Saturday 27 March 2010

বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৭০ ভাগ



সৈয়দ মিজানুর রহমান
দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক প্রতিবেদন (মার্চ মাস) থেকে জানা গেছে, গত অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যেখানে এফডিআই ছিল ৬০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে চলতি (২০০৯-১০) অর্থবছরের একই সময়ে বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৯৭ মিলিয়ন ডলার।
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কট, দুর্বল অবকাঠামো ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই এজন্য দায়ী।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতামত হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাও কাটেনি। ফলে আগামী দেড়/দু’বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ খুব একটা আশা করা যায় না।
উদ্যোক্তারা জানান, বিনিয়োগের প্রধান শর্তই হচ্ছে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও সুষ্ঠু পরিবেশ। কিন্তু গত প্রায় চৌদ্দ মাসে সরকার সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। অবকাঠামোগত সমস্যা, বিদ্যুত্, গ্যাস সঙ্কটের পাশাপাশি শিল্প-কলকারখানায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের কারণে ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি জিম্মি হয়ে আছেন। তারা বলেন, পুঁজির নিরাপত্তা না থাকলে কোনো উদ্যোক্তাই বিনিয়োগ করবেন না। গত এক বছরে দেশে নতুন করে বিনিয়োগ করার চেয়ে বিদ্যমান কারখানাগুলোর উত্পাদন ব্যবস্থা ধরে রাখতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।
গ্যাস সঙ্কটের কারণে দেশের অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস রেশনিং করেও সমস্যার সমাধান মিলছে না। অদূর ভবিষ্যতে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করছেন না উদ্যোক্তারা।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বার সভাপতি আফতাবুল ইসলাম মনে করেন, দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগের বাধা এখন তিনটি। এগুলো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের ভয়াবহ সঙ্কট, দুর্বল অবকাঠামো ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি। তিনি জানান, ‘গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনামলে সাধারণত বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এবারের বাস্তবতা হলো, বর্তমান সরকার প্রায় ১৪ মাস দায়িত্ব পালন করলেও জ্বালানি খাত বা অবকাঠামোর তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।
জ্বালানি সমস্যা সমাধানে তিনি দ্রুত কয়লা নীতি প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে বলেন, এখন দেশি বিনিয়োগকারীরাই ঠিকমতো গ্যাস-বিদ্যুত্ পাচ্ছেন না। ফলে বিদেশিদের বিনিয়োগের সুযোগ কি করে হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘খারাপ।’ কারণ মানুষের হাতে কাজ নেই। এখন কোনো একটা টেন্ডার হলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা অন্য দলের শ’খানেক নেতাকর্মী সেটির পেছনে ছোটেন। কর্মসংস্থান হলে সেটি আর হবে না। আর এটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জন্য বেশি দায়ী।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে জানান, আগামী দেড়-দু’বছরের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ খুব একটা আশা করা যাবে না। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এটা হয়েছে। আর মন্দা আগামী ২০১১ সালজুড়েই থাকবে। কোনো কোনো দেশ নিজেরাই ঘোষণা দিচ্ছে মন্দা থেকে তারা বেরিয়ে গেছে। বাস্তবতা ভিন্ন। কারণ, এখনও লাখ লাখ লোক বেকার। এছাড়া স্থানীয়ভাবে বিদ্যুত্ ও গ্যাস পরিস্থিতির যে নাজুক অবস্থা চলছে, তাও সহসায় উন্নতির লক্ষণ নেই। তিনি বলেন, সিপিডি সরকারকে এরই মধ্যে ৭টি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দুটি ছিল গ্যাস-বিদ্যুত্ ও অবকাঠামো সমস্যা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি দেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। স্থানীয় বিনিয়োগ না বাড়লে কোথাও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে না। আমরা স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছি। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে, আশা করছি তা কেটে যাবে।
ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আনিসুল হক বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থাই পুরোপুরি ফেরেনি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে কী করে। সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে সবার আগে গ্যাস ও বিদ্যুত্সহ অবকাঠামো খাতের সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুত্ সমস্যার কারণে দেশি বিনিয়োগকারীরাই যেখানে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবেন কোন সাহসে?’
বিনিয়োগে বাধা : অবকাঠামোগত অসুবিধা, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সঙ্কটের পাশাপাশি প্রক্রিয়াগত দিকেও রয়েছে নানা বাধা। বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, সেগুলো বিনিয়োগবান্ধব নয়। এছাড়া বারবার ঘোষণা দিয়েও এখন পর্যন্ত সরকার শিল্পনীতি ঘোষণা করতে পারেনি। শিল্পনীতি ঘোষণা না হওয়ায় উদ্যোক্তারাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। এদিকে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, খুন-খারাবি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি যেভাবে হচ্ছে তাতে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকার বেরিয়ে আসতে না পারার কারণে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সামনে বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী, শিল্প উদ্যোক্তা ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি বলেন, গত এক বছরে বিদ্যুত্ খাতের কোনো উন্নতি হয়নি বরং গ্যাসখাতের ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে দেশের সড়ক যোগাযোগ। ফলে নতুন কোনো শিল্প হয়নি। স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের ন্যূনতম সুযোগও পাচ্ছেন না। সে ক্ষেত্রে বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আশাই করা যায় না। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবমিলে বিনিয়োগের কোনো পরিবেশই এখন নেই।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট শাহেদুল ইসলাম হেলাল বলেন, ২০০৯ সালে শিল্পখাতে দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এটি সরকারও স্বীকার করছে। বিদ্যুত্ না থাকায় কোনো উদ্যোক্তাই শিল্প বিনিয়োগে এগিয়ে আসেনি। এ বছর ছিল বিনিয়োগের স্থবির সময়। শিল্পখাতে বিনিয়োগ করতে না পারায় জমিজমা, নির্মাণ শিল্পে এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, তার চেয়ে বেশি অর্থ তুলে নিয়ে গেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এই সময়ে শেয়ারবাজার থেকে নিট বিনিয়োগ তুলে নেয়ার পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ১০ লাখ ডলার (প্রায় পৌনে তিনশ’ কোটি টাকা)। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ারবজার থেকে ৪ দশমিক ৭ কোটি ডলার (সোয়া তিনশ’ কোটি টাকা) বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আলোচ্য সময়ে দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ হয়েছে সাড়ে ৪৫ কোটি ডলার (৩ হাজার কোটি টাকার বেশি)। অন্যদিকে আগের বছর এ খাতে বিপুল অর্থ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর পরিমাণ ৪৭ কোটি ডলার (প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা)।
জানা গেছে, বিদেশি উদ্যোক্তাদের প্রস্তাবও খুব একটা জমা পড়ছে না বিনিয়োগ বোর্ডে। গত দুই-তিন বছরের তিক্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং জ্বালানি সঙ্কটের আশঙ্কায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বললেই চলে।
এদিকে গ্যাস ও বিদ্যুত্ বেশি ব্যবহার হয়, এমন শিল্প ইউনিটের পরিবর্তে সেবাখাতে বিনিয়োগ পেতে আগ্রহী বিনিয়োগ বোর্ড। বিনিয়োগ বোর্ড মনে করছে, এদেশে বিদ্যুত্ ও গ্যাস সরবরাহে সীমবদ্ধতা রয়েছে। তাই বিদ্যুত্ ও গ্যাস অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহার হয় এমন শিল্পখাতে এফডিআই কাম্য। এক্ষেত্রে আইটি, এলিভেটেভ এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার নির্মাণসহ বিভিন্ন সেবাখাতে এফডিআই আশা করে বিনিয়োগ বোর্ড।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/03/28/24776

No comments:

Post a Comment