো বেতন বাড়বে না।
তেজগাঁও শিল্প এলাকায় জেশন ওষুধ কারখানার শ্রমিক আবদুর রহমান বলেন, সকালে মহাখালী থেকে যখন আন্দোলন করে গার্মেন্ট শ্রমিকরা গুলশানের দিকে যাচ্ছিল, তখন আমরা কাজ বন্ধ করে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করি। তখন ভিতর থেকে আমাদের নিষেধ করা হয়। আমাদের বের হতে না দেয়ায় বাইরে থেকে এই ওষুধ কারখানায় হামলা চালিয়ে ভাংচুর করা হয়। এ সময় পাশেই নাসা গ্রুপের গুদামে হামলা চালায় শত শত শ্রমিক। তারা ভবনের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে ৮/১০টি গাড়ি ভাংচুর করে। ভিতর থেকে তৈরি পোশাক রাস্তায় এনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
দুপুর ১২টার পর থেকে পুলিশের ব্যাপক অ্যাকশনের মুখে মহাখালী, বনানী ও গুলশান এলাকার রাস্তা থেকে শ্রমিকরা সরে যায়। জুমার নামাজের সময় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে এবং রাস্তায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আড়াই ঘণ্টা পর সকাল ১১টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের রাস্তায় জড়ো হওয়া শ্রমিকদের আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন তেজগাঁও অঞ্চলের উপ-পুলিশ কমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির। মাইক দিয়ে শ্রমিকদের রাস্তা ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের নিয়ে আমরা বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষের কাছে যাব। তার আগে আপনারা রাস্তা ছেড়ে দিন।
শ্রমিকরা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মজুরি বোর্ডের কর্মকর্তা ও বিজিএমইএ নেতারা এসে ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ করে আগস্ট মাস থেকে এর বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেই তারা অবরোধ তুলে নেবেন। পরে পুলিশের ব্যাপক অ্যাকশনের মুখে দুপুর ১২টার দিকে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ সময় শ্রমিকরা বিপুলসংখ্যক ইট জোগাড় করে পুলিশের দিকে ছুড়তে থাকে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করে সরকার। জাতীয় শ্রমিক জোট, গার্মেন্ট শ্রমিক জোট এবং গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি, বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনসহ শ্রমিক ও গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন নতুন মজুরি কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার পর বিশৃঙ্খলা হতে পারে। তাই তিনি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার সংসদ সদস্যদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
শ্রমিক সংগঠনের নতুন মজুরি প্রত্যাখ্যান : ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণাকে শুভংকরের ফাঁকি ও প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোটের নেতা সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, গার্মেন্ট শ্রমিকরা তাদের মূল মজুরি ৫ হাজার টাকা ঘোষণার দাবিতে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে আসছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বর্তমান বাজারদর বিবেচনা না করে মজুরি বোর্ড মূল মজুরি ২ হাজার টাকা ঘোষণার সুপারিশ করে এবং মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের জন্য মূল মজুরি ২ হাজার টাকা ঘোষণা করেছে। এই টাকায় কোনো অবস্থাতেই একটি শ্রমিক পরিবারের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, চীন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ সব দেশেই ন্যূনতম মজুরি আমাদের নতুন ঘোষিত মজুরির চেয়ে দিগুণেরও অনেক বেশি। তাই তারা মূল মজুরি ৫ হাজার টাকা ঘোষণার দাবি জানান।
এই মজুরি কাঠামোকে মালিক তোষা হিসেবে আখ্যায়িত করে বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, এটি শুভংকরের ফাঁকি। তারা কোনোভাবেই এই নতুন মজুরি মেনে নেবেন না। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম বলেন, নতুন ঘোষিত মজুরি শ্রমিকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। এখানে ন্যূনতম মজুরির ঘোষণা ৩ হাজার টাকার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে মূল মজুরি ২ হাজার টাকা মাত্র। বাকি ৮শ’ টাকা বাসা ভাড়া ও ২শ’ টাকা চিকিত্সা খরচ। দেশের শিল্প কারখানা অধ্যুষিত কোনো এলাকাতেই এই দামে বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে না এবং এই টাকা দিয়ে একটি পরিবার কোনোভাবেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্য যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই মজুরি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (টাফ) সভাপতি ফয়জুল হাকিম নতুন মজুরি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ১৩শ’ ক্যালরি খাবার প্রয়োজন, যার জন্য ব্যয় হয় ৬০ টাকা। সেই হিসাবে চারজনের সংসারে মাসে ন্যূনতম ব্যয় ৭ হাজার ২শ’ টাকা। তার ওপর ঘর ভাড়া, চিকিত্সা , শিক্ষা ও বিনোদন ব্যয়। এসব কিছু অস্বীকার করে ৩ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/31/36803
-----------------------------------------------------------------------

