Thursday 3 June 2010

বিএসএফের বাধায় বাঁশঝাড়িয়া চরের দখল পাচ্ছে না বাংলাদেশ : ইছামতি-কালিন্দীতে জেগে ওঠা চরগুলো দখল করে নিয়েছে ভারত



04/05/2010
আলাউদ্দিন আরিফ, সীমান্ত এলাকা থেকে ফিরে
ইছামতি-কালিন্দী নদীতে ভারতের তীর ঘেঁষে জেগে ওঠা এক ডজনের বেশি চর দখল করে নিয়েছে ভারত। বিএসএফের আগ্রাসী তত্পরতায় বাংলাদেশ তীরে জেগে ওঠা ৩০০ একর ভূখণ্ডের বাঁশঝাড়িয়া চরের দখল নিতে পারছে না বাংলাদেশ। ভারতীয়রা নদীশাসনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রোয়েন ও স্পার নির্মাণ করে কালিন্দি-রায়মঙ্গল নদীর স্রোত সরিয়ে দিয়ে দখল করতে চাইছে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ। সম্প্রতি ভারতের মিডিয়া বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। ওই অপপ্রচারে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের কিছু মিডিয়াও। সরকারের উচিত বিষয়টি সঠিক জরিপ করে ব্যবস্থা নেয়া। তালপট্টি ছাড়াও কালিন্দি-রায়মঙ্গল নদীতে সুন্দরবনের ভেতরে জেগে ওঠা আরও বেশকিছু চরের দিকেও শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে ভারতের।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গত ৩৯ বছরে ইছামতি-কালিন্দির ভাঙনে কয়েক হাজার একর জমি চলে গেছে ভারতের দখলে। এই শুকনো মৌসুমেও জোয়ারের তোড়ে ভাঙছে নদীর তীর। আর চর পড়ছে ভারতের অংশে। ভাঙন ঠেকানোর জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাঁধ দেয়ার পরই আবার ভেঙে যায়। পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, বিএসএফের বাধা ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় তারা শক্তভাবে বাঁধ তৈরি করতে পারছেন না। বাংলাদেশ অংশে নদীর তীরে এমব্যাংকমেন্ট ও ব্যাংক রিভেটমেন্টের কাজ ভারত সঠিকভাবে করতে না দিলেও যশোরের শার্শা ও ভারতের ২৪ পরগনার মধ্যবর্তী অংশে ইছামতির পলি অপসারণের জন্য নদী খনন করেছে ভারত। ড্রেজার দিয়ে মাটি তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভারতে। তৈরি করা হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং বিএসএফের চলাচলের জন্য রাস্তা।
সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বাঁশঝাড়িয়া এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, ইছামতি-কালিন্দীর বুকে জেগে ওঠা প্রায় ৩০০ একর আয়তনের চরটির দখল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। চরটি এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বাঁশঝাড়িয়া ও ভারতের বড় সাহেবখালী নামক স্থানের মধ্যবর্তী এলাকায় বাংলাদেশ ভূখণ্ড ঘেঁষে নদীর বুকে বালুচর জাগে পাকিস্তান আমলে। শুরু থেকেই চরটির প্রতি দৃষ্টি পড়ে ভারতের। তারা কয়েকদফা চরটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করে। বিডিআরের বাধায় সেটি সম্ভব হয়নি। নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চরটির আয়তন দিনে দিনে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে এ চরটি প্রায় ৩০০ একরে পরিণত হয়েছে।
চরটি বর্তমানে কেওড়া, বাইন, গেওয়া ও খলসেসহ নানা প্রজাতির গাছ-গাছালিতে ভরে গেছে। ভারত জঙ্গলটির মালিকানা আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি না করলেও এদেশের জেলে ও মৌয়ালরা গেলেই বাধা দেয় বিএসএফ। যদিও চরটির প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের।
