Sunday 21 March 2010

নদীর দেশে এখন পানির অভাব!



অমিতোষ পাল
Kalerkantho | ঢাকা, সোমবার, ৮ চৈত্র ১৪১৬, ৫ রবিউস সানি ১৪৩১, ২২ মার্চ ২০১০
বাংলাদেশে একসময় নদী ছিল এক হাজার ৩০০টি। বিভিন্ন বই-পুস্তকে ৭৫৯টির নাম পাওয়া যায়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডবি্লউটিসি) হিসাব অনুযায়ী স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও প্রায় ৩৫০টি নদীর অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু গত ৩৮ বছরে ১১৩টি নদী পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। এর পাশাপাশি ভরাট করা হয়েছে বিভিন্ন খাল-বিল ও জলাশয়। নষ্ট হয়ে গেছে মিঠা পানির উৎস। ফলে দিন দিন সুপেয় ও নিরাপদ পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। দেশের অনেক স্থানে নলকূপেও পানি ওঠে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানি উঠছে না। আবার যেগুলোতে উঠছে, আর্সেনিকের কারণে তার অনেকটাই পানের উপযোগী নয়। শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামাঞ্চলেও শুরু হয়েছে পানির জন্য হাহাকার। লাখ লাখ মানুষের জন্য খাবার পানি জোগানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে।
বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ পানির সংকট দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এটি এখন মানুষের মৌলিক অধিকারের অংশ হিসেবে চিহ্নিত হতে চলেছে। পানির অভাব প্রভাব ফেলেছে জীববৈচিত্র্যের ওপরও। এর সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সমস্যা। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিলম্বের কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, 'সুপেয় ও ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, এ সমস্যা সমাধানের শর্টকাট কোনো রাস্তা এখন আর খোলা নেই। আমরা প্রকৃতির সঙ্গে অনেক ধরনের বৈরী আচরণ চালিয়ে যাচ্ছি। অথচ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছি না। এ রকম চলতে থাকলে সমস্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। একদিকে পানির পর্যাপ্ততা কমছে, অন্যদিকে মানও নিম্নমুখী হচ্ছে।'
উন্নয়নকর্মী জোশেফ হালদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ মুহূর্তে আমাদের নদীগুলো বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। নদীর অস্তিত্বের সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে। কিন্তু পানিসম্পদ, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ_এ ধরনের পাঁচ-সাতটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে নদী বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ছে।'
সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণ ও স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন এনজিও ফোরামের গবেষণামতে, প্রতি বছরই দেশে আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার বিস্তৃতি ঘটছে। ২০০৮ সালের হিসাবে দেশের ৪৮২ উপজেলার মধ্যে ২১৫ উপজেলায় পানিতে বিষাক্ত আর্সেনিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬৩।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, আর্সেনিকের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে দেশের ৪০ লাখ নলকূপের ১১ লাখ দুই হাজার নলকূপ লাল রঙের বিপজ্জনক চিহ্ন দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব এলাকার মানুষকে এখন দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, মৌলভীবাজার, নোয়াখালীর অংশবিশেষসহ দেশের এক লাখ ২৬ হাজার ১৩৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা আর্সেনিককবলিত। পানীয় জলের সমস্যা ছাড়াও এসব এলাকার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিআইডবি্লউটিসি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ছিল। ২০০৯ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সেটা কমে বর্ষা মৌসুমে ছয় হাজার কিলোমিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে তিন হাজার কিলোমিটারে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও সারা দেশে প্রায় ৩৫০টি নদীর অস্তিত্ব ছিল।
বিআইডবি্লউটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, 'দখল, ভরাট ও পানি স্বল্পতার কারণে দেশের নদীগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ একসময় নদীর পানিই ছিল পানির প্রধান উৎস। গ্রামের মানুষের গৃহস্থালিসহ খাবার কাজও চলত।
সরেজমিনে ধলেশ্বরী-১ ও ২ সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেতুর নিচে পানি নেই বললেই চলে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের তরা নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নিচ দিয়ে ট্রাক চলাচল করতে দেখা যায়। কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী সড়কের হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা নদীতে, ফরিদপুর-যশোর মহাসড়কের কামারখালী নামক স্থানের গড়াই সেতুর নিচে গড়াই নদীতেও একই অবস্থা। যমুনা সেতুর নিচে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ বালুচর। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা নদীর রাজশাহী পয়েন্টে হেঁটে পার হওয়া যায়।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. মজিবুর রহমান জানান, গত ১০ বছরে নদীগুলোতে কোনো