তেজগাঁও, মহাখালী, গুলশানে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ
দোকান ব্যাংক গাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর


নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ৩১-০৭-২০১০



বিক্ষুব্ধ তৈরি পোশাকশ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করার একপর্যায়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন গলিতে পুলিশের লাঠিপেটা

ছবি: জিয়া ইসলাম

*

সরকারঘোষিত মজুরির প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার পোশাকশ্রমিকেরা রাজধানীর তেজগাঁও, মহাখালী, গুলশানসহ বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-ভাঙচুর করেছেন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে তিন ঘণ্টা ধরে তাঁরা বিক্ষোভের নামে বিপণিবিতান, ব্যাংক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় ২০০ স্থাপনা ও যানবাহন ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হন। এ ঘটনায় দুই থানায় মোট চারটি মামলা হয়েছে।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা ঘোষণা করে সরকার। শ্রমিকেরা পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরিসহ আগামী মাস থেকেই তা কার্যকর করার দাবিতে রাস্তায় নামেন।
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও শ্রমিকেরা জানান, পাঁচ-ছয় হাজার পোশাকশ্রমিক গতকাল সকালে কাজে যোগ না দিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় কারখানার সামনে জমায়েত হন। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে কয়েকটি কারখানা ও কারখানার সামনে রাখা যানবাহন ভাঙচুর করে তাঁরা। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কয়েক দিনের চলমান শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এ এলাকায় গতকাল বেশির ভাগ কারখানাই বন্ধ ছিল। কারখানার সামনে থেকে শ্রমিকদের ছোট ছোট জটলা সকাল সোয়া আটটা থেকে রাস্তায় এসে জড়ো হয়। সাড়ে আটটার দিকে তেজগাঁও এলাকায় শ্রমিকদের সংখ্যা কয়েক হাজার হয়। শ্রমিকেরা কারওয়ান বাজারসংলগ্ন এফডিসি ক্রসিং থেকে শুরু করে সাতরাস্তা-মহাখালী থেকে বনানী ক্রসিং, তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোড পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। তখন তেজগাঁও, বিমানবন্দর ও গুলশান সড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের সড়কগুলো ভয়াবহ যানজটের কবলে পড়ে। এফডিসি সিগন্যাল থেকে শুরু করে সাতরাস্তা, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে বনানী পর্যন্ত রাস্তা শ্রমিকেরা দখলে নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
সকালে ফাঁকা রাস্তায় শ্রমিকেরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু যানবাহন ভাঙচুর করেন। মহাখালী ক্রসিং পুরোপুরি দখলে নিয়ে টায়ারে আগুন লাগিয়ে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মহাখালী ও গুলশান এলাকায় শত শত শ্রমিক রাস্তায় নামেন। তাঁদের সঙ্গে তেজগাঁও এলাকারও কিছু শ্রমিকও যোগ দেন। হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। সকাল নয়টার দিকে তাঁরা মহাখালীর আমতলী থেকে গুলশান-১ হয়ে গুলশান-২ পর্যন্ত মিছিল করেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা দুই ঘণ্টা ধরে মহাখালী (আমতলী), ওয়্যারলেস গেট হয়ে গুলশান-১ ও ২-এর রাস্তার দুই ধারের দুই শতাধিক দোকান, ব্যাংক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, হোটেল, মার্কেট ও যানবাহনে ভাঙচুর চালান।
যেসব প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়: নাভানা শপিং কমপ্লেক্স, জারা মার্কেট, হাবিব সুপার মার্কেট, মলয় ক্যাপিটাল সেন্টার, ম্যাসিভ লাইটিং হাউস, সিমেন্স শোরুম, সেফরন, কাদেরিয়া টাওয়ার, অ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, স্যামসং শোরুম, ট্রাফেল রেস্টুরেন্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, স্যোশাল ইসলামিক ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক। এ ছাড়া চেকোস্লোভাকিয়া কাউন্সিলরের কার্যালয়, মেয়র ভবন, গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ার, কুমুদিনী ট্রাস্ট, শপার্স ওয়ার্ল্ড, সুপার শপ আগোরা, নাফি টাওয়ার, উদয় টাওয়ার, বেজ গ্যালারি, নাভানা ফার্নিচার, লোটাস কামাল টাওয়ার-২, সুবাস্তু ইমাম স্কয়ার, মলি টাওয়ার, আর এম সেন্টার, জব্বার টাওয়ার, হোটেল ওয়াশিংটন, রূপায়ণ সেন্টার, রয়্যাল থাই রেস্টুরেন্ট, আলমাস সুপার শপ, হোটেল ওয়াশিংটন, বাটারফ্লাই শোরুম, র‌্যাংগস মোটর, মিতসুবিশি মোটরস, জেসন ওষুধ কোম্পানি, অ্যারিস্টোক্র্যাট