Monday 23 August 2010

রাতের ঢাকায় দুর্বৃত্ত আতঙ্কে পুলিশ

নাছির উদ্দিন শোয়েব

দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে ঈদ মার্কেটে রাতে ডিউটি করতে ভয় পাচ্ছে পুলিশ। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় অনেক পুলিশ সদস্য ডিউটিকালীন অজানা আতঙ্কে থাকেন। বিশেষ করে নগরীতে ঈদ মার্কেট জমে ওঠার পর বড়-বড় শপিংমল ও বিপণিবিতাণ রাতভর খোলা থাকে। এ সময় সাধারণ মানুষ গভীর রাতে কেনাকাটা করে ঘরে ফেরে। রাতের নিরাপত্তায় শহরের অলিগলি এবং বিপণিবিতানের সামনে পুলিশ ডিউটি করে। কিন্তু সমপ্রতি সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর হামলা, গুলি ও ছুরিকাঘাত করায় রাতে ডিউটি করতে অধিক সতর্ক থাকতে হচ্ছে। পুলিশের ওপর হামলাকারী দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ফলে অপরাধীরা হামলা চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, যারা নিরাপত্তা দেবে তারাই যদি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে, তাহলে জনসাধারণের অবস্থা কী হবে!
সূত্রমতে, রমজানের শুরু থেকেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা ভালো রাখার ঘোষণা দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সে হুঙ্কার কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা সামাল দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কর্তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা দিতেই এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের কৌশলে পুলিশ হেরে যাচ্ছে। দুর্বৃত্তদের পাকড়াও করতে গেলে পুলিশ হামলার শিকার হচ্ছে। এমনকি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করছে সন্ত্রাসীরা। প্রকাশ্যে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে অস্ত্র, গুলি ও ওয়াকিটকি কেড়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে—পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার কাজের সমন্বয়হীনতায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। রমজানের শুরুতেই অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা তত্পর হয়ে মাঠে নামে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড, ডাকাতি, গুলি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
বুধবার খিলক্ষেতে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে অস্ত্র, গুলি ও ওয়াকিটকি নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হন। দুজনকে গুরতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছয় দিনেও পুলিশের সরকারি অস্ত্রটি উদ্ধার করা যায়নি। এ ঘটনায় পুলিশও উদ্বিগ্ন। অস্ত্রটি উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, হামলাকারীরা সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না। খিলক্ষেতের ঘটনার রেষ না কাটতেই ফকিরাপুলে টহল ডিউটি করার সময় দুর্বৃত্তরা পুলিশের ওপর গুলি চালিয়ে কনস্টেবল মঞ্জুরুল ইসলামকে খুন করে। এ ঘটনায় পুলিশ সদস্য হাবিবুল্লাহ ও এক আনসার সদস্য আহত হন। দুর্বৃত্তরা পুলিশকে গুলি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ ধাওয়া করে সাইফুল ইসলাম খান নয়ন নামে এক দুর্বৃত্তকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করে। পরে গণপিটুনি ও গুলিবিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়নি। এ ঘটনার পরের দিনই সূত্রাপুরে আনসার সদস্যের গুলিতে গৃহবধূসহ স্থানীয় দুই বাসিন্দা আহত হন। আনসাররা জানান, এলাকাবাসী তাদের ঘিরে ফেললে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হন। কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে পরে দুই আনসার সদস্যের অস্ত্র জব্দ ও সাসপেন্ড করা হয়। গত শনিবার ভোর রাতে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে লালমনিরহাট জেলার পুলিশ কনস্টেবল বরকত আলীকে দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাত করে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সা দেয়া হয়।
পুলিশ সদস্যরা হঠাত্ দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পড়ায় চিন্তিত পুলিশ কর্মকর্তারাও। পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ পুলিশ সদস্যদের সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন। টহল ডিউটি ও সন্ত্রাসী গ্রেফতারের সময় অথবা অভিযান চালাতে গিয়ে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে নিজেদের জানমালের দিকেও দৃষ্টি রাখতে বলেছেন। কেননা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা না থাকলে সে অন্যের কীভাবে নিরপাত্তা দেবে। ডিএমপি কমিশনার একেএম শহীদুল হক বলেছেন, পুলিশের ওপর হামলাকারী সে যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে। তিনি বলেন, পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ ব্যাপক তত্পর।
