Wednesday 31 March 2010

বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সহস্রাধিক ছোট পোশাক কারখানা : ২০ গুণ বেশি খরচে পণ্য যাচ্ছে আকাশ পথে

সৈয়দ মিজানুর রহমান
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ৮টা। গতকাল রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, ফ্লোরে শ্রমিকরা বসে অলস আড্ডা দিচ্ছেন। মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন মালিকও। মেশিন আছে, শ্রমিকও আছে—নেই বিদ্যুত্। তাই উত্পাদন বন্ধ। অপেক্ষা আবার কখন বিদ্যুত্ আসবে, তো চলবে মেশিন। ‘কানন ফ্যাশন’ নামের এ পোশাক কারখানার মালিক আল আমিন জানালেন, ‘রোজই এভাবে বিদ্যুতের জন্য কাজ বন্ধ রেখে বসে থাকেন শ্রমিকরা। কারখানায় জেনারেটর নেই। ফলে বিকল্প ব্যবস্থাও নেই উত্পাদন ঠিক রাখার। উত্পাদন কমে গেলেও শ্রমিকদের বেতন, ভাড়া করা ভবনের মাসিক ভাড়া ও অন্যান্য রুটিন খরচ ঠিকই হচ্ছে। গত দুই মাস সময়মতো প্রডাকশন করতে না পারায় বড় দুটি কারখানার সাব-কন্ট্রাক্টের অর্ডারও বাতিল হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বড়জোড় আর ৩ মাস কারখানা ধরে রাখা যাবে।’ গতকাল সারাদিনের বিদ্যুতের হিসাব দিয়ে কানন ফ্যাশনের মালিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় টেলিফোনে আরও জানান, গতকাল সকাল ৭টায় বিদ্যুত্ চলে যায়, আসে বেলা ১১টায়। আবার দুপুর ১টায় বিদ্যুত্ চলে যায়, আসে পৌনে ৩টায়। বিকাল ৪টায় আরেক দফা লোডশেডিং শুরু হয়, চলে টানা ৬টা পর্যন্ত।
জানা গেছে, রায়েরবাজার এলাকায় গত ২-৩ মাস আগেও কর্মদিবসের (সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা) ৩-৪ ঘণ্টা শ্রমিকরা বসে থাকতেন বিদ্যুতের অপেক্ষায়। আর এখন বসে থাকতে হচ্ছে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা। একটি কর্মদিবসে উত্পাদন চালু রাখা যাচ্ছে ২-৩ ঘণ্টা। এতে উত্পাদন কমেছে প্রায় ৭০ ভাগ।
শুধু কানন ফ্যাশনই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পোশাক কারখানাগুলোর অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। বিশেষ করে ছোট কারখানাগুলো টিকে থাকার মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, বছরে সাড়ে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে যেসব কারখানা রফতানি আয় করে, তাদের ছোট কারখানা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এরকম ওভেন গার্মেন্ট কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ২৫৯টি।
অন্যদিকে নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) হিসাব মতে, ছোট নিট কারখানা আছে ৩১৭টি।
এসব ছোট পোশাক কারখানার ৮০ ভাগই জেনারেটর নেই। বাকি ২০ ভাগ কারখানার জেনারেটর আছে ব্যাকআপ হিসেবে (২-৩ ঘণ্টার বেশি চলে না)।
বিজিএমইএ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল আমার দেশকে বলেন, ‘বিদ্যুতের অভাবে ছোট ছোট পোশাক কারখানাগুলো মরে যাচ্ছে। কারণ বিদ্যুত্ না থাকলে এসব কারখানার উত্পাদন পুরোপুরি বন্ধ থাকে। আর এসব ছোট কারখানার সাপোর্ট নিয়ে বেঁচে আছে বড় বড় কারখানাগুলো।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণত ছোট কারখানাগুলো সাব-কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে বড় বড় কারখানার প্রায় অর্ধেক কাজ করে থাকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে গত ২-৩ মাস ধরে বড় কারখানাগুলোও তাদের পণ্য ডেভিভারির ডেটলাইন ঠিক রাখতে পারছে না। এতে নিরুপায় হয়ে সমুদ্রপথে মাল না পাঠিয়ে, ক্রেতা ধরে রাখতে পাঠানো হচ্ছে আকাশপথে।
বিজিএমইএ’র হিসাব মতে, ভাড়া করা বিমানে প্রতিকেজি পণ্য পাঠাতে ব্যয় করতে হচ্ছে সাড়ে ৪ মার্কিন ডলার, যা সমুদ্রপথে জাহাজে পাঠালে খরচ হয় মাত্র ২০ থেকে ২২ সেন্ট। আর এভাবে প্রায় ২০ গুণ বেশি খরচ করে রফতানি করতে গিয়ে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে ক্রেতাদের আস্থাও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
ছোট কারখানাগুলোর সহায়তায় বিদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের রফতানি বাজার ধরে রাখছে ক্লাসিক গ্রুপ। এ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র পরিচালক শহিদুল্লাহ আজিম গতকাল আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা গত ২ মাস আগেও ৫টি ছোট কারখানায় সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করিয়ে পোশাক রফতানি করতাম। এখন ৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এরা লোকসান দিয়ে কারখানা চালাতে পারছে না। এ কারণে বিদেশ থেকে যে পরিমাণ রফতানি অর্ডার নেয়া হয়েছিল, তার অর্ধেকও ঠিক সময়ে রফতানি করা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি হলে ক্রেতারা আস্থা হারিয়ে অন্যত্র চলে যাবেন।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জানিয়েছে, গত নভেম্বরে তারা ১ হাজার ৪৮৪ টন রফতানি পণ্য বিদেশে পাঠিয়েছে। ডিসেম্বরে বিমানে পণ্য পরিবহন হয়েছে ৮৬৫ টন। গত জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৯০ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে এ পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩০১ টন। আবার ভাড়া করা কার্গো বিমানে গত নভেম্বরে রফতানির জন্য পণ্য পরিবহন করা হয়েছে ৭ হাজার ২০৭ টন, ডিসেম্বরে ৪ হাজার ৯৯৩ টন, জানুয়ারিতে ৭ হাজার ৮ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে আকাশপথে রফতানির জন্য পণ্য পরিবহন হয়েছে ৭ হাজার ৩২১ টন। বিমানে পাঠানো পণ্যের ৯৮ ভাগই তৈরি ও নিট পোশাক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পোশাক খাতের এ জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, সাড়ে ৪ হাজার পোশাক কারখানার অর্ধেকই এখন বিপদে। এদের মধ্যে ছোট ছোট কারখানাগুলো ধার-দেনা করে কোনোরকম টিকে আছে। বড় বড় কারখানা থেকে শুরু হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাই। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে দেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান, অবিলম্বে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সহায়তা দেয়ার। এছাড়া বড় বড় কারখানার জন্য বিনাশুল্কে ডিজেল আমদানির সুযোগ বা সরকারের তরফ থেকে শুল্কমুক্ত ডিজেল সরবরাহেরও দাবি জানান বিজিএমইএ সভাপতি।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/01/25332

No comments:

Post a Comment