Sunday 28 March 2010

পানির জন্য হাহাকার


বিদ্যুতের অভাবে ঢাকা ওয়াসার পাম্পগুলো ঠিকমতো পানি তুলতে পারছে না। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে পানির সংকট। পানির জন্য গতকাল দুপুরে মুগদাপাড়ায় ওয়াসার পাম্পের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি
ছবি: সাহাদাত পারভেজ


অরূপ দত্ত | তারিখ: ২৯-০৩-২০১০ Prothomalo

বিদ্যুতের অভাবে ঢাকা ওয়াসার পাম্পগুলো দিনে গড়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা চালু থাকছে। এই মৌসুমে ৫৩৯টি পাম্প প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা করে চালু রাখার কথা। ফলে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে বেশি। গরম পড়তে না-পড়তেই রাজধানীতে পানির সংকট চরমে পৌঁছেছে। এত দিন অনেক এলাকায় দুর্গন্ধময় পানি এলেও এখন সেটাও নেই। সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা।
ওয়াসার কাছে গাড়ির পানি চেয়ে যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়ছে, ২৪ ঘণ্টায় তার এক-তৃতীয়াংশও পৌঁছানো যাচ্ছে না। পানির চাহিদার কথা জানানোর জন্য অভিযোগ কেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। অতীতের তুলনায় অনেক বেশি পানির কষ্ট দেখা দেওয়ায় নগরবাসী ঢাকা ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে ভিড় করছে এবং প্রতিদিন প্রচুর অভিযোগ জমা পড়ছে। বর্তমানে পানির চাহিদা প্রায় ২৫০ কোটি লিটার। ওয়াসা কাগজে-কলমে দাবি করছে, ১৯৫ কোটি লিটার পর্যন্ত উৎপাদিত হচ্ছে। তবে দায়িত্বশীল সূত্রমতে, ১৭০ কোটি লিটারের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
পানির সমস্যা সম্পর্কে জানতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব গতকাল রোববার ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের তাঁর কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। আগামী বুধবার ঢাকার সাংসদ ও কাউন্সিলরদের নিয়ে ওয়াসা বৈঠক করবে বলেও জানা গেছে। এদিকে পানির সংকট মোকাবিলায় আগামী ১ এপ্রিল থেকে ওয়াসার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, আঞ্চলিক কার্যালয়, বিভিন্ন পাম্পহাউসে সেনা মোতায়েন করা হবে।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান পানি সমস্যার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, সেনাবাহিনী এ বিষয়ে সাহায্য করতে সম্মত হয়েছে।
দুই হাজার ঘণ্টা পাম্প বন্ধ: চলতি মৌসুমে ওয়াসার ৮০টি পাম্পে দুটি বিদ্যুৎ লাইন বা ফিডার থেকে সংযোগ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরও ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ না থাকায় গত কয়েক দিনে ওয়াসার গভীর নলকূপের সব পাম্প গড়ে দুই হাজার ঘণ্টারও বেশি সময় বন্ধ ছিল। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রধানত বিদ্যুতের কারণে পানির উত্তোলন অনেক কমে গেছে। তিনি একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ বিদ্যুতের কারণে দিনে সবগুলো পাম্প মিলে গড়ে ৪৯৩ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। গত বছর বন্ধ ছিল এক হাজার ৪৬৩ ঘণ্টা। আর গত ২৩ মার্চ বন্ধ ছিল দুই হাজার ২০৪ ঘণ্টা।
জানা যায়, ওয়াসার ৫৩৯টি পাম্পের মধ্যে ২৩৪টিতে জেনারেটর রয়েছে এবং ভ্রাম্যমাণ জেনারেটর আছে ৬০টি। এগুলোর উত্তোলন ক্ষমতা স্বাভাবিক বিদ্যুতের ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম। ওয়াসার সূত্রমতে, গভীর নলকূপের একটি পাম্প চালাতে ৪২০ ভোল্ট বিদ্যুতের দরকার হলেও অনেক স্থানেই বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৩৮০ ভোল্টের নিচে। কিছু পাম্পের অপারেটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দিনে দুই ঘণ্টার বেশি জেনারেটর চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে পানির সমস্যার অন্য কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রতিবছরই এই মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় লাইনে চাপ কম থাকে। এ ছাড়া অবৈধ সংযোগ নিয়ে অনেক গ্রাহক পানির অপচয় করছে বলে বৈধ গ্রাহকেরা পানি পাচ্ছেন না।
