Thursday 3 June 2010

জকিগঞ্জে বরাক সুরমা কুশিয়ারার ভাঙনে ভারতে গেছে ২৬শ’ একর জমি : আরও ৪শ’ একর দখলে নিতে চায় ভারত



28/04/2010

আলাউদ্দিন আরিফ, সীমান্ত এলাকা থেকে ফিরে
সিলেটের জকিগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে সীমান্ত নদীর ভাঙনে সৃষ্ট চরের দখল নিতে আগ্রাসী তত্পরতা চালাচ্ছে বিএসএফ। বরাক ও সুরমা-কুশিয়ারার ভাঙনে এরই মধ্যে জকিগঞ্জের প্রায় ২৬শ’ একরের বেশি জমি ভারতের দখলে চলে গেছে। আরও ৪শ’ একর জমির দখল নিতে তত্পর ভারত। বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারায় জেগে ওঠা চরগুলো দখলে নিতে বিগত ৩৭ বছরে বিডিআর-বিএসএফের মধ্যে ৭৭ বার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। বিএসএফ হামলা চালিয়েছে ১৩৪ বার। অনুপ্রবেশ করেছে ৪শ’ বারের বেশি। তাদের গুলিতে মারা গেছে ৫৫ জনেরও বেশি বাংলাদেশী নাগরিক। আহতের সংখ্যাও অনেক। ভারতের মনিপুর রাজ্য থেকে বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদে এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নাম নিয়েছে। বরাক বাংলাদেশে প্রবেশের আগে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সীমানা। বরাকের মোহনায় পূর্ব অংশে ভারত আর পশ্চিম অংশে বাংলাদেশ। অমলসীদে সুরমা-কুশিয়ারার উত্সমুখে আন্তর্জাতিক সীমারেখা চলে এসেছে সুরমার পশ্চিম তীরে। এখানে জেগে ওঠা ২৫৬ একর আয়তনের একটি চর ভারত দাবি করছে তাদের ভূমি হিসেবে। তবে এই জমিতে বিএসএফ কখনও তাদের চৌকি বসায়নি। চর জেগে ওঠার পর থেকেই এই জমি চাষাবাদ করে আসছিলেন বাংলাদেশের কৃষকরা। কিন্তু এখন বিএসএফের বাধায় চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যমতে, ২৫৬ একরের ওই চর ছাড়াও সুরমা-কুশিয়ারার ভাঙনে একটি পুরো গ্রামসহ আরও প্রায় ২৬শ’ একরেরও বেশি জমি চলে গেছে ভারতের দিকে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জকিগঞ্জ লক্ষ্মীগঞ্জ অফিসের কর্মকর্তা ও অমলসীদের স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমান জানান, জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪৭ কিলোমিটার, সুরমা নদী ২৭ কিলোমিটার সীমানা নির্ধারণ করেছে। এই বিশাল সীমান্তজুড়েই রয়েছে নদীভাঙন সমস্যা। তাদের হিসাব অনুযায়ী সুরমা ও কুশিয়ারার ভাঙনে জকিগঞ্জের অমলসীদে বরাকের ভাঙনের মুখে পূর্ব অলিগড় নামে পুরো একটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নদী চলে এসেছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ অংশে চর পড়ে আন্তর্জাতিক সীমারেখাও এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের দিকে। অলিগড়, রারাই, মানিকপুর, শষ্যকুড়ি এলাকার প্রায় এক হাজার একর; জকিগঞ্জ পৌরসভা এলাকায় ৫০-৬০ একর, হাইদ্রাবন এলাকায় ৫০ থেকে ৫৫ একর, ভূঁয়ার মোড় এলাকায় এক হাজার একর, লোহার মহল, গাগলাজুর এলাকায় প্রায় ৬০ একর, সুপ্রাকান্দি এলাকায় প্রায় ৪০ একর, গধাধর-বীরশ্রী এলাকায় প্রায় ৫৫ একর, বড়পাথর ও পীরনগর এলাকায় প্রায় ৬০ একর, শাহ্শরিফ মোকাম এলাকায় ৩০ থেকে ৩৫ একর, উজিরপুর এলাকায় প্রায় ৭০ একর জমি ভেঙে চর পড়েছে বাংলাদেশের অংশেই। তবে নদী দিয়ে সীমানা চিহ্নিত হওয়ায় ভারতীয়রা ওই চরগুলো দখলের তত্পরতা চালাচ্ছে।
ভূঁইয়ার মোড় এলাকার বাসিন্দা শহীদুর রহমান জানান, ওই গ্রামের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী ভাঙছে। এখানে কুশিয়ারা নদী ইংরেজি বর্ণ ‘ইউ’-এর আকার নিয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। চর পড়ছে বিপরীত দিকে। সম্প্রতি এখানকার একটি স্কুল নদীতে ভেঙে গেছে। সুরমান নদীতে অমলসীদ অংশে ৫০ একর, বারটকরি ও উত্তরকূল এলাকায় ৩০ একর, মুন্সিরবাজার এলাকায় ৩০ থেকে ৪০ একর, শিবেরচক ও ডহরের মুড়া এলাকায় ২০ থেকে ২৫ একর, কালীগঞ্জের বাল্লা সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৬০ একর জমি ভারতের দখলে চলে গেছে।
