Friday, 1 June 2012

Friday, 25 May, 2012 2:38:52 PM মানবতাবিরোধী অপরাধ: সাক্ষী নিয়ে পাল্টাপাল্টি বিতর্ক ফজলুল হক নিজস্ব প্রতিবেদক বার্তা২৪ ডটনেট http://www.barta24.net/?view=details&data=Cook&web=0&menu_id=64&news_id=47280#.T8DF6m1R5Ls.facebook
ঢাকা, ২৫মে: মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য যে সব সাক্ষী আনার কথা ছিল, তাদেরকে আনতে না পারায় প্রসিকিউটদের নিয়ে নানা যুক্তি-তর্ক সৃষ্টি হয়েছে বিশেজ্ঞদের মাঝে। বিশেষ করে জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশন। তবে নিজেদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা ঢাকতে তারা বিভিন্ন সময়ে নিচ্ছেন নানা কৌশল। আইন বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলক আ স ম রব, মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, ওয়ার ক্রাইমস্ ফ্যাক্টস্ ফাইন্ডিং কমিটির আহবায়ক ডা. এম এ হাসান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রধান শাহরিয়ার কবির প্রসিকিউশনের দক্ষতা ও সামর্থ্য নিয়ে যেসব প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেগুলো বাস্তব হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। সাঈদীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৬৮জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৮ জনের পর আর বাকি সাক্ষীদের হাজির করতে না পেরে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে আদালতে আবেদন এবং তা মঞ্জুর হওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে বলে তারা মনে করছেন। প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন, এই বিচারকে বিতর্কিত করতেই এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মতে, প্রসিকিউশন ও ট্রাইব্যুনালের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে জনগণের বহুল প্রত্যাশিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেমন বিতর্কিত হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলেও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আইনজীবীরাও বলেছেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী না আনতে পারলে প্রসিকিউশনের উচিত ছিল আদালতকে তা সাফ জানিয়ে দেয়া। কিন্তু সাক্ষী না এনে তদমত্ম কর্মকর্তার কাছে দেয়া বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে দেখানোর কারণে আসামীদের পক্ষেথেকে ও বিচার হোক যারা না চায় তাদের মতো বিরোধী শক্তি বিতর্কের সুযোগ পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। ‘সাঈদীর সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আমরা ন্যায়বিচার করবো না’ বলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দেয়া বক্তব্য নিয়েও ট্রাইব্যুনালে বাইরে এসে ডিফেন্সের পক্ষে থেকে ধূম্রজাল তৈরি করা হয়েছে। এই সব নিয়েও বিশিষ্টজনদের পক্ষ থেকে নানা মন্তব্য ও সমালোচনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বিরোধীদের পক্ষ থেকে। এছাড়া, প্রসিকিউশন প্রখ্যাত কলাম লেখক ও বিশিষ্ট জাদুশিল্পীর সাক্ষ্যর বিষয়ে বেঠিক পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন বলে তারা বলেন। বিশিষ্ট কলাম লেখক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির সাঈদীর মামলার সাক্ষী না হলেও প্রসিকিউশন তাকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করলে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে পারবেন না বলেও তাদের আবেদনে ট্রাইব্যুনালকে জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, “আমি কখনোই সাঈদীর মামলার সাক্ষী ছিলাম না, কিন্তু এ বিষয়ে প্রসিকিউটররা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একই ঘটনা ঘটেছে প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ ও অধ্যাপক জাফর ইকবালের ক্ষেত্রেও। কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা ছাড়াই প্রসিকিউশন তাদেরকে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর তালিকায় উপস্থাপন করে অনুপস্থিত দেখিয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রসিকিউশন সাঈদীর মামলায় অধ্যাপক জাফর ইকবালকে সাক্ষী করার জন্য বেশ কয়েক ধর্না দিলেও তিনি সাফ ‘না’ করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে জাফর ইকবাল বলেছেন, “আমি চাই আমার বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হোক, কিন্তু এ ঘটনায় সাঈদী জড়িত কিনা, তা না জেনে আমি কিভাবে সাক্ষ্য দেবো।” মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সহায়ক মঞ্চের অন্যতম উপদেষ্টা বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, “সাক্ষী আনতে অবশ্যই তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরদের আন্তরিক থাকা উচিত, পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্যকে সাক্ষ হিসেবে গ্রহণ করা আইনীভাবে যথার্থ নয়।” ‘আমরা বিচার করবো না’ - ট্রাইব্যুনালের এমন মন্তব্যকেও সৈয়দ আমিরুল ইসলাম অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেছেন, “পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে নেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন, মধ্যযুগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।” আর, ‘আমরা সুবিচার করবো না’ বলে মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষতা হারিয়েছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী। জয়নাল আবেদীন বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে সাক্ষীর নামে সরকারের মনগড়া কথাই লিখে দিয়েছেন। এখন সাক্ষী না পেয়ে এগুলোকেই সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করে একটি প্রহসনের বিচারের আয়োজন চলছে।” এ ধরনের তৎপরতা আইনের শাসনের জন্য শুভ নয় বলে মন্তব্য জয়ানাল আবেদীনের। কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বলেন, “আমরা বিচার করবো না- এ ধরনের বক্তব্য কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” তিনি বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে বলে এই বিচারের কর্তাব্যক্তিরাই এ ধরনের মন্তব্য করছেন।” তিনি আরো বলেন, “ভোটের রাজনীতিতে সুফল পেতেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে।” এ বিচারে সরকারের আন্তরিকতা নেই বলেও মন্তব্য করেছেন কাদের সিদ্দিকী। তার মতে, “সাক্ষীকে আদালতে না এনে পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্য জবানবন্দি হিসেবে নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম ঘটলো। এর ফলে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে বিতর্কের অস্ত্র তুলে দেয়া হলো।” ইতোমধ্যে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকেও কঠোর ভাষায় ১৫ জনের বক্তব্যকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটির তিন সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এমকে আনোয়ার সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের এসব আচরণকে জংলী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “পুলিশ কার কাছ থেকে কি বক্তব্য নিলো, সেটি যাচাই বাছাই বা জেরার সুযোগ না দিয়ে সরাসরি জবানবন্দি হিসেবে গ্রহণ করার নজির পৃথিবীর ইতিহাসের কোথাও নেই।” এ ধরনের বিচার মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম বলেছেন, “আমরা বিচার করবো না, ট্রাইব্যুনালের এ ধরনের উক্তি হলো বর্বর উক্তি।” তিনি বলেন, “এর ফলে স্পষ্ট হয়ে গেছে, তারা ন্যায়বিচার করবেন না।” জানা গেছে, মাওলানা সাঈদীর সাক্ষ্য আনা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রসিকিউটররা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সাক্ষী না আনতে পারার পেছনে পাঁচটি কারণ তারা চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে বড় একটি কারণ হলো, তদন্ত কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা। কারণ ৪১ বছর আগের ঘটনাগুলোর সাথে তারা গ্রেফতারকৃত রাজনৈতিক নেতাদের কোনো সম্পৃক্ততা যথার্থভাবে দেখাতে পারছেন না। এজন্য, সংশ্লিষ্ট সাক্ষীও তারা আনতে পারছেন না। সূত্রটি আরো জানিয়েছে, সাঈদীর সাক্ষী আনতে না পারার অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে বেশ কিছু কৌশল তারা হাতে নিয়েছেন। তবে ডিফেন্স টিমের দাবি হচ্ছে, সাঈদীর মামলার মতো অন্য অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্যকেই তারা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন। আর সাঈদীর মাধ্যমেই তা জায়েজ করে পরবর্তীদের জন্যও একই আবেদন করার মাধ্যমে প্রসিকিউটররা আরো বেশি সমালোচনায় পড়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি ও জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযম, বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রস্তুতি চলছে বলে আসামিপক্ষের দাবি। এক্ষেত্রে বিশেষ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মতিউর রহমান নিজামীর নিজামীর নির্বাচনী এলাকায় সাক্ষীদেরকে হুমকি দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটররা। তবে যাদেরকে প্রাথমিকভাবে সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করার চিন্তা করেছিল প্রসিকিউশন, তারাও কোনো ধরনের সহযোগিতা করছে না বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রের দাবি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম নেতা শাহরিয়ার কবির বার্তা২৪ ডটনেটের সঙ্গে আলাপ কালে প্রসিকিউশনের এসব তৎপরতায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, “আমি পরিষ্কার করে প্রসিকিউশন ও তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি যে একজনের বিষয়ে সাক্ষী দেব ট্রাইব্যুনালে এবং সেটি আপনাকেও বলেছি।” এ সময় তিনি বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক প্রত্যেকের এলাকাতেই অনেক সাক্ষী পাওয়া যাবে। তারা তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে সাক্ষী হিসেবে অনেককেই আনবেন বলে আমার ধারণা। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রকৃত ভিকটিম রয়েছেন।” এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে আটক জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৫ সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার আদেশর পর ডিফেন্সের রিভিয়ু আবেদন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ও আসামি পক্ষ পাল্টা-পাল্টি যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেছেন। বার্তা২৪ ডটনেট/এফএইচ/জিসা