রেস্টুরেন্ট, বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে এ আর গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেডসহ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং তেজগাঁও লিংক রোডে নাসা গ্রুপ, এর ভেতর থাকা পাঁচটি প্রাইভেট কার ও পিকআপ ভাঙচুর করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু গুলশান এলাকায় দেড় শ বিপণিবিতান, ব্যাংক, হোটেল ও রেস্তোরাঁ ভাঙচুর করা হয়েছে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শ্রমিকেরা গুলশান-১-এর গোল চত্বরে রাস্তার দুই ধারে অতর্কিতে বিপণিবিতানে ভাঙচুর শুরু করেন। পুলিশ বাধা দিতে গেলে তাঁরা পুলিশের ওপর বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ সময় পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ রায়হানসহ পুলিশের ১০ সদস্য আহত হন। সেখানে একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন শ্রমিকেরা।
গুলশান-১-এর কাছে জারা মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী শিশির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মার্কেট ভাঙচুরের সময় হামলাকারীরা চিৎকার করে বলেন, ‘এরা ধনী, এদের জিনিসপত্র ক্ষতি হলে সরকারের কাছে খবর যাবে।’ ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, এই হামলার পেছনে কারও ইন্ধন রয়েছে।
গুলশান-১-এর গোল চত্বরে কর্তব্যরত টহল পুলিশের সহকারী কমিশনার আনিসুজ্জামান জানান, সকাল ১০টার পর প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক অতর্কিতে ব্যাংক, বিপণিবিতানে ভাঙচুর শুরু করে। বাধা দিতে গেলে তাঁরা পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর করেন। সকাল ১০টার দিকে তেজগাঁও এলাকায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা একত্র হয়ে মহাখালী আন্তজেলা বাসটার্মিনালের সামনে জড়ো হন। তাঁরা রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। যাত্রীবাহী বাস রক্ষায় পরিবহনশ্রমিকেরাও টার্মিনালের সামনে লাঠিসোঁটা নিয়ে নেমে পড়েন। পুলিশ কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বিচ্ছিন্নভাবে ও হাতমাইকে বারবার রাস্তা ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন। একপর্যায়ে রিকশায় মাইক লাগিয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির শ্রমিকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা আমার ভাই। আপনাদের দুঃখ আমি বুঝি। রাস্তা ছেড়ে দেন। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করব।’ শ্রমিকেরা তাঁর কথা না শুনে উল্টো স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় পুলিশ শ্রমিকদের ওপর লাঠিপেটা করে। শ্রমিকেরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে পাল্টা ঢিল ছোড়েন। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে এ অবস্থা চলার পর পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। শ্রমিকেরা রাস্তা ছেড়ে অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। দুপুর একটার দিকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যান চলাচল শুরু হয়।
গুলশানে ভাঙচুর হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকসহ প্রভৃতি।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, সকাল থেকে দু-তিন হাজার শ্রমিক বিক্ষোভ করেছেন। পুলিশ তাঁদের বারবার বুঝিয়েও রাস্তা থেকে সরাতে পারেনি। তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
গতকাল দুপুরে গিয়ে মহাখালী থেকে গুলশান-২ পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দু-একটি ছাড়া সব স্থাপনারই কাচ ভাঙা দেখা যায়। দুপুরে তেজগাঁও, মহাখালী, গুলশান এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় ঢিল, ভাঙা কাচের গুঁড়া আর গাছের ভাঙা ডাল পড়ে থাকতে দেখা যায়। আন্দোলনরত শ্রমিকেরা সড়ক বিভাজকের কাঁটাতারের বেড়ার খুঁটি ও গাছ উপড়ে ফেলেন।
জানা যায়, সকাল আটটা থেকে পাঁচ ঘণ্টা মহাখালী আন্তজেলা বাসটার্মিনাল থেকে কোনো বাস ঢাকার বাইরে ছেড়ে যায়নি। বাইরে থেকেও কোনো বাস আসেনি। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো বাসগুলো না ভাঙার জন্য অনুরোধ করেন পরিবহনশ্রমিকেরা। একপর্যায়ে বাসগুলোকে রক্ষায় পরিবহনকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন।
ভৈরব থেকে সকালে ঢাকায় এসেছেন চলনবিল পরিবহনের চালক বেলাল। রাস্তার পাশে রাখা বাসটি নিয়ে প্রতি মুহূর্ত তাঁর কেটেছে চরম উদ্বেগের মধ্যে। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা ছিলেন এ অবস্থায়। বেলাল বলেন, ‘আমি চিন্তা করতাছিলাম, আমার ভাড়া মারনের কাম নাই। গাড়ি নিয়া বাড়ি যাইতে পারলেই হয়।’