পানির গাড়ির আবেদন: ওয়াসার পানির গাড়ি রয়েছে ৩১টি। গতকাল পানির গাড়ির জন্য আবেদন আসে ৬২৭টি। উত্তরা অঞ্চলের ১৫১টি চাহিদার মধ্যে ১৯, গুলশানে ৯৯টির বিপরীতে ৩৩, ধানমন্ডি-লালমাটিয়ায় ৮৪টির ক্ষেত্রে ৩৭টি গাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়।
অসন্তোষ: রাজধানীর অপেক্ষাকৃত সাধারণ এলাকা তো বটেই, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায়ও পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ওয়াসার ভ্রাম্যমাণ জেনারেটরগুলো প্রধানত এসব এলাকায় ঘুরে বেরিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারছে না। ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কের বাসিন্দা মো. সেলিম বলেন, ঢাকা যে ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে, তা পানি সরবরাহের অবস্থা দেখে বোঝা যায়। তাঁদের বাড়িতে টানা পাঁচ দিন এক ফোঁটা পানিও সরবরাহ নেই বলে জানান তিনি।
উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে পানির অভাবে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। মাসকাট প্লাজার পেছনে বহুতল বিপণিবিতান নর্থ প্লাজায় গত শনিবার পানির দাবিতে দোকানপাট বন্ধ রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ওয়াসা গাড়িভর্তি পানি সরবরাহ করায় দোকানপাট বন্ধ হয়নি। এ বিষয়ে ওয়াসার একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা দাবি করেন, বিরোধীদলীয় সাবেক এক সাংসদ ওই ভবনের মালিক। এত বড় ভবনে নিজস্ব গভীর নলকূপ বসাতে হয়। কিন্তু ওয়াসার কাছে এ ব্যাপারে কোনো আবেদন জানানো হয়নি।
এদিকে নাখালপাড়া এলাকাবাসীও গত শুক্রবার দুপুরে পানির দাবিতে বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। সেখানে প্রায় এক মাস ধরে পানির কষ্ট। পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসিন্দারা কলসি মিছিল করার জন্য তৈরি হয়েছেন, এ খবর পেয়ে ওয়াসা দ্রুত পানিবাহী গাড়ি নিয়ে হাজির হয়। গতকাল বিকেলে মিছিল করার কথা ছিল বলে পশ্চিম নাখালপাড়ার বড় মসজিদের গলির কয়েকজন বাসিন্দা প্রথম আলোর কার্যালয়ে ফোন করে জানান। কিন্তু সেখানে পুলিশ মোতায়েন করায় মিছিল হয়নি। বাসিন্দারা বলেন, পুলিশ কত দিন এভাবে আটকে রাখবে?
রাজধানীর আরও অনেক এলাকায় বর্তমানে পানির প্রকট সমস্যার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১, ২, ১০ নম্বরসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকা, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, কল্যাণপুর, পাইকপাড়া, জনতা হাউজিং, শাহ আলীবাগ, মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট, পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার আহম্মেদ নগর, বাসাবো, কদমতলা, খিলগাঁও, রামপুরা, হাজীপাড়া, মানিকনগর, মুগদা, পুরান ঢাকার গোপীবাগ, ওয়ারী, নারিন্দা, তাঁতীবাজার, রাজার দেউড়ি, গোয়ালনগর, পানি টোলাসহ প্রায় সব এলাকা, মধ্য ঢাকার বাংলামোটরসংলগ্ন ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ইন্দিরা রোড, পশ্চিম রাজাবাজার, ধানক্ষেত মোড়সহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা, মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোড প্রভৃতি এলাকা। ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কের ব্যবসায়ী নাসরাত আলী জানান, ১০ দিন ধরে পানির কষ্ট। পানির অভাবে বাড়িতে সব ধরনের কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-03-29/news/52397

No comments:

Post a Comment