Sunday, 1 January 2012

ইশতেহারের সিকিভাগও বাস্তবায়ন হয়নি










এমরান হোসাইন
ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। পাঁচ বছর মেয়াদি সরকারের ৩ বছরে নির্বাচনী ইশতেহারের সিকিভাগও বাস্তবায়ন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানো, পদ্মা সেতু নির্মাণ, রাজধানীর যানজট নিরসন, দুর্নীতি রোধ, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত, প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত, পুঁজিবাজারের বিকাশ, প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ শত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিলেও তিন বছরের মধ্যে এগুলো পূরণ হয়নি। রংপুরকে বিভাগ করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ, জাতীয় শিক্ষানীতি ও নারীনীতি প্রণয়নসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হলেও এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের তীব্র আপত্তি রয়েছে। সরকারের বাকি দু’বছরে এসব প্রতিশ্রুতি পূরণ নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণসহ কিছু কিছু প্রকল্পের নাম উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা জানিয়ে দিয়েছেন, তারা শুরু করতে পারলেও সরকারের চলতি মেয়াদে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারবেন না। এদিকে নির্বাচনের আগে জনগণকে দেয়া এসব ওয়াদা পূরণে সরকারের নজর না থাকলেও সরকারদলীয়দের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও বিরোধী দলের প্রতি নিপীড়নমূলক অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়েছে অনেকটা তড়িঘড়ি করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্ষমতার মেয়াদ হলেও এই সরকার তার ইশতেহারের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার শেরাটন হোটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘দিনবদলের সনদ’ নামে ২৪ পৃষ্ঠার একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ইশতেহারের লিখিত প্রতিশ্রুতির বাইরেও নির্বাচনী বক্তৃতায় জনগণকে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো, কৃষকদের বিনামূল্যে সার প্রদানসহ বেশকিছু বিষয়ে ওয়াদা দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ক্ষমতার আসার পর সরকার এসব মৌখিক ওয়াদা অস্বীকার করার পাশাপাশি ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বিষয়েও কোনো অগ্রগতি নেই।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে। ইশতেহারের অগ্রাধিকারের ৫টি বিষয়ের প্রথমটিতে বলা হয়—চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। প্রধান এই প্রতিশ্রুতি পূরণেও তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম কমানো তো দূরের কথা, এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ব্যর্থ হয়েছে। গত তিন বছরে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। জিনিসপত্রের দামের জন্য জনগণের দুর্ভোগের কথা সম্প্রতি স্বীকার করেছেন সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান। দফতর বদলে বেসরকারি বিমান চলাচলমন্ত্রী হওয়ার পর আগের দায়িত্ব পালনে নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি অকপটে স্বীকার করেন, তার অনেক ক্ষেত্রে সফলতা থাকলেও দ্রব্যমূল্যের জন্য দেশের মানুষ কষ্ট পেয়েছেন।
সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় মোটা চালের কেজিপ্রতি মূল্য ২৫ থেকে ২৭ টাকার মধ্যে থাকলেও বর্তমানে এর দাম ৩৫ থেকে ৩৭ টাকার মধ্যে। ওই সময়ে নাজিরশাইল চালের দাম ৪০ থেকে ৪২ টাকা থাকলেও বর্তমানে এর বাজারদর ৫৪ থেকে ৫৭ টাকা। ২৩ টাকা কেজির আটা এখন ৩০ টাকা। ৩০ টাকা কেজির চিনি হয়েছে ৬৫ টাকা। ৯০ টাকা দরের সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে ১৩৫ টাকা। অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও সমহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে ইশতেহারে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ‘জড়িত’ সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরকার এক্ষেত্রে কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বরং তথাকথিত ওই সিন্ডিকেট এখন খোলস পাল্টে সরকারের ছত্রছায়ায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সড়ক, রেল, নৌ, বিমান পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী সেতু, টানেল নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪ লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রেলপথ সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত এর কিছুই হয়নি। ক্ষমতা গ্রহণের পর পদ্মা সেতুকে সরকার তার প্রধান অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প উল্লেখ করে কার্যক্রম শুরু করে। গত তিন বছরে এর পেছনে সরকারের খরচও হয় প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু সেতুর দরপত্র প্রক্রিয়াকালে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এ সেতু নির্মাণে ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ঋণ স্থগিত করে। বিশ্বব্যাংকের দেখাদেখি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাইকাও ঋণ সহায়তা বন্ধ রেখেছে। দুর্নীতির কারণে যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে এ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়েও দেয়া হয়। বর্তমানে এ সরকারের মেয়াদে পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নিলেও ৩ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ১৯ মাসে কাজ হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। বাকি ১৭ মাসে এ কাজ শেষ করা সম্ভব নয় বলে খোদ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। এ প্রকল্পের বিষয়ে নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে তারা মাত্র ৪২ কিলোমিটার অংশ দৃশ্যমান করতে পারবেন। উল্লেখ্য, সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৮০ কিলোমিটার।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে ডজনখানেক প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। ইশতেহারে ঢাকায় পাতাল রেল/মনোরেল, সার্কুলার রেলপথ এবং এলিভেটেড (উড়াল সড়ক) রাস্তা নির্মাণ করে গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, ঢাকার চতুর্দিকে বৃত্তাকার (অরবিটাল) জলপথ, বেড়িবাঁধ, সড়ক, রেলপথ নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ বছরের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও এখন পর্যন্ত এ কাজের অগ্রগতি কেবল ওই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনই! এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে টেন্ডারের দেন-দরবারের ক্ষেত্রে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। মেট্রোরেল স্থাপন প্রকল্পটি আটকে গেছে এর রুট ঠিক করার মধ্যে। এর রুট নিয়ে বিমানবাহিনী, সংসদ ভবন কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে।
মহাজোট সরকার তার বিদ্যুত্ খাতে সবচেয়ে সফল বলে দাবি করলেও তিন বছরে তার প্রতিশ্রুতির অর্ধেক বিদ্যুত্ও উত্পাদন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১১ সাল নাগাদ ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এ সময়ে তারা আড়াই হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পেরেছে বলে দাবি করছে। তবে এ সময় অনেক পুরনো বিদ্যুেকন্দ্রে উত্পাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
এদিকে সফলতার (সরকারের দাবি মতে) এ বিদ্যুত্ খাত এখন সরকারের গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধছে। বিনা টেন্ডারের সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল উচ্চমূল্যে বিদ্যুত্ ক্রয় করতে গিয়ে সরকারকে বড় অংকের ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। সরকারি তথ্যমতে, জ্বালানিভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র হতে বিদ্যুত্ ক্রয়ের জন্য চলতি অর্থবছরের প্রথম দু’মাসে (জুলাই-আগস্ট) ১ হাজার ২৩৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু বিদ্যুত্ খাতেই সরকারকে বছরে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। তেল ও গ্যাস খাত মিলিয়ে এ ভর্তুকি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে। সরকারের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে মাশুল দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুত্ খাতের দুর্নীতি থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের রেহাই দিতে সরকার এ সংক্রান্ত একটি ইনডেমনিটি বিলও সংসদে পাস করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েক দফায় প্রতিটি জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩ দফায়। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় দু’দফায় আর সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও মহাজোট সরকার গত ৬ মাসে তিন দফায় তেলের দাম বাড়িয়েছে। ইশতেহারে আওয়ামী লীগ জাতীয় কয়লানীতি প্রণয়ন করার কথা বললেও এখনও পর্যন্ত তা হয়নি।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ঘোষিত ১৪ দলের ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি এবং ২২ নভেম্বর গৃহীত ২৩ দফা অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির আলোকে এবং বিগত ৭ বছরের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে এই কর্মসূচি (ইশতেহার) প্রণীত হয়েছে। ১৪ দলের ৩১ দফা ও ২৩ দফার প্রধান দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে প্রণীত এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ওপর ভর করে দেশের জনমত উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এই সরকার। এমনকি সরকারের শরিকদের অনেকেই এ ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে ছিলেন। হাইকোর্ট আগামী দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার প্রতি মত দিলেও সরকার তা গ্রহণ করেনি। এ ক্ষেত্রে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের সময়টাও দেয়নি সরকার।
আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে অগ্রাধিকারের ২নং ধারায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করার কথা বললেও এ সরকারের হাতেই এর স্বাধীনতা খর্ব হতে চলেছে। সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদে যে বিল উত্থাপন করেছে তাতে কমিশনের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, দুদক নখরবিহীন বাঘে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো ভূমিকা রাখতে না পারলেও বিরোধী মতের হয়রানিতে সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘স্বাধীন’ এ কমিশন। আসল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারলেও বিরোধীদলীয় মতের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির নামগন্ধ পেলেই তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইশতেহারের অগ্রাধিকারের ৫নং ধারায় বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে নামকাওয়াস্তে মানবাধিকার কমিশন গঠন ছাড়া আর কোনো কিছুই করতে পারেনি সরকার। মানবাধিকার কমিশন গঠন হলেও এ প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে এর কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা তো দূরের কথা, বিচার বিভাগ দলীয়করণে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের পরিবর্তে এটা আরও বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে নতুন সংস্করণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে গুপ্তহত্যা। ন্যায়পাল নিয়োগ তো হয়ইনি, বরং বিগত চারদলীয় জোট সরকার যে কর ন্যায়পাল নিয়োগ দিয়েছিল এ সরকার তা বাতিল করেছে।
ইশতেহারে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকারের কার্যক্রমে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশন থেকে একটি সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে প্রস্তাবাকারে জমা দিলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বললেও মহাজোট সরকার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। সংসদ কার্যকর হওয়ার পরিবর্তে এটা পরিণত হয়েছে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও সরকারি দলের স্তুতিবন্ধনের কেন্দ্রস্থলে। বিরোধী দলকে সংসদে আনার ব্যাপারে সরকারের কোনো কার্যকর তত্পরতা নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেয়ার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে বিশেষ কমিটিতে এ ধরনের প্রস্তাব এলেও অজ্ঞাত কারণে তা গৃহীত হয়নি। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত তথা সংসদে প্রত্যক্ষ ভোটে নারীর জন্য ১০০ আসন সংরক্ষিত করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বিগত জোট সরকার সংরক্ষিত যে ৪৫টি আসন করেছিল তার থেকে মাত্র ৫টি বাড়িয়ে ৫০টি করেছে এই সরকার। আর এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভোটের প্রতিশ্রুতি থাকলেও এ সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উত্স প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও গত ৩ বছরে একবারও সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তবে নানামুখী চাপে সম্প্রতি মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা ও চরম দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৫ ও ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও তিন বছরে এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো অর্জন সরকারের নেই। বেকারত্ব বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪ কোটি লোক বেকার বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
ইশতেহারে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলার কথা বলা হলেও ঘটেছে উল্টোটা। বিরোধী দল থেকে কোনো কর্মসূচি দেয়া হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে হরহামেশাই। বিরোধী দল দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকার দলীয় ক্যাডারদেরও মাঠে দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে সরকারি দলের কর্মসূচি চলছে পুলিশি প্রটেকশনে।
ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকারে গিয়ে তা বেমালুম ভুলে গেছে। গত তিন বছর প্রশাসনে চলেছে নগ্ন দলীয়করণ। মেধা যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে হয়েছে পদোন্নতি ও বদলি। অপরদিকে সরকার দলের আনুগত্যে বিশ্বাসী নয়, এমন অজুহাতে অনেক মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাকে দিনের পর দিন ওএসডি করে রেখেছে। কাউকে কাউকে দেয়া হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর। ইশতেহারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করার কথা বলা হলেও তিন বছরে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা বলা হলেও দেশের খাদ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে। গত তিন বছরে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে সরকারকে।
নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ ও পানিসম্পদ রক্ষায় কার্যকর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকার নিজের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দিয়েছে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও করতে পারেনি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশের প্রাপ্যতা, হিস্যা ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান পানি সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ একটি সমন্বিত পানিনীতি প্রণয়ন এবং আঞ্চলিক পানি নিরাপত্তা গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিলেও, এ বিষয়ে ৩ বছরে সরকারের কোনোই উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়নি।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেও এটা নিয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর তীব্র আপত্তি। ইশতেহারে এক বছরের মধ্যে (২০১০ সালের মধ্যে) প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তি ১শ’ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হলেও ৩ বছরে তা করতে পারেনি এ সরকার। শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। গত ৩ বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলেছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের দখলের মহোত্সব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে হয়েছে চরম দলীয়করণ। শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন কাঠামো ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন এবং স্বতন্ত্র কর্মকমিশন গঠনের কথা বলা হলেও ৩ বছর ধরে সরকার এটা নিয়ে কেবল ঘোষণার মধ্যে রয়েছে। স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার প্রতিশ্রুতিও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। রাজধানী ঢাকার প্রতি থানায় সরকারি মাধ্যমিক হাইস্কুল ও প্রতি উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুুতিও পূরণ করতে পারেনি সরকার।
ইশতেহারে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি নবায়ন, ওষুধনীতি যুগোপযোগী ও প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়নের কথা থাকলেও তা হয়নি। প্রতিশ্রুতি অনুসারে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক প্রণীত নারীনীতি পুনর্বহাল করা হলেও এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের তীব্র আপত্তি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বড় ধরনের ফাঁক রয়েছে। ইশতেহারের পরিশিষ্ট অংশে রূপকল্প (ভিশন) অনুযায়ী বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে যে ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অনেকটাই প্রতারণার শামিল। আওয়ামী লীগ যে ২৩টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার মধ্যে মাত্র ৭টি সরকারের মেয়াদে অর্থাত্ ২০১৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা হলেও ইশতেহারে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই এই সরকারের মেয়াদের পরে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২১ সাল পর্যন্ত, যা বাস্তবায়নে আরও দুটি সরকারের প্রয়োজন হবে। তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রদান, রংপুরকে বিভাগে উন্নীতকরণ ও বিগত আওয়ামী লীগ আমলের কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরায় চালু করেছে।