বিপুল পরিমাণ জমি চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসের কর্মকর্তারা জানান, খরস্রোতা বরাকের তীব্র স্রোত সরাসরি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে ধাক্কা লাগে। পানির তোড়ে তীব্র স্রোতে ভেঙে যায় বেড়িবাঁধসহ মানুষের ঘরবাড়ি। আর চর পড়ে উল্টোপাশে। এভাবেই আমাদের মূল্যবান ভূখণ্ড চলে যাচ্ছে।
অমলসীদ গ্রামের বাসিন্দা নূরুদ্দীন (৫০) জানান, অমলসীদের পূর্ব অলিগড় গ্রামটির পুরোটাই নদীতে ভেঙে গেছে। গ্রামের সর্বশেষ বাড়িটিতে এখন তারা আছেন। কয়েক বছর আগে পাথরের সিসি ব্লক দিয়ে এমব্যাংকমেন্ট করায় তাদের বাড়িটি রক্ষা পেয়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে নদী ভাঙনের তীব্রতা। তিনি আরও জানান, তাদের বাপদাদা, আত্মীয়স্বজনের ভিটেমাটি সবই গেছে। এখন সেগুলো ভারতের অংশ হয়ে গেছে। একই গ্রামের সাহাবুদ্দীন, আবদুল জাব্বার, গনি মিয়া, ফোরকান মিয়া, রহমান মিয়া, জুনু মিয়া, ফাতাই মিয়াসহ অনেকেই জানান নদীর ভাঙনে তাদের ভিটেমাটি, ফসলের জমি হারানোর কথা। যে এলাকায় আগে তাদের ভিটেমাটি ছিল সেখানে এখন বিএসএফের ক্যাম্প। ওইসব জমিতে চাষাবাদ করে ভারতের কৃষকরা। আর ভাঙনের শিকার জকিগঞ্জের লোকজন চলে যাচ্ছে অন্য এলাকায়।
জকিগঞ্জ ও জৈন্তাপুর এলাকার বাসিন্দারা জানান, জকিগঞ্জের অমলসীদ সীমান্তের ২৫৬ একর ও জৈন্তাপুরের ডিবির ও কেন্দ্রী হাওরের ১৩৫ একর জমি দখল করে নিতে চায় ভারত। এসব জমি দীর্ঘদিন থেকে অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। এ নিয়ে বিডিআর-বিএসএফের উচ্চপর্যায়ে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু কোনো মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি। সীমান্তবর্তী এই ৪শ’ একর জমির দখল নিতে বিএসএফ মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, প্রতিরক্ষা ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই জমি ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অমলসীদে বাংলাদেশ অংশ উঁচু এবং বিপরীতে ভারতের রানীনগর এলাকা নিচু হওয়ায় বিডিআর সবসময় কিছু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। তাই বারবার আক্রমণ করেও ওই ২৫৬ একর জমি দখলে নিতে পারেনি। জৈন্তাপুরের ডিবি ও কেন্দ্রী হাওরের জমিগুলো অত্যন্ত উর্বর হওয়ায় ভারত সেগুলো দখলে নিতে চায়। এই জমি দখলে নেয়ার জন্য মাঝে মধ্যেই ভারতীয় নাগরিকদের নামিয়ে দেয় মাছ ধরতে। এসব নিয়ে কয়েক দফা বিডিআরের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে।
জকিগঞ্জ পৌরসভার পাশে কুশিয়ারার অপর পাড়ে ভারতের করিমগঞ্জ শহর। করিমগঞ্জে মাঝনদীতে জেটি স্থাপন করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। জেটির কারণে কুশিয়ারার স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ধাক্কা খাচ্ছে বিপরীত দিকে হাইদ্রাবন এলাকায়। ফলে ওই এলাকায় নদীভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
সুরমা ও কুশিয়ারার তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড সঠিকভাবে তীর সংরক্ষণ করলে নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব হতো। কোনো কোনো সময় বরাদ্দ না থাকায়, কখনও কখনও বিএসএফের বাধায় সঠিকভাবে নদীর তীর সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এতে করে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে।
জকিগঞ্জের কালীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, পুরো জকিগঞ্জের প্রায় ৩ দিকেই নদী দিয়ে সীমানা চিহ্নিত। এখানে নদী ভেঙে বিপরীত দিকে চর পড়ে যেসব জমি চলে যাচ্ছে, আইনের কারণে সেগুলো আপনাআপনিই ভারতের সঙ্গে মিশে যায়। সেগুলো আর কোনোদিনই ফিরে পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই সরকারের উচিত সীমান্ত নদীর ভাঙনকে প্রাধান্য দিয়ে সঠিকভাবে তীর সংরক্ষণের কাজ করা। তারা আরও বলেন, যেসব এলাকায় নদীর তীরে সঠিকভাবে এমব্যাংকমেন্ট ও রিভেটমেন্ট করা সম্ভব হয়েছে ওইসব এলাকায় ভাঙন অনেকটা রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/28/29498

No comments:

Post a Comment