সূত্র জানায়, এখনও অনেক পুলিশ সদস্য রাতে টহল ডিউটি করার সময় পুরনো শটগান ব্যবহার করছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব অস্ত্র ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। কেননা সন্ত্রাসীদের কাছে এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। এসব অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে পুরনো শটগান ও রাইফেল দিয়ে অভিযান চালানো সম্ভব নয়। মতিঝিলে পুলিশের ওপর হামলা করার সময় পুলিশও সন্ত্রাসীদের গুলি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ অস্ত্র লোড করার আগেই সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তত্পরতা না থাকায় এখনও সন্ত্রাসীদের হাতে বহু অস্ত্র রয়েছে। পুলিশ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি সময় ব্যয় করায় এসব অবৈধ অস্ত্র সন্ত্রাসীরা দেদার ব্যবহার করছে, তার শিকার এখন পুলিশই। পুলিশের ওপর হামলা ও গুলি চালানোর ঘটনায় খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনও উদ্বেগ প্রকাশ করে অপরাধীদের গ্রেফতারের হুঙ্কার দেন। এখন পর্যন্ত প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করা যায়নি। আর এ কারণে পুলিশের মাঝে আরও উত্কণ্ঠা বাড়ছে। অপরাধীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ পুলিশ সদস্যদের ডিউটি করার সময় আরও সতর্ক থাকতে বলেছেন। মানুষের জানমাল রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের জীবনের দিকেই পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টি দিতে বলেছেন। এরপর থেকেই পুলিশ রাতে ডিউটি করার সময় এখন অনেকটাই সতর্কতা অবলম্বন করছেন। রাতে কোথাও অভিযান কিংবা চেকপোস্টে তল্লাশি করার সময় নিজেকে নিরাপদে রাখতে আগের চেয়ে এখন অনেক সতর্ক পুলিশ।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, সন্ত্রাসীদের গুলি ও ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতসহ বিভিন্নভাবে গত বছরে পুলিশ বাহিনীর ২৭ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। সন্ত্রাসীদের গুলি, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ডাকাতের গুলি ও ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০০৯ সালে ২৬ জন এবং ২০০৮ সালে ১ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
গত রোববার শান্তিনগরে টুইন টাওয়ারে সপরিবারে ঈদের কেনাকাটা করে ফিরছিলেন আলহাজ মোস্তাকিম। তিনি বললেন, চেয়েছিলাম সন্ধ্যার পরে কেনাকাটা করতে বের হবো। দিনের বেলায় রোজা রেখে এবং অফিস করে মার্কেটে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলার যে অবস্থা, রাতে বের হওয়ার আর সাহস পেলাম না। তার ভাষায়—যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের নিরাপত্তা দেবে, তারাই হামলার শিকার হচ্ছে। পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। অস্ত্র লুট করে নেয়, ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। আলহাজ মোস্তাকিম অনেকটা আক্ষেপ করেই বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত অস্ত্রধারী পুলিশ সদস্যরাই যখন নিরাপত্তাহীন, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কে দেবে?’ তিনি বলেন, এসব দিক চিন্তা করেই স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বিকেলেই বেরিয়েছি ঈদের কেনাকাটা করতে। মোস্তাকিমের সঙ্গে আলাপকালে পাশেই আরও কয়েকজন ক্রেতা শপিংমলের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক একই ধরনের মন্তব্য করলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো পুলিশের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় সাধারণ মানুষও উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি পুলিশের ওপর বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হওয়ায় অনেকেই অবগত। ফলে তাদের মাঝেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। কয়েকজন ক্রেতা ও বিক্রেতা বললেন, ১৫ রমজান থেকে রাতভর বিপণিবিতান ও মার্কেট খোলা থাকবে। এ সময় গভীর রাত পর্যন্ত হবে বেচাকেনা। চলবে চাঁদরাত পর্যন্ত। তখন ছিনতাইকারী, পকেটমার, চোর-ডাকাতসহ অপরাধীদের তত্পরতাও বেড়ে যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আরও বেশি। অনেক মার্কেটে নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও তা অপ্রতুল। কিন্তু ক্রেতাদের ভয় বেশি মার্কেট থেকে কেনাকাটা করে যাতায়াতের সময়।

No comments:

Post a Comment