মহাখালীর জেমিনি গার্মেন্টসের পারভীন আক্তারের দাবি, সরকারঘোষিত তিন হাজার টাকায় তাঁর সংসার চলবে না। আর নভেম্বর থেকে মজুরি বাস্তবায়নের কথা বলে মালিকেরা ঈদ বোনাস না দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। এই মাস থেকেই মজুরি বাস্তবায়ন চান তাঁরা।
আরেক শ্রমিক লিয়াকত বলেন, ‘খাইতে লাগে এক হাজার টাকা, বাসা ভাড়া দেড় হাজার টাকা আর বাকি ৫০০ টাকা থিকা বাড়িতে পাডানো, কাপড়চোপড়, অন্যান্য খরচ ক্যামনে চলব।’
গতকাল ছিল ৩০তম বিসিএস পরীক্ষা। তেজগাঁও অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে আসা-যাওয়ার সময় যানবাহন না পেয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন। মহাখালী থেকে শত শত মানুষ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ফার্মগেটের দিকে রওনা হয়।
মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশের একটি ব্যাংকের এটিএম বুথে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সকাল নয়টার দিকে হাজার তিনেক শ্রমিক ফ্লাইওভারের নিচে সড়কে এসে জড়ো হন। তাঁরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা কিছু যানবাহন ভাঙচুর করেন। পরে পুলিশ এসে লাঠিপেটা করে তাঁদের সরিয়ে দেয়।
কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট জীবন কুমার রায় প্রথম আলোকে জানান, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে ৫০-৬০ জন করে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ফ্লাইওভারের নিচে জড়ো হন। এঁদের অধিকাংশই মহখালীর আমতলী হয়ে গুলশান-১-এর দিকে এবং বাকিরা বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার পোশাক কারখানা থেকে শ্রমিক নামিয়ে আনেন।
মামলা: গতকাল সন্ধ্যায় ভাঙচুরের ঘটনায় গুলশান-১-এর নাভানা শপিং কমপ্লেক্সের সাধারণ সম্পাদক বাদী হয়ে ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত সাত-আট শ পোশাকশ্রমিককে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করেছেন। এ মামলায় নাভানা টাওয়ারে আইল্যান্ডার নামের একটি চশমার দোকানে লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। এতে মোট আসামি দেড় থেকে দুই হাজার পোশাকশ্রমিক। চারটি মামলাতেই ১০ পোশাকশ্রমিক নেতাকে আসামি করা হয়েছে। তাঁরা হলেন মোশরেফা মিশু, বজলুর রশীদ ফিরোজ, মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, মন্টু ঘোষ, সুলতান বাহার, নাসিমা নাসরিন, কল্পনা আখতার, রুহুল আমিন, বাবুল আকতার ও আবুল হোসেন। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত শিল্পাঞ্চল থানায় দুজন ও গুলশান থানায় আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামালউদ্দিন বলেন, মামলায় বলা হয়, এজাহারভুক্ত আসামিরা অস্ত্রশস্ত্রে (দা, লাঠি, রড, ককটেল) সজ্জিত হয়ে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাংক, হোটেল, বিপণিবিতানে ভাঙচুর করেছেন। তাঁরা পুলিশের ওপর হামলা করেছেন এবং সরকারি কাজে বাধা দিয়েছেন।
পল্টনে বিক্ষোভ-সমাবেশ: ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে পল্টন ও প্রেসক্লাব এলাকায় গতকাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বিক্ষোভ ও সমাবেশে করেছেন পোশাকশ্রমিকেরা। এ সময় তেজগাঁওয়ে পোশাককর্মীদের ওপর পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা জানায় শ্রমিক সংগঠনগুলো।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, ট্রেড ইউনিয়ন সংহতি ও গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্যপরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে শ্রমিকেরা এই বিক্ষোভে অংশ নেন।
নাসিমা আকতার নামের এক পোশাকশ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকার দাবিতে আন্দোলন করছি। কিন্তু মজুরি নির্ধারণ করা হলো তিন হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ঢাকায় বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।’
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আকলিমা আকতার বলেন, তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হলেও এর মধ্যে অসংখ্য মারপ্যাঁচ আছে। কারণ শিক্ষানবিশ অবস্থায় একজন শ্রমিক আড়াই হাজার টাকা পাবেন। এখন তাঁকে টাকা কম দিতে হয়তো বছরের পর বছর শিক্ষানবিশ রাখা হবে।
তেজগাঁওয়ে আহত শ্রমিক বিবি আমেনা ও নাসরিন বেগম বলেন, ‘অপারেটর হিসেবে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করি। কিন্তু এখনো বেতন দুই হাজার ৭০০ টাকা। ন্যূনতম মজুরি কবে হবে, কবে পাওয়া যাবে, সেটি কেউ বলতে পারছে না।’

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-07-31/news/82786

No comments:

Post a Comment