
30/04/2010
এম আবদুল্লাহ
টেন্ডার ছাড়া ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩টি ভাড়া বিদ্যুেকন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। গতকালের সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়। এর আগে দুটি কোম্পানির সঙ্গে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই করেছে সরকার। ডিজেলচালিত এসব বিদ্যুেকন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুত্ কিনতে গিয়ে তিন বছরে সরকারকে গচ্চা দিতে হবে ৭ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। এ পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে সরকারের কাছে চেয়েছে পিডিবি। অথচ এর আংশিক অর্থ ব্যয় করলে গ্যাসের উত্পাদন বাড়িয়ে গ্যাসভিত্তিক সাশ্রয়ী বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করা যায়। সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় বর্তমান বাজারমূল্যে ১১শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন সম্ভব বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এমনকি দু’মাস বেশি সময় দিয়ে ফার্নেস ওয়েলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করলেও ভর্তুকি অর্ধেকে নামিয়ে আনা যেত। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইসিজিবি) ২ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নের অভাবে সিদ্ধিরগঞ্জে ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি পিকিং প্লান্ট স্থাপন করতে পারছে না দীর্ঘদিন ধরে। তাছাড়া এরই মধ্যে স্থাপিত ব্যয়বহুল রেন্টাল বিদ্যুতের ভর্তুকি দিতেই পিডিবি ফতুর হয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে প্রতিষ্ঠানটি অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
টেন্ডারে পাওয়া অর্ধেক মূল্যের ফার্নেস ওয়েলভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের প্রস্তাব ঝুলিয়ে রেখে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ ১৪ টাকা ৪০ পয়সা দরে কেনার শর্তে ‘কুইক রেন্টাল’ নামে টেন্ডারবিহীন ডিজেলভিত্তিক যে বিদ্যুেকন্দ্র বসানো হচ্ছে, তার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ব্যয়বহুল বিদ্যুেকন্দ্র ৩টি যখন চালু হবে, তখন শীত মৌসুমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা এমনিতেই কমে আসবে। কয়েকটি গ্যাসকূপ সংস্কার করে উত্পাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারি খাতের গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকেও উত্পাদন ৫শ’ মেগাওয়াট পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এসব সাশ্রয়ী বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ে গোটা বিদ্যুত্ খাতকে আর্থিক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলেও মতপ্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তীব্র বিদ্যুত্ সঙ্কটে গণঅসন্তোষের মুখে পড়া সরকার দ্রুত বিদ্যুত্ ভোগান্তি সহনীয় পর্যায়ে আনতে তোড়জোড় চালাচ্ছে। কিন্তু সরকারি তত্পরতায় কেবল স্বল্পমেয়াদি ব্যয়বহুল ব্যবস্থাই প্রাধান্য পাচ্ছে। সরকারি ও আইপিপি খাতের বড় প্রকল্পগুলোর তেমন কোনো অগ্রগতিই হচ্ছে না। এ অবস্থায় হঠাত্ করেই সরকার বিনা টেন্ডারে বিদ্যুেকন্দ্র বসাতে তত্পর হয়ে ওঠে। রাতারাতি আলোচনা করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে খুলনায় ১০০ মেগাওয়াট ও ঘোড়াশালে ৩ বছর মেয়াদি ১০০ মেগাওয়াট রেন্টাল কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দেয়া হয়েছে। ২০ এপ্রিল এ সংক্রান্ত প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ দুটি কাজ দেয়ার সময় বলা হয়েছিল কেবল অভিজ্ঞ বিদেশি কোম্পানিকে বিনা টেন্ডারে আলোচনার মাধ্যমে দেয়া হবে। এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার সে অবস্থান থেকে সরে এসে একইভাবে বিনা টেন্ডারে দেশ এনার্জি লিমিটেডের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩ বছর মেয়াদি রেন্টাল কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। দেশ এনার্জির মালিক এফবিসিসিআই সভাপতি আনিসুল হক।
এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ১ম মাস থেকে ২৭তম মাস পর্যন্ত পিডিবি তাদের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ কিনবে ১৪ দশমিক ৪০২৫ টাকা হারে। ২৮তম মাস থেকে ৩৬তম মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের মূল্য হবে ইউনিটপ্রতি ১৪ দশমিক ৩৫৬২ টাকা। দেশ এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত প্রাথমিক চুক্তিতে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারিত হয়েছে প্রতি ইউনিট ১৩ দশমিক ৩২৯২৫ টাকা। অথচ মাত্র কয়েকদিন আগে ডিজেলচালিত ভেড়ামারা ১১০ মেগাওয়াটের জন্য চুক্তি করা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ১২ দশমিক ৫৮৯৬ টাকায়।
বর্তমানে পিডিবি বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ বিক্রি করছে গড়ে ২ টাকা ৩৭ পয়সা দরে। এগ্রিকো থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ নিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে প্রতি মাসে ১৪০ কোটি ৪০ লাখ ৪১ হাজার টাকা করে লোকসান দিতে হবে। আর দেশ এনার্জি থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ নিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করলে পিডিবির মাসিক লোকসান হবে ৬৪ কোটি টাকা। অর্থাত্ ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ক্রয়-বিক্রয় খাতে পিডিবির মাসিক লোকসান ২০৪ কোটি ৪০ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এ অর্থ সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি হিসেবে চেয়েছে পিডিবি। এ হিসেবে সরকারকে ৩ বছরে এই ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য নিট গচ্চা দিতে হবে ৭ হাজার ৩৫৮ কোটি ৫৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের জন্য পেশকৃত সারসংক্ষেপ থেকে এ হিসাব পাওয়া গেছে।
এখানে উল্লেখ্য, তীব্র বিদ্যুত্ সঙ্কট মোকাবিলায় জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে সরকার প্রথমে তেলভিত্তিক ৮টি রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। ৫৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এসব বিদ্যুেকন্দ্র চলতি গরমের মৌসুম শুরুর আগেই চালুর কথা ছিল। কিন্তু টেন্ডার আহ্বান, মূল্যায়ন ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে এসব রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের মূল লক্ষ্যই ভেস্তে যায়। তবুও বিলম্বে ৫টি কেন্দ্রের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তন্মধ্যে ৪টি স্থাপনের কাজ চলছে। একটির ঠিকাদার (জামালপুর) অপারগতা জানিয়েছে। বাকি ৩টি সিদ্ধান্তহীনতায় এখনও ঝুলে আছে। সেগুলো সময়মত কার্যাদেশ দিলে আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে ৭ থেকে ৮ টাকা দরে বিদ্যুত্ পাওয়া সম্ভব হতো বলে পিডিবি সূত্র জানিয়েছে।
ঝুলে থাকা বিদ্যুেকন্দ্র ৩টি হচ্ছে মদনগঞ্জ ১১০ মেগাওয়াট, রাজশাহীর কাটাখালী ৫০ মেগাওয়াট ও সৈয়দপুর ৫০ মেগাওয়াট। ফার্নেস ওয়েলভিত্তিক এসব রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের প্রস্তাব ছিল ৭ থেকে ৮ টাকার মধ্যে।
এদিকে সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, মদনগঞ্জ ১১০ মেগাওয়াট রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য সামিটের সঙ্গে গতকাল প্রথমিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে না দিয়ে বেশি দরে সামিটকে দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, সামিটের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ৭ টাকা ৯৬ পয়সা দরে। অথচ টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে নেগোসিয়েশনে ৭ টাকা ৭৭ পয়সা দর পাওয়া গিয়েছিল। বেশি দরে সামিটকে কাজ দেয়ার কারণে এক্ষেত্রে দৈনিক ৬ লাখ টাকা করে বছরে ২০ কোটি টাকা এবং ৫ বছরে ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত গুনতে হবে সরকারকে। কেবল দলীয় বিবেচনায় এটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া সামিটের মালিকানাধীন খুলনা পাওয়ার কোম্পানিকে আরও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের দর নির্ধারিত হয়েছে ৭ টাকা ৮০ পয়সা। সাভারের কবিরপুরে ১০০ মেগাওয়াটের আরও একটি ফার্নেস ওয়েলভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ওরিয়ন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
এসব বিষয়ে পিডিবি বা বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। পিডিবি চেয়ারম্যান এসএম আলমগীর কবিরের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার মোবাইল ফোনে বার বার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবি এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাদের উদ্বেগ ও অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/30/29796
No comments:
Post a Comment