Saturday, 31 December 2011

বাঁকা চোখে : বোবাদের নিয়ে ড. কামালের মহাচিন্তা














স্টাফ রিপোর্টার
ড. কামাল হোসেন মনে করেন বর্তমান সংসদ একটি বোবা সংসদ। সংসদের সব এমপিও বোবা। এই বোবা সংসদ ও এমপিদের নিয়েই তার যত দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তা আর আক্ষেপের কথা প্রকাশ করে গণফোরাম সভাপতি এই আইনজীবী বলেছেন, সারাদেশের ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত তিনশ’ সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হলেও এখানে মূলত একজনের (প্রধানমন্ত্রী) ইচ্ছা-অনিচ্ছা আর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। সংসদ নেতা বা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে—এ ভয়ে অন্যান্য সদস্য কথাই বলেন না। তিনি বলেন, সংসদে তিনশ’ লোক বোবার মতো বসে থাকে। কাজেই এটি একটি বোবা সংসদ। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ৪ মিনিটে ঢাকা ভাগ বিল পাস ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয় এই সংসদে। দেশের শেয়ারবাজার থেকে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা দেশের মানুষ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে নাকাল ব্যবসায়ীরা অথচ বোবা সংসদ সদস্যরা এ নিয়ে সংসদে টুঁ শব্দটিও করেন না। গত ১০ ডিসেম্বর গণফোরামের কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে এমন উপলব্ধির কথাই বর্ণনা করেন প্রবীণ এই আইনজ্ঞ।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনীতিবিদদের উপস্থিতিতে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এমপিদের উদ্দেশে আরও বলেন, মাত্র ৪ মিনিটে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহর দুই ভাগ করার বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়ে গেল। নজিরবিহীন এ ঘটনার সময় আপনারা সবাই চুপ করে বসে থাকলেন। কেউ মুখ খুলে পক্ষে কিংবা বিপক্ষে একটি যুক্তিও দেয়ার সাহস পেলেন না। লাখ লাখ যুবকের সর্বনাশ করে শেয়ারবাজারের মুলধন লুট হয়ে গেল অথচ আপনারা সাহস করে কেউ একটি কথাও বললেন না। আপনারা সবাই বোবা হয়ে বসে থাকলেন অথচ মহান আল্লাহতায়ালা চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য, কান দিয়েছেন শোনার জন্য আর মুখ দিয়েছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। আপনারা সংসদে কিছুই বললেন না। তিনি এমপিদের উদ্দেশে প্রশ্ন করে বলেন, আল্লাহ কি আপনাদের বোবা করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন?
জাতীয় সংসদ নিয়ে খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের এই মন্তব্যের আগেও সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারপতি বোবা সংসদের বিষয়ে বলেছেন, জাতীয় সংসদে এমপিদের দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা। অথচ জাতীয় সংসদে যারা যাচ্ছেন, তারা আইন সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা ছাড়া আর কিছুই জানেন না। আইন মন্ত্রণালয় থেকে কেরানিরা যে ড্রাফট করে দেন, জাতীয় সংসদে এমপিরা তা টেবিল চাপড়ে হো হো করে পাস করে দেন। উত্থাপিত আইনের খসড়া জাতির কতটুকু উপকারে আসবে এটা দেখা বা ভাবার সময় তারা পান না।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2011/12/17/122523

Friday, 9 December 2011

র্যাব পুলিশের নামে গুম ব্যক্তিদের খোঁজ মেলেনি


আলাউদ্দিন আরিফ

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে গুম অব্যাহতভাবে বেড়েই চলছে। চলতি বছরের শেষ দিনগুলোতে কমপক্ষে ১০০ ব্যক্তি গুম হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অপহরণ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের কিছু ক্ষেত্রে লাশ উদ্ধার হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে খোঁজই মিলছে না। এ পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে গুম ও অপহরণ আতঙ্ক। প্রশ্ন উঠেছে এরপর টার্গেট কে? ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা বলছেন, আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এ সময়েও গুম হয়ে যাওয়া এসব মানুষের স্বজনরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন প্রিয়জনদের সন্ধানে। আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর অফিস, মানবাধিকার সংস্থার অফিস, রাজনৈতিক নেতার দফতর, পত্রিকার অফিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে ধর্না দিয়েও স্বজনের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তারা। জানতে পারছেন না তাদের স্বজন বেঁচে আছে না মরে গেছে। গুম হওয়া ব্যক্তিরা জীবিত না থাকলে তাদের অন্তত লাশ ফেরত চাইছেন তারা সংবাদ সম্মেলন করে। সে অধিকারটুকু থেকেও তারা আজ বঞ্চিত।
বিশিষ্টজনরা বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মানবাধিকার উঠে গেছে আমাদের দেশ থেকে। মানুষের বেঁচে থাকারও অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধসহ নানা নামে চলছে মানুষ হত্যা। র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও গুম হওয়া ব্যক্তির হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দেশে মানবাধিকারের বাণী এখন নিভৃতে কাঁদছে।
জানা গেছে, ২৬ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত এক মাসেরও কম সময় শুধু মতিঝিল থেকেই ৭ জন গুম হওয়ার বিষয়ে মামলা ও জিডি হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬ জনের নাম জানা গেছে। এরা হলেন, ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগ নেতা সারোয়ার জাহান বাবুল, ভোলার দিদার, বাহার ও জসিম, রামপুরার আরিফ ও মতিঝিলের জুয়েল। র্যাব পরিচয়ধারীদের হাতে গত ২৮ অক্টোবর হাতিরপুল থেকে গুম হয়েছেন ঢাকা বিশ্বদ্যািলয়ের ছাত্র শামীম হাসান সোহেল, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি নূর মোহাম্মদ হাজী ওরফে নুরু হাজী, তার জামাতা আবদুল মান্নান ও জামাতার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ইকবাল। নুরু হাজী গুম হওয়ার দেড় মাসের মাথায় গুম হয়েছেন মান্নান ও ইকবাল। কোরবানীর ঈদের পরদিন সূত্রাপুর থেকে গুম হয়েছেন ব্যবসায়ী মমিন হোসেন। গুম হয়েছেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম, বরিশালের উজিরপুরের বিএনপি নেতা ও ঢাকার ব্যবসায়ী হুমায়ন খান। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত কয়েক মাসে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়দানকারীদের হাতে গুম হয়েছেন। র্যাব পুলিশ রহস্যজনক কারণে এসব গুমের মামলা তদন্ত করছে না। তাদের পরিবারের লোকজনও জানতে পারছে না যে তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে।
গত ২৮ নভেম্বর গুম হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ছাত্র ও ছাত্রদল নেতা শামীম হাসান সোহেল। গুম হওয়ার ১২ দিন পরও তার সন্ধান মেলেনি। সোহেলের মা, ভাইসহ আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয় দিয়ে তাকে ধরে নেয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সোহেলের ভাই সাইমুন ইসলাম জানান, গত ২৮ নভেম্বর রাত ১০টায় সোহেলের সঙ্গে সর্বশেষ তার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। ওই সময় সোহেল জানায় সে শাহবাগে আছে। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ২৮ নভেম্বর রাত ১২টার দিকে হাতিরপুল এলাকা থেকে সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যরা সোহেলকে তুলে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে আরও চারজনকে তুলে নিয়ে যায় তারা। সোহেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরে ২০০০-০১ সেশনে অনার্সে ভর্তি হন। ২০০৮ সালে অনার্স পাস করেন তিনি। বর্তমানে তিনি ওই ইনস্টিটিউটের মাস্টার্সের ছাত্র। ছাত্রদলের সূর্যসেন হল শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সোহেল। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানার পাঁচজুনিয়া গ্রামে। সোহেলের নিখোঁজের ঘটনায় ৩ ডিসেম্বর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে করেছে তার পরিবার। র্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সোহেলকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
থানায় করা সাধারণ ডায়েরির সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ অক্টোবর র্যাব পরিচয়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ হাজী ওরফে নূরু হাজী (৭৫)। হাজীর মেয়ে স্বপ্নার করা জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে গত ১৮ অক্টোবর রাত একটার দিকে সাদা পোশাকে ২০-২৫ জন যুবক সাভারের কাতলাপুর পালপাড়ার বাড়িতে ঢোকে। তারা নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়ে হাজীকে গাড়ি তুলে নেয়। এরপর থেকে হাজী এখনও নিখোঁজ। র্যাব ও পুলিশ তাকে ধরে নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করছে।
গত ৩ ডিসেম্বর শনিবার ঢাকার শ্যামলী এলাকা থেকে কয়েকজন যুবক হাজীর বড় মেয়ের জামাই আবদুল মান্নান ও ইকবাল হোসেন নামের দুই যুবককে ধরে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তাদের ধরে নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেনি র্যাব ও পুলিশ। পরিবারের বাসিন্দারা জানান, র্যাব পরিচয়ে শনিবার রাতে কয়েক যুবক হাজীর মেয়ের জামাই জাহাঙ্গীর আলমকে খোঁজ করে। তারা জাহাঙ্গীরকে না পেয়ে আবদুল মান্নান ও ইকবালকে তুলে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তারা নিখোঁজ রয়েছেন।
গত ৬ ডিসেম্বর ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার বাসিন্দা আবদুর রহিম মানিক বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে সংবাদ সম্মেলনে জানান, পুলিশ পরিচয় দিয়ে গত ২৬ অক্টোবর তার ভাই সারোয়ার জাহান বাবুলকে ঢাকার ফকিরাপুল থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। ঘটনার ৪৫ দিন পার হয়ে গেলেও তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। মানিক আরও জানান, তার ভাই ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগের নেতা। ঘটনার দিন সোনাগাজী থানায় জনৈক নুরুন্নবী লিটনের দায়ের করা একটি মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়ার জন্য ঢাকায় আসে। ওইদিন রাত ৮টায় ফকিরাপুলে হোটেল আসরের সামনে থেকে পুলিশ পরিচয়ে কয়েক যুবক তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। পরে ঢাকার বিভিন্ন থানা, র্যাব অফিস, ডিবি অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। গত ২৭ অক্টোবর মানিক একটি জিডি করেন এবং ২৯ অক্টোবর ৬ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলাটি এখন ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে। কিন্তু পুলিশ এখনও বাবুলের কোনো হদিস বের করতে পারেনি। সংবাদ সম্মেলনে মানিক দাবি করেন, তার ভাই বেঁচে না থাকলে অন্তত তার লাশটি যেন পরিবারকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ভাইকে বিদেশ যাওয়ার ফ্লাইটে তুলে দেয়ার জন্য ভোলা থেকে দিদার, বাহার ও জসিম নামে ৩ যুবক ঢাকায় আসে। ওইদিন রাতেই র্যাব পরিচয়ে তাদেরকে গুম করা হয়। ১৭ নভেম্বর এ বিষয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে জসিমের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। দিদার ও বাহারের এখন পর্যন্ত কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এখন মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ।
এছাড়াও নভেম্বর মাসে মতিঝিল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে আরিফ ও জুয়েল নামে দু’ব্যক্তিকে। জানা গেছে, তাদের মধ্যে আরিফ রামপুরার গ্রামীণ সৌন্দর্যের মালিক ও জুয়েল শতাব্দী সেন্টারের নিরাপত্তারক্ষী। আরিফ নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ২০ নভেম্বর মতিঝিল থানায় একটি মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গত ২ অক্টোবর রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম অপহরণের শিকার হন। দু’মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পুরাতন ৭৬/এ, পশ্চিম আশকোনা দক্ষিণখান এলাকার মরহুম আবুল হোসেন মিয়ার ছেলে সাইফুল ঘটনার দিন অফিসের কাজে বাসা থেকে গুলশানে যান। সন্ধ্যা ৭টায় গুলশানে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে কথা বলেন মা এবং বোনের সঙ্গে কথা বলেন সাইফুল। এরপর থেকে তার দুটি মোবাইল ফোন ০১৬৭৫০৪৪৮৯৯ ও ০১৮৯১৯৯৬৮১৯ বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পরিবারের লোকজন জানতে পারছেন না সাইফুল বেঁচে আছে, না মরে গেছে।
৮ নভেম্বর রাজধানীর সূত্রাপুর থেকে অপহরণের শিকার হন সূত্রাপুর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. মমিন হোসেন (২৮)। ১০ নভেম্বর মমিনের স্বজনরা সূত্রাপুর থানায় জিডি করেন। মমিনের স্বজনরা জানান, ঘটনার দিন সকাল ১০টার দিকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় মমিনের মোবাইল নম্বরে (১৯১৩৭৪৯৫৫৮, ০১৮৩৪০৮৯৭৩৫) অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ফোন করলে সে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে গুম করা হয়। বাসা থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টা পর থেকেই মমিনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মমিনের ভগ্নিপতি মো. আলম জানান, কোরবানির ঈদের আগে মমিনের বিয়ের কাবিন হয়েছে। ঈদের তিন দিন পর অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। মমিন নিজেই বিয়ের বাজার-সদাই করেছে। কোরবানির ঈদের পরদিন অজ্ঞাত মোবাইল থেকে তার নম্বরে ফোন আসার পর বেরিয়ে যায় সে। এখন পর্যন্ত সে নিখোঁজ। র্যাব ও পুলিশ মমিনের মোবাইল ফোনের কললিস্ট সংগ্রহ করেছে। কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি দেখাচ্ছে না। মমিনের অপর এক আত্মীয় জানান, র্যাব-পুলিশই মমিনকে অপহরণ করেছে। তা না হলে কললিস্ট পাওয়ার পরও মমিনের বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি কেন।
২৪ অক্টোবর রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ও গোদাগাড়ীর পালপুর ধরমপুর মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক আমিনুল ইসলামকে র্যাব পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। আমিনুল ইসলামের আত্মীয়রা জানান, ঘটনার দিন রাতে ভাটাপাড়ার বাসায় প্রবেশ করে র্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকে অজ্ঞাত কয়েক যুবক তাকে তুলে নেয়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
২২ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হয়েছেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন মীরহাজিরবাগ এলাকা থেকে ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু। এ ব্যাপারে ২৩ সেপ্টেম্বর লিটুর স্ত্রী রাশিদা বেগম যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করেছেন। জিডিতে তিনি অভিযোগ করেছেন, ২২ সেপ্টেম্বর বিকাল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আতাউর রহমান দয়াগঞ্জের দিকে যান। সেখানে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়। ওই জিডি পুলিশ তদন্ত করেনি বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
৩১ জুলাই গেণ্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ এলাকা থেকে মিজান, জুয়েল সর্দার, রাজীব নামে তিন যুবককে সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে আটক করা হয়। বেশ কিছু মানুষের সামনে তাদের আটক করে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনার ৫ দিন পর ৫ আগস্ট উদ্ধার হয় তিন যুবকের লাশ। গাজীপুরের পুবাইল এলাকা থেকে উদ্ধার হয় মিজান ও জুয়েল সর্দারের লাশ এবং মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান এলাকার ঢাকা-মাওয়া সড়ক থেকে উদ্ধার হয় রাজীবের লাশ।
৮ এপ্রিল বিকালে সূত্রাপুর থানাধীন ফরাশগঞ্জ ক্লাব কমিউনিটি সেন্টার এলাকা থেকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় ব্যবসায়ী তাবির উদ্দিন আহমেদ রানাকে। বড় ভাইয়ের বৌভাত অনুষ্ঠান থেকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর এখন পর্যন্ত তার হদিস পাওয়া যায়নি। স্বজনরা র্যাবের বিভিন্ন ক্যাম্প ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু কেউ তার সন্ধান দিতে পারেননি। সূত্রাপুর থানায় এ ব্যাপারে জিডি করা হয়েছে।
ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ঢাকার মালিবাগ এলাকা থেকে বরিশালের উজিরপুরের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খানকে তুলে নেয়া হয় গত বছরের ২৩ নভেম্বর। ঘটনার এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও হুমায়ুনের কোনো সন্ধান পায়নি তার পরিবার। র্যাব-পুলিশও তাকে উদ্ধারের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে দাবি করেছে তার পরিবার। গত বছর ২৩ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় হুমায়ুন খান তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঢাকার সূত্রাপুরের ৪৫/ক, ঢালকানগর, ফরিদাবাদের বাসা থেকে ১০৯৩, মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় তার বন্ধু মফিজুলের বাসায় যান। মালিবাগ থেকে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে হুমায়ুনকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ। তার ছোট ভাই মঞ্জু খান বাদী হয়ে প্রথমে জিডি এবং ১৩ ডিসেম্বর রামপুরা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত হুমায়ুনের সন্ধান মেলেনি বা মামলারও অগ্রগতি হয়নি।
মানুষ গুম হয়ে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, মানবাধিকার কমিশনে বহু মানুষ এসে নালিশ করেন। কারও স্বামী, কারও ভাই, কারও বাবা, কারও ছেলেকে সাদা পোশাকধারী লোকেরা ধরে নিয়ে গুম করেছে। কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মানবাধিকার কমিশন র্যাব-পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও শুধু বলা হয়—দেখছি স্যার। এর বেশি কিছু করারও থাকে না। তিনি জানান, পুলিশের ইউনিফর্ম ছাড়া গ্রেফতার বা আটক অভিযান বন্ধের জন্য সরকারের কাছে মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে। গ্রেফতার অভিযান কখনও সাদা পোশাকে হওয়া উচিত নয়। ইউনিফর্ম লাগিয়ে পুলিশের পোশাকে আটক বা গ্রেফতার অভিযান চালাতে হবে। এতে গ্রেফতার ব্যক্তির স্বজনরা জানতে পারেন কোন সংস্থা কী অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করেছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশ-র্যাবের নাম করে অপহরণের ঘটনা ঘটছে। তবে এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত নয়। অপরাধীরাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করছে। এটা অপরাধীদের একটা কৌশল। যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, র্যাব-পুলিশ এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি আরও বলেন, আসামি গ্রেফতারের বিষয়ে হাইকোর্টের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। তারা স্ব-স্ব ইউনিটগুলোকে ওই নির্দেশনা মেনে ইউনিফর্ম পরে, ক্ষেত্রবিশেষে নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে আসামি গ্রেফতার করার জন্য বলেছেন।

Wednesday, 23 November 2011

বিশিষ্ট আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : সরকার বিদেশ থেকে সাক্ষী আনলেও আইনজীবী আনতে বাধা দিচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার

সরকার পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার জন্য বিদেশি নাগরিকদের ভাড়া করে আনলেও আসামি পক্ষকে বিদেশ থেকে আইনজীবী আনতে বাধা দিয়ে সরকার বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইছে বলে অভিযোগ করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা। তারা বলেন, রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে বিরোধী দল ও মতের নাগরিকদের হেয়প্রতিপন্ন করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিদেশি নাগরিকদের এনে রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি করছে। অথচ আসামি পক্ষকে তাদের নিজেদের টাকা খরচ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে না। এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। বিশিষ্ট ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন আমার দেশকে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সরকারের দ্বিমুখী নীতির কারণে দেশের আদালত ও বিচার ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আমেরিকা থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে লোক আনা হচ্ছে। এফবিআই-এর এজেন্ট পরিচয়দানকারী এ ব্যক্তির আসল পরিচয় কি তা দেশের কেউ জানেন না। তদন্ত ও অনুসন্ধানে তার কি ভূমিকা ছিল তাও অজানা। দুদকের দায়ের করা মামলার বাদী তার অভিযোগপত্রে ১৮ জন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাতেও এ ব্যক্তির নাম নেই। চার্জশিটের কোথাও এ ব্যক্তির নাম তো দূরের কথা তার সম্পর্কে একটি শব্দও নেই। এমন একজন ব্যক্তিকে ভাড়া করে একদিনের নোটিশে আদালতে এনে সরকার জবানবন্দি প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। গোটা জাতি বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিকে আসতে বাধা দিচ্ছে সরকার। আসামি পক্ষ তাদের নিজেদের টাকায় বিদেশ থেকে আইনজীবী এনে তথাকথিত এই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করতে চাইছে। সরকার এতেও বাধা দিচ্ছে। সরকারের এ দ্বিমুখী নীতি ও আচরণের কারণে মূলত দেশের বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, সরকার আদালতে একটি আবেদন দিয়ে বলল- বিদেশি একজন নাগরিক বাদী (সরকার) পক্ষে আসামিদের বিপক্ষে জবানবন্দি দেবেন। আদালত তাত্ক্ষণিকভাবে তা মঞ্জুর করে তার জবানবন্দি গ্রহণ করলেন। অথচ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামি পক্ষ আবেদন-নিবেদন করেও একজন বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি লাভ করতে পারেননি। আদালত সেটা দেয়নি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নামের সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি দিয়েছে সরকারই। অথচ এখানে মামলা পরিচালনার জন্য কোনো বিদেশি অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবীকে মামলা পরিচালনার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, আদালত নিজে থেকে মামলা পরিচালনা করেন না। উভয় পক্ষের আইনজীবীরা ন্যায়বিচার করতে আদালতকে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে সহায়তা করেন। উভয় পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য ও শুনানি শুনে আদালত ন্যায়বিচারের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেন। আমাদের দেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মামলা পরিচালনার মতো আইনজীবী নেই বললেই চলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে কয়েকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, তাতে অন্যান্য দেশ থেকেই আইনজীবীরা গিয়ে উভয় পক্ষে শুনানি করেছেন। ওইসব আদালতে মামলা শুনানি করেছেন এমন অভিজ্ঞ আইনজীবী আমাদের দেশের ট্রাইব্যুনালে এসে শুনানি করলে বিচারের মানদণ্ড নিয়ে হয়তো প্রশ্ন উঠত না। সরকারের দ্বিমুখী নীতি ও আচরণের কারণেই এরই মধ্যে এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে শুধু দেশেই আন্তর্জাতিকভাবেও বড় ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেছেন, সরকারের এ আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। বিচার বিভাগকে পদদলিত করার কৌশল। একদিকে বিদেশ থেকে ভাড়া করে লোক এনে কোনো ধরনের যাচাই-বাচাই ছাড়াই নিজেদের পক্ষে ও বিরোধী দলের নেতাদের বিপক্ষে ইচ্ছেমতো সাফাই সাক্ষ্য আদায় করে নিচ্ছে। অপরদিকে আসামিরা বিদেশ থেকে আইনগত সহায়তা নেয়ার জন্য আইনজীবী আনতে চাইলেও দেয়া হচ্ছে না। সরকারের এ নীতি দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর মারাত্মক ধরনের হুমকি। সরকারের এ নীতিই আদালতের আদেশের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে। আদালতের সমন বা নোটিশ ছাড়াই আমেরিকা থেকে এসে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আবার আদালত সে জবানবন্দি রেকর্ডও করছেন। এগুলো কিসের আলামত, আমাদের আইনজীবীদের পক্ষেও তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, অতীতে এদেশে মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের জন্যও বিদেশ থেকে আইনজীবী আনা হয়েছে। এটা আইন ও আদালতের সার্বজনীনতা। অথচ এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো বিদেশি আইনজীবী আসতে দেয়া হচ্ছে না।

জনপ্রশাসনে চলছে চরম অরাজকতা : ২৪ বছরের সিনিয়র জুনিয়র একই পদে কাজ করছেন

কাদের গনি চৌধুরী

জনপ্রশাসনে পদোন্নতিবন্ধ্যত্ব কাটছে না। শুধু সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাজ করছেন ১৬টি ব্যাচের কর্মকর্তারা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ২৪ বছরের সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তারা একই পদে কাজ করছেন। একই ব্যাচের কোনো কোনো কর্মকর্তা যখন সচিব হিসেবে ক্ষমতা এনজয় করছেন, তখন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাজ করছেন ওই ব্যাচেরই অনেকে। দলীয় কালার না থাকায় এসব কর্মকর্তা বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও এমন নজির নেই।
উপ-সচিব পদেও একইভাবে ৯টি ব্যাচের ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। চাকরিজীবনের ১২ বছরের জুনিয়র ও সিনিয়র কর্মকর্তাকে একই পদে কাজ করতে হচ্ছে। এর ফলে প্রশাসনজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড থাকছে না। বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সময়মত পদোন্নতি দিতে না পারা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত সুস্থ ধারা না থাকায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ২০০৬ সালের ২৫তম বিসিএসের কর্মকর্তারা যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন ২৪ বছর আগের ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা। ’৮২ ব্যাচের ৯ জন, ’৮৪ ব্যাচের ১১, ’৮৫ ব্যাচের ১৭, ’৮৬ ব্যাচের ৪০, ’৯১ (জানুয়ারি) ব্যাচের ৪৮, ’৯১ (ডিসেম্বর) ব্যাচের ৫৩, ১১তম ব্যাচের ৬৮, ১৩তম ব্যাচের ১১০, ১৫তম
ব্যাচের ১০৮, ১৭তম ব্যাচের ৬৩, ১৮তম ব্যাচের ৯১, ২০তম ব্যাচের ২৭৪, ২১তম ব্যাচের ১৭০, ২২তম ব্যাচের ২৬৮, ২৪তম ব্যাচের ২৯১ এবং সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া ২৫তম ব্যাচের ৭৫ কর্মকর্তা একই পদে কাজ করছেন।
উপসচিব পদে ’৮২ ব্যাচের পাশাপাশি ১২ বছরের জুনিয়র ৯৪ সালের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এদের মধ্যে ’৮২ ব্যাচের ৩৩, ’৮৪ ব্যাচের ১৯৬, ’৮৫ ব্যাচের ৫০৯, ’৮৬ সালের ২০৬, ৯১ (জানুয়ারি) ব্যাচের ৮১, ’৯১ (ডিসেম্বর) ব্যাচের ১৪৫, ১১তম ব্যাচের ১৫০ এবং ১৩তম ব্যাচের ১৪ কর্মকর্তা রয়েছেন। যুগ্ম সচিব পদে কাজ করছেন ’৮২ (রেগুলার), ’৮২ (স্পেশাল) ও ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা।
এদিকে প্রশাসনে ৯টি ব্যাচের ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা উপ-সচিব। উপ-সচিবের ৮৩০টি পদের বিপরীতে এখন অতিরিক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ৭১০ জন। এটিও প্রশাসনের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন রেকর্ড। পদের তুলনায় এত বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। বড় বড় ব্যাচের চাপ সামাল দেয়াসহ রাজনৈতিক পছন্দ ও অপছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গত কয়েক বছরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পদের বাইরে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ পদ নেই, তবু পদোন্নতি দিতে হয়েছে। এসব অতিরিক্ত কর্মকর্তার চাপ সামাল দিতে গিয়ে ২০০৬ সাল থেকে প্রশাসনে উপ-সচিবের সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টি করা হয়। মোট ৪৫০ উপ-সচিবের পদকে সুপারনিউমারি দেখিয়ে বছর বছর সংরক্ষণ করে বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। যারা সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে (পূর্বপদ) বসেই কাজ করছেন।
একই পদে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার কারণে সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনে এটাই এখন বড় সঙ্কট। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারাও সিনিয়র সহকারী সচিব এবং তার চেয়ে ১৬ ব্যাচ জুনিয়র ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও সিনিয়র সহকারী সচিব। দেখা গেছে, ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে প্রবেশ করেছেন ১৯৮৩ সালে। আর ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে এসেছেন ২০০৬ সালে। অর্থাত্ ’৮২ ব্যাচ যখন সহকারী কমিশনার, তখন ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের কারও কারও জন্মও হয়নি। প্রায় সমসাময়িক চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ১৯৮৪ ও ’৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা। ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ১৯৮৬ সালে এবং ’৮৫ ব্যাচ ১৯৮৮ সালে। ৬৫০ কর্মকর্তার বড় ব্যাচ ’৮২ বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তারা উপ-সচিব হয়েছেন ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে। সাড়ে চারশ’ সংখ্যার ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা ২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে উপ-সচিব হন। ’৮৫ ব্যাচ ও ’৮৬ ব্যাচ ২০০৬ সালে। বর্তমান সরকারের সময় উপ-সচিব পদে দু’দফায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ৩ শতাধিক কর্মকর্তাকে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়, যেখানে ১৩তম ব্যাচের কয়েকজন পদোন্নতি পান। ’৮২ বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তাদের উপ-সচিব হতেই ২০ বছর পার হয়ে গেছে। এ ব্যাচের ৩১ কর্মকর্তা বর্তমানে উপ-সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন। তারা তিন দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। অনেকে প্রাপ্য পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে গেছেন। এ ব্যাচের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এখন সচিব। অথচ অন্যরা পদোন্নতি না পেয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপ-সচিবের চেয়ারে কাজ করছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে উপ-সচিবদের মধ্যে তিনটি সিনিয়র ব্যাচের ২৩১ কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত অবস্থায় পড়ে আছেন। এরা হলেন ’৮২ নিয়মিত ব্যাচের ৩ জন, ’৮২ বিশেষ ব্যাচের ৩১ জন এবং ১৯৮৪ ব্যাচের ১৯৭ জন। ১৯৮৪ ব্যাচের যেসব কর্মকর্তা ২০০৩ সালে উপ-সচিব হয়েছেন, তারা যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেন ২০০৬ সালে। অথচ পাঁচ বছরেও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি; দু’দফায় বঞ্চিত হয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির তালিকায় রয়েছেন ’৮১ ব্যাচ ৯৫%, ’৮২ নিয়মিত ব্যাচ ৯৬%, ’৮২ বিশেষ ব্যাচ ৯০% ও ’৮৪ ব্যাচ ৫২%। এতে দেখা যায়, যুগ্ম সচিব পদে সবচেয়ে কম পদোন্নতি পেয়েছেন ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা। অপরদিকে ১৯৮৫ ব্যাচের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা ২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ অক্টোবর উপ-সচিব হওয়ার তিন বছর পর ২০০৯ সালে এসে যুগ্ম সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু গত দু’বছরেও তারা পদোন্নতি পাননি। এরই মধ্যে ’৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তারাও যুগ্ম সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত ও নতুন করে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা গেলে ঢাউস উপ-সচিব পদসংখ্যার ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে। তা না হলে প্রশাসন ভারসাম্যহীন হয়ে আরও অচল ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে।
প্রশাসনে পদোন্নতির অপেক্ষায় দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তা : প্রশাসনে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেতে দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তা অপেক্ষায় রয়েছেন। ওপরের দিকে পদোন্নতি আটকে যাওয়ায় জুনিয়র কর্মকর্তারা পদোন্নতির জ্যামে আটকে পড়েছেন। এর ফলে প্রশাসনে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দেয়ায় তাদের বসানোর জায়গা পাচ্ছে না সরকার।
এদিকে সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও ’৮৪ ও ’৮৫ ব্যাচেরই প্রায় ৮০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ’৮৪ ব্যাচের ২২৩ আর ’৮৫ ব্যাচের রয়েছেন ৫৫০ জন। ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এরই মধ্যে চাকরিজীবনের ২৬ বছর পার করে দিয়েছেন তারা। তাদের চাকরির বয়স আছে গড়ে তিন থেকে পাঁচ বছর। এই সময়ের মধ্যে আর পদোন্নতি পাবেন বলে মনে করছেন না অনেকেই। ’৮৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তারা উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পান ২০০৩ সাল থেকে। ২০০৫ সালের মধ্যে প্রায় সবার পদোন্নতি হয়ে যায়। এরপর এ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২২৭ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে পদোন্নতি পাওয়া এসব কর্মকর্তা এরই মধ্যে দুই বছর পার করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কেউই অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাননি। এ নিয়ে তাদের মধ্যেও চরম হতাশা বিরাজ করছে।

গ্যাস পানি বিদ্যুত্ সঙ্কটে ভোগান্তি চরমে

স্টাফ রিপোর্টার

বিদ্যুতের লোডশেডিং আবার অসহনীয় হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তীব্র হচ্ছে গ্যাস এবং পানি সমস্যা। আর তীব্রতর হচ্ছে যানজট। জনদুর্ভোগ ক্রমশ বাড়ছে। অতিষ্ঠ এখন নগর জীবন।
রাজধানীর বারিধারার জে ব্লকের বাসিন্দা শিক্ষিকা সালমা ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। কোনো দিন থাকলেও গ্যাসের চাপ এতই কম থাকে যে এ দিয়ে রান্না সম্ভব নয়। পেশাগত কারণে আমাকে প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছতে হয় সে কারণে রান্নার জন্য প্রতিদিন আমাকে ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর ৫টার আগে। দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে এ এলাকায় গ্যাসের এমন সঙ্কট চলছে। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে আমাদের জীবন।
উত্তরা এলাকার বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না বাসায়। কেরোসিন স্টোভে রান্না করতে হয়। বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা আবদুল করিম জানান, তার এলাকায় প্রায় ৬ ঘণ্টা গ্যাসের প্রেসার থাকে না। মিরপুর পাইকপাড়া, শেওড়াপাড়ায় সকাল ৭টা-৮টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা-৬টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। ভুক্তভোগীরা জানান এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একের পর এক অভিযোগ করেও তারা কোনো সমাধান পাচ্ছেন না।
শুধু বারিধারা, উত্তরা, রামপুরা এবং মিরপুর এলাকায় নয়—রাজধানী জুড়েই চরম গ্যাস সঙ্কট। পুরনো ঢাকার শাঁখারিবাজার, লালবাগ, চকবাজার, ইসলামপুর থেকে শুরু করে মুগদাপাড়া, মাণ্ডা, আফতাবনগর, বাসাবো, গোড়ান, খিলগাঁওয়ের একাংশ, শাহজাহানপুর, যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, শ্যামপুর, হাজারীবাগ, জিগাতলা, রায়েরবাজার, শুক্রাবাদ, মোহাম্মদপুরের আদাবর, শেখেরটেক, জাপান গার্ডেন সিটি, কাঁঠালবাগান, হাতিরপুল, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া, তেজগাঁও প্রভৃতি স্থানেও দেখা দিয়েছে চরম গ্যাস সঙ্কট।
রাজধানীর সব জায়গাতেই বিশুদ্ধ পানি বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী। পানিতে দুর্গন্ধ। আসছে ময়লা,
শেওলা। অনেক এলাকায় পানির রং ঘোলা, লালচে কিংবা কালচে। বাধ্য হয়েই এই পানি ব্যবহার করেন রাজধানীর মানুষ। সামর্থ্যবানরা পানি কিনে পান করেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা ওই পানি ফুটিয়ে, ফিটকারী ব্যবহার করে ফিল্টারের মাধ্যমে ছেঁকে পান করেন। তাতেও পানি বিশুদ্ধ হওয়ার গ্যারান্টি মিলছে না।
পুরনো ঢাকার বেগম বাজার এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ শামিমা খাতুন বলেন, ওয়াসার পানিতে গোসল করলে শরীর চুলকায়, চোখ জ্বলে। পানিতে উত্কট গন্ধ, মুখে তোলা যায় না, বমি আসে। ফুটালে পানি বিবর্ণ হয়ে যায়। দুর্গন্ধ দূর হয় না। ফুটানোর পর পানিতে প্রচুর ফেনা হয়। পানিতে আসা গাদ বালতি বা পাতিলের তলায় জমে কালো হয়ে বসে যায়। দেখতে আলকাতরার মতো। সাবান কিংবা ভিম দিয়েও ওই পাত্র পরিষ্কার করা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে জারভর্তি পানি কিনে রান্নার কাজ করতে হয়। খাওয়ার পানি কিনতে হয় বছরজুড়েই। একই তথ্য জানালেন বাড্ডা এলাকার গৃহবধূ ফাতেমা বেগম।
বাসার লাইনে দূষিত পানি আসায় ক্ষুব্ধ হয়ে গুলশান-২ এলাকার জাহের ভিলার স্বত্বাধিকারী বলেন, ওয়াসা দূষিত পানি সরবরাহ করায় পান করে আমাদের শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করে নানা ধরনের রোগ হচ্ছে।
রাজধানীসহ সারাদেশে বিদ্যুত্ সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সীমাহীন দুর্ভোগ গ্রাহকদের। রাজধানীর অভিজাত এলাকায়ও দৈনিক ৪-৫ দফা লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকার অন্যসব এলাকাসহ সারাদেশে রাত-দিন প্রায় প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিতরণ ত্রুটিজনিত বিভ্রাট। শীত আসার প্রাক্কালে বিদ্যুতের এ ভেল্কিবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী, জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী দফায় দফায় আশ্বস্ত করেছিলেন এক বছরের মাথায় লোডশেডিং থাকবে না। ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশের। কুইক রেন্টালের নামে টেন্ডারবিহীন ব্যয়বহুল বিদ্যুেকন্দ্র বসিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার পরও সরকারের অদূরদর্শী ও ভ্রান্ত পরিকল্পনার কারণে বিদ্যুত্ ভোগান্তি থেকে গ্রাহকের মুক্তি মিলছে না।
রাজধানীর পল্টন, লালবাগ, সেগুনবাগিচা, রামপুরা, খিলগাঁও, কমলাপুর, সূত্রাপুর, বংশাল, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, পার্শ্ববর্তী টঙ্গী এলাকা থেকে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানিয়েছেন, মাঝে ক’দিনের জন্য লোডশেডিং কিছুটা সহনীয় থাকলেও এখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একবার বিদ্যুত্ চলে গেলে দু’ঘণ্টায়ও আর দেখা মেলে না। সন্ধ্যার পর বিদ্যুত্ থাকে খুবই কম সময়ের জন্য। রাত ১১টার পর যখন শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ থাকে, তখন বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কমে যায়। কিন্তু তারপরও গভীররাত থেকে শুরু করে ভোররাতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুত্ থাকছে না।