স্থানীয় কলেজ শিক্ষক ও সাংবাদিক ড. মিজানুর রহমান জানান, বাঁশঝাড়িয়ার চরটি এখন চোরাচালানি ও চোরাকারবারিদের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বাঁশঝাড়িয়া বিডিআর বিওপির আওতাধীন এ জঙ্গলের রক্ষণাবেক্ষণে বিডিআর জওয়ানরা সবসময় তত্পর। তারপরেও ভারতীয় ও বাংলাদেশী নাগরিকরা বিডিআরের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাছপালা কেটে নিচ্ছে। কালীগঞ্জের স্বদরকাটি, মৌখালী, মহেশ্বরপুর ও বাহাদুরপুর গ্রামের লোকেরা জানান, চরটি রক্ষা করতে হলে বিডিআরকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। কিছু ভারতীয় নাগরিক প্রতিনিয়ত জঙ্গলের কাঠ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই জঙ্গলের ভেতরে ভারতীয় ফেনসিডিল, শাড়ি-কাপড়সহ প্রভৃতি মালামাল পাওয়া যায়। ইতোপূর্বে চোরাপথে আসা ভারতীয় ফেনসিডিল, থ্রি-পিসের কাপড় ও থান কাপড় উদ্ধার করে বিডিআর। বাঁশঝাড়িয়া বিওপিতে কর্তব্যরত বিডিআর সদস্যরা জানান, চরটি বাংলাদেশের এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি রক্ষার জন্য আমাদের আন্তরিকতারও কোনো ঘাটতি নেই।
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ প্রসঙ্গে জানা গেছে, নদীশাসনের উন্নত কৌশল প্রয়োগ করে ভারত নদীর স্রোত ঠেলে দিয়ে দক্ষিণ তালপট্টির দখল নিতে চাইছে। তালপট্টি দ্বীপটি রায়মঙ্গল-হাড়িয়াভাঙা নদীর মধ্যবর্তী চ্যানেলে। ভারত চাইছে স্রোত সরিয়ে দিয়ে তালপট্টি দ্বীপটি দখলে নিতে। সম্প্রতি ভারতের মিডিয়ায় বলা হয়েছে, তালপট্টি দ্বীপ ডুবে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুর রব ও আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলসহ বিশেষজ্ঞরা জানান, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ভারত এই দ্বীপটির দখল নিতে চাইছে। নিজেদের স্বার্থে ভারত দ্বীপটি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেরও বেশ কিছু মিডিয়া এতে মদত দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত উপযুক্ত জরিপের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার করা।
সীমান্ত নদী ইছামতি-কালিন্দীর কালিঞ্চি থেকে বাঁশঝাড়িয়া পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নদীর পুরো তীর ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার। নদীর পশ্চিম তীরে ভারতীয় অংশে একের পর এক চর পড়ছে; আর ভেঙে বিলীন হচ্ছে পূর্বতীর বাংলাদেশ। ভিটেমাটি আর ফসলের জমি হারিয়ে হাহুতাশ করছে নদীতীরের লোকেরা। ভারতের অংশে নদীতীরের পুরোটাই ইট-পাথর দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। বাংলাদেশের সীমানা পিলার ‘১ এমপি’র বিপরীতে নদীর তীরজুড়ে ভারতীয় অংশে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক ইটভাটা। প্রতিদিন ইটভাটা থেকে আধলা ইট ফেলে নদী ভরাট করা হচ্ছে। বাঁশের খুঁটি গেড়ে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা ও স্পার (গ্রোয়েন) তৈরি করে নদীর স্রোত ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। ফলে বাংলাদেশ অংশে কিছু সিসি ব্লক থাকলেও সেগুলো জোয়ারভাটায় তলিয়ে যাচ্ছে। জোয়ারভাটার টানে সর্বগ্রাসী হয়ে ভাঙছে ইছামতি। বাংলাদেশ তীরের কাছ দিয়ে নদীর বুক থেকে প্রতিদিন ইঞ্জিনচালিত হাজার হাজার ভারতীয় নৌকা বালু তুলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে বাধা দিলেও পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর মাটি তোলায় বিডিআর এখন বাধা দিচ্ছে না।
সাতক্ষীরার টাউন শ্রীপুর ইউনিয়নের রামনগর মৌজায় প্রায় ১০০ একর জমি গত এক দশকে ভেঙে ভারতের দিকে চলে গেছে। বাংলাদেশের কোমরপুর ও ভারতের শাকচুড়ার মধ্যবর্তী স্থানের বহু জমি চলে গেছে ভারতের দখলে। কোমরপুরের কৃষক মাজেদ গাজী (৬৫) জানান, ভাঙনে তার বাপ-দাদার ভিটেমাটি চলে গেছে। তার দেখা মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে প্রায় চারশ’ বিঘা জমি চলে গেছে। তার দেখাতেই তিনবার বাঁধ ভেঙেছে আর নতুন বাঁধ হয়েছে। ভোমরা ইউনিয়নের হাড়তদা মাঝেরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হাই জানান, ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার দোলদানা এলাকায় যে ইটভাটাগুলো বসানো হয়েছে, আগে সেই জমিগুলোর অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ড। নদী ছিল তারও অনেক পশ্চিমে। এখন নদী সরে এসেছে প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্বে। ওই এলাকাতেই ভারতীয় অংশে দেখা গেছে অসংখ্য ইটভাটা। নদীর মাঝখান থেকে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে। নৌকায় কর্মরত ভারতীয় নাগরিকরা জানান, তাদের বাড়ি ভারতের চব্বিশ পরগনার বশিরহাট এলাকায়। প্রতিদিনই এখানে বালু নিতে আসে তারা। কেউ বাধা দেয় কিনা, এর উত্তরে তারা জানায়, হাসিনা সরকার আসার পর কেউ আর বাধা দেয় না। তাই হাসিনা সরকারের প্রতি তারা কৃতজ্ঞ।
দেবহাটা পূর্ব এলাকার ভাতশালা গ্রামের বাসিন্দা বাবুল আক্তার জানান, তার বাপ-দাদার ভিটেমাটিসহ ৪ একর জমি এখন ইছামতির পেটে। এখনও তাকে ওই জমির খাজনা দিতে হয়। তিনি জানান, এখন যেখানে নদীর পূর্বপাড়, আগে তা ছিল আনুমানিক ৪শ’ গজ পশ্চিমে। এখন ওই তীরে চর জেগে এই তীরে ভাঙছে। একই গ্রামের বাসিন্দা মকবুল বিশ্বাস জানান, তিনি ও তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় ১০০ বিঘা জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আর চর পড়েছে ওই তীরে।
ভারতের অংশে রাজনগর ও কালুতলা এলাকায়ও চর পড়ছে। এই তীরে দেবহাটার সুশীলগাজী খানপাড়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, তাদের চোখের দেখাতেই ওয়াপদার ৩টি বাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একবার বাঁধ ভাঙলে বাংলাদেশের ভেতরে দেড়-দুইশ’ গজ ভেতরে এনে আবার বাঁধ দেয়া হয়। সিসি ব্লক দিয়ে শক্তভাবে বাঁধ তৈরি করা সম্ভব না হওয়ায় প্রতি বছর ভেঙে যাচ্ছে সুশীলগাজী খানপাড়া গ্রামের লোকের জমি। ওই গ্রামের বাসিন্দা হানিফ জানান, এখন যেখানে নদীর পশ্চিম পাড়, আগে সেখানে তারা ফুটবল খেলতেন। কিন্তু এখন সেটা ভারতের হয়ে গেছে। দেবহাটার নওয়াপাড়া এলাকায়ও দেখা গেছে ভয়াবহ ভাঙন।
দেবহাটার টাউন শ্রীপুর এলাকার বিডিআর ক্যাম্পের কমান্ডার জানান, নদীর মাঝখান থেকে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করা। যে পাড়েই চর পড়বে, সীমানা নির্ধারণ হবে নদীর মাঝখান থেকে। ফলে নদী ভেঙে ভারতীয় অংশে চর পড়লেও আইনগতভাবে তারা সেটার দখলে যেতে পারেন না। তবে এর প্রতিবাদ জানান দেবহাটা খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবু তালেব। তিনি বলেন, ভারত গায়ের জোরে দাবি করছে সীমানা মাঝখান থেকে। ওই এলাকায় সীমানার বিষয়টি বিভিন্ন চুক্তিতে মীমাংসিত হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরা জেলা পাউবো কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নদীর ভাঙনে কয়েক লাখ বিঘা জমি ভারতের দখলে চলে গেছে। ইছামতি-কালিন্দীর পুরো ৭৫ কিলোমিটার সীমান্তেই বাংলাদেশ অংশে নদী ভাঙছে আর ভারতীয় অংশে চর পড়ছে। এখনও এক, তিন ও পাঁচ নম্বর ফোল্ডারে প্রায় ১০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২৭ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্নির্মাণ জরুরি। এ নিয়ে একটি প্রকল্পও জমা দেয়া আছে; কিন্তু বরাদ্দ না পাওয়ায় বাঁধটি সঠিকভাবে মেরামত করা যাচ্ছে না। তারা আরও জানান, বাঁশঝাড়িয়ায় জেগে ওঠা চর আমাদের হওয়া সত্ত্বেও বিএসএফের বাধায় আমরা দখলে যেতে পারছি না। টাউন শ্রীপুর ও হাড়তদা এলাকায় আরও দুটি নতুন চর জেগে উঠেছে, সেগুলোও ভারতের দখলে যাবে। ফলে বাংলাদেশ সীমান্তে ভাঙন আরও তীব্র হবে। তারা আরও বলেন, ভারত ইছামতি খননের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, বাংলাদেশের উচিত তার প্রতিবাদ করা। খনন হওয়া উচিত ১৯৬২ সালের রেকর্ড অনুযায়ী।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/05/04/30231

No comments:

Post a Comment