Tuesday 16 March 2010

কথা রাখেনি বিএসএফ, জৈন্তাপুরে গুলি, ১৯ বাংলাদেশি আহত


Photo:http://www.amardeshonline.com/pages/home/2010/03/15


বিএসএফের গুলিতে আহত বাংলাদেশি গ্রামবাসীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত এলাকা থেকে গতকাল ছবিটি তুলেছেন আনিস মাহমুদ|


নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি | তারিখ: ১৫-০৩-২০১০

নয়াদিল্লিতে বিডিআর-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন শেষ হওয়ার তিন দিনের মাথায় সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার দুপুরে জৈন্তাপুরের ডিবির হাওরে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। এ সময় ভারতীয় খাসিয়াদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের কয়েক দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পাথর ছোড়াছুড়ি ও সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে বিএসএফের গুলিতে ১৯ বাংলাদেশি আহত হয়।
তবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে অন্তত আট বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সিলেট সেক্টরের উপ-অধিনায়ক মেজর মো. কোহিনূর আলম জানান।
আহত ব্যক্তিদের জৈন্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ব্যাপক গুলিবিনিময়ের ঘটনায় ডিবির হাওর গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী ঘিলারতইল, নিজপাট ও ফুলবাড়ী গ্রামের মানুষজন আতঙ্কে নিরাপদ স্থানে সরে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুপুর দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা ২৫ মিনিট পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। এরপর বিএসএফ সীমান্তের ওপারে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পরিখা খনন করে অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিডিআরও সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বিডিআর-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের পাঁচ দিনের বৈঠক ১১ মার্চ দিল্লিতে শেষ হয়। ওই বৈঠকে বিএসএফ সীমান্তে আর গুলি করবে না বলে আশ্বাস দেয়। কিন্তু কথা রাখেনি তারা। তারা বিরোধপূর্ণ জমিতে অনুপ্রবেশ না করারও প্রতিশ্রুতি দেয়। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুই দেশ যৌথ জরিপ চালাতে মতৈক্যে পৌঁছায়।
যোগাযোগ করা হলে বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গুলিবিনিময়ের পর তিনি বিএসএফের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁকে পাননি। তিনি জানান, মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকের পর সীমান্ত চিহ্নিতকরণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। সেটা শুরু হলে সহিংস ঘটনা আর ঘটবে না।
এ বিষয়ে ভারতের মন্তব্য জানতে প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনা নিয়ে বিএসএফের কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন। কী করে এ ঘটনা ঘটল, বিএসএফ সদর দপ্তর থেকে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
গত শনিবার গোয়াইনঘাট সীমান্তের পাদুয়ায় পরিখা খননকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বিডিআর-বিএসএফ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। পরদিনই জৈন্তাপুর সীমান্তের ডিবির হাওর এলাকায় ভারতীয় খাসিয়াদের অনুপ্রবেশ ঘটে। ডিবির হাওরে ১২৮৩ থেকে ১২৮৫ সীমান্ত পিলারের ভেতরে দুপুর প্রায় ১২টায় ১০-১২ জন ভারতীয় খাসিয়া মাছ ধরতে বিএসএফের সহায়তায় অনুপ্রবেশ করে। এ সময় তাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের পাথর ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
ভারতীয় খাসিয়াদের ছোড়া পাথরে সোলেমান মিয়া নামের এক ব্যক্তি চোখে আঘাত পান। বিডিআর তখন স্থানীয় মানুষের সহায়তায় অনুপ্রবেশকারীদের তাড়া করলে বিএসএফ গুলি ছোড়ে। বিএসএফের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিডিআরও পাল্টা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে দুপুর একটায় বিএসএফ ভারতীয় খাসিয়াদের নিয়ে পিছু হটে।
এ ঘটনার ঘণ্টাখানেক পর বিএসএফ শতাধিক ভারতীয় খাসিয়াকে নিয়ে আবার ডিবির হাওরে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে মাছ ধরার চেষ্টা চালায়। এ সময় ডিবির হাওর ও ঘিলাতইল গ্রামবাসী খাসিয়াদের বাধা দেয়। এতে সংঘর্ষ বেধে গেলে বিএসএফ বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। তখন হাওরপারে মন্দিরটিলা এলাকায় অবস্থান নেয় অনেক বাংলাদেশি। আর ঘটনাস্থলে থাকা খাসিয়ারা ভারতে ফিরে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিএসএফের অতর্কিত গুলিবর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে বিডিআরও পাল্টা গুলি ছোড়ে। বিএসএফের গুলিতে ১৮ বাংলাদেশি আহত হয়। এর মধ্যে ঘিলারতইল গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম (৪৫) নামের একজনকে সন্ধ্যায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি ১৫ জনকে জৈন্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান (৬০), মোহাম্মদ রশিদ (২০), মনির হোসেন (২০), মনির মিয়া (২৫), রাম বিশ্বাস (২৫), মো. মতিন (২০), আবদুর রহমান (২২), আখতার হোসেন (১৭), লালা মিয়া (২৫), রাসেল আহমদ (২৫), আবদুর রহিম (২৬), সুমন মিয়া (২৭), গোলাম রহমান (৫০), আজগর মিয়া (৩০), আকদ্দস আলী (২৮), কবির আহমদ (২৫), মো. লোকমান (২৩) ও মাসুক মিয়া (৩০)। এদের সবার বাড়ি ডিবির হাওর, ঘিলারতইল, নিজপাট ও ফুলবাড়ি গ্রামে।
জৈন্তাপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে জানান, আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরকারি খরচে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় চিকিত্সা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঘটনা সম্পর্কে বিডিআর সদর দপ্তর সিলেটের জিএসও-২ (জেনারেল স্টাফ অফিসার) মেজর কোহিনূর আলম জানান, বিএসএফের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিডিআরও পাল্টা গুলি ছুড়ে জবাব দেয়। তিনি জানান, ভারতীয় খাসিয়াদের নিয়ে বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে। পরিস্থিতির কারণে বিডিআর সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ঘটনার পরপরই বিএসএফ বেশ কয়েকটি পরিখা খনন করে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে অবস্থান নেয়। নিজপাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মখলিছুর রহমান জানান, ডিবির হাওরসহ চারটি গ্রামের মানুষ নিরাপদে সরে গেছে।
৪ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি জৈন্তাপুর উপজেলার ডিবির হাওর ও কেন্দ্রীয় হাওরে ভারতীয় খাসিয়াদের মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে কয়েক দফা গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে বিডিআর-বিএসএফের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে ২ মার্চ বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম বিরোধপূর্ণ ডিবির হাওর সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে সিলেটে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি বলেছিলেন, ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত দিল্লিতে বিডিআর-বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠকে বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে সমাধান করা হবে। দিল্লিতে বৈঠক চলাকালেও ৭ ও ৮ মার্চ ডিবির হাওরে বিএসএফের সহায়তায় ভারতীয় খাসিয়ারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরার চেষ্টা করেছিল।
ডিবির হাওরে এ বিরোধের পাশাপাশি গত শুক্রবার রাতে জৈন্তাপুর উপজেলা পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতাপপুর সীমান্তের পাদুয়ায় পরিখা খনন নিয়ে বিডিআর-বিএসএফের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। শনিবার দুপুরে বিডিআর-বিএসএফের ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হয়।
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-03-15/news/49013

No comments:

Post a Comment