Saturday 22 January 2011

জনশক্তি রফতানিতে ব্যবসায়ী ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী মুখোমুখি : পরস্পরের বিরুদ্ধে এই খাত ধ্বংসের অভিযোগ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) নেতারা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। জনশক্তি রফতানি খাত ধ্বংসের অভিযোগ করছেন তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে। এই দ্বন্দ্ব এখন আরও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায়। জনশক্তি রফতানি ব্যবসা কে করবে—সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল নাকি বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী বলছেন, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় কমাতে সরকার বোয়েসেলের মাধ্যমে জনশক্তি রফতানির উদ্যোগ নিচ্ছে। অপরদিকে বায়রার নেতারা বলছেন, এ ব্যবসা আরও ধ্বংস করতে এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তারা বলছেন, বেসরকারি রফতানিকারকদের বাদ দিয়ে সরকারিভাবে জনশক্তি রফতানি-প্রক্রিয়া শুরু করা হলে শ্রমবাজার ধ্বংস হয়ে যাবে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বায়রার নেতারা যে কোনো মূল্যে এই প্রক্রিয়া প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
বায়রার সদস্যদের নিয়ে সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা জনশক্তি রফতানি বাজারে মন্দার জন্য সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেয়াকে দায়ী করেছেন। তারা শ্রম ও কর্মস্থান এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পদত্যাগও দাবি করেন। তারা বলেন, মন্ত্রীর ব্যর্থতার কারণেই জনশক্তি রফতানি কমছে। বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়ার বাজার দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকলেও সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে তারা স্পষ্টভাবে জানান। তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী এ খাতে নানা সমস্যার জন্য জনশক্তি রফতানিকারকদের দায়ী করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় ব্যবসায়ীরা বেশি টাকা নেয়ার কারণে মূল সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বলার পরও অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ কমাচ্ছে না রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর ফলেই নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় চার লাখ লোক অবৈধ হয়ে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত অভিবাসন খরচই দায়ী। দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে এই লোকগুলো সেখানে গেছেন। সেই টাকা তোলার জন্য তাদের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সেখানে অবস্থান করতে হচ্ছে। আর এটি করতে গিয়ে তারা এখন সেখানে অবৈধ হয়ে আছেন।
গতকাল মালয়েশিয়া সরকারের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তিন দিনের সফরে ঢাকা এসেছে। আজ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকে সরকারিভাবে লোক পাঠানোর বিষয়ে কথা হবে। সরকার আশা করছে, সবকিছু চূড়ান্ত হলে আগামী জুনের আগেই মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের বাজার চালু করা যাবে।
তবে সরকারিভাবে লোক পাঠানোর এই খবরে উদ্বিগ্ন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা। বায়রার সভাপতি আবুল বাসার বলেন, সরকারই যদি ব্যবসা করতে নামে, তাহলে এই খাতে চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা ১১শ’ রফতানিকারক কোথায় যাবেন?
তিনি বলেন, গত ২৬ বছরে বোয়েসেল মাত্র ১৭ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। আর বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গেছে ৭০ লাখ। এই তথ্যই প্রমাণ করে বোয়েসেলের প্রতিবছর কয়েক লাখ লোক বিদেশে পাঠানোর মতো যোগ্যতা ও দক্ষতা নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে ব্যবসায় নামানো সরকারসহ কারও জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। কারণ সরকার ব্যবসায় জড়িত হলে আমলাতান্ত্রিক বা অবকাঠামোগত নানা জটিলতার কারণে দীর্ঘসূত্রতায় কর্মী রফতানি-প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবে।
তবে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য—এসব কারণেই মালয়েশিয়ার বাজার দেড় বছর ধরে বন্ধ। আগে বাজার চালু করা জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই বাজার চালুর একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন সরকারিভাবে লোক পাঠিয়ে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা গেলে বাজার ধরে রাখা যাবে। আর যারা লোক নেবে, সেই মালয়েশিয়াই সরকারিভাবে লোক চাইছে। এখন বাজার খোলার আগেই যদি বায়রা বিরোধিতা করে তাহলে সেটি বড় সমস্যা। তবে সরকার কারও অনৈতিক দাবির মুখে মাথা নত করবে না। তাই সরকারিভাবেই লোক পাঠানোর প্রক্রিয়া চলবে। এর ফলে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বাংলাদেশের একজন কর্মী বিদেশে যেতে পারবেন। সেখানে অন্তত পাঁচ বছর থাকতে পারবেন। এতে খুব সহজেই তারা খরচের টাকা তুলতে পারবেন।
মালয়েশীয় প্রতিনিধি দলের সফর প্রসঙ্গে বায়রার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াজ-উল-ইসলাম বলেন, এটাকে আমরা খুবই পজিটিভলি দেখছি। আমরা আশা করছি, এ বিষয়ে সরকার ভালো পদক্ষেপই গ্রহণ করবে। সরকার ব্যবসা না করে নীতি নির্ধারণীমূলক কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তথ্য বিবরণী : গতকাল তথ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো এক বিবরণীতে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তারা সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া ও লেবানন সফর করেছেন। সফরকালে সেসব দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় দেখা যায়, কর্মী প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশীদের অভিবাসন ব্যয় সর্বোচ্চ। কর্মীরা যে ব্যয় করে প্রবাসে যান চুক্তিকালীন মেয়াদে সে ব্যয় কোনোভাবেই তুলে আনতে পারেন না। ফলে অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজে লিপ্ত হন এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ফিরে না আসায় অবৈধ হয়ে পড়েন। শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য বিষয়টি উদ্বেগের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে তারা নিরুত্সাহিত বোধ করে। উদাহরণস্বরূপ মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে একপথ বিমান ভাড়াসহ অভিবাসন ব্যয় ৮৪ হাজার টাকা সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করলেও তার চেয়ে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি ব্যয়ে একজনকে মালয়েশিয়া প্রেরণ করা হয়।
অব্যাহত প্রচেষ্টায় যখন বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তখন নিজেদের মধ্যে এজাতীয় বিতর্ক এবং ভুল বোঝাবুঝি শ্রমিক গ্রহণকারী দেশে ভুল বার্তা প্রেরণ করতে পারে, ফলে এ প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে তথ্য বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়। সরেজমিন নিরীক্ষণের জন্য মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি দল গতকাল বাংলাদেশ সফরে এসেছে বলেও জানানো হয়। তাদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মালয়েশিয়ার সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, কোন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করবে।
মালয়েশিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে অতীতের মতো প্রকৃত চাহিদার বাইরে কোনো লোক যাতে না যায়, অভিবাসন ব্যয় যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে—এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিশ্চয়তা চাওয়া হয়। দেশটিতে এ পর্যায়ে অভিবাসন প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে চালু করার জন্য সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অবশ্যই বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় লোক প্রেরণ করতে পারবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ এবং ২০০৮ সালে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ বাংলাদেশী কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা কমে হয় চার লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন। সেসময় জনশক্তি রফতানিকারকরা ভেবেছিলেন, বিশ্বমন্দা কেটে গেলে এই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু ২০১০ সালে জনশক্তি রফতানি আরও কমে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭০২ জনে দাঁড়ায়।

No comments:

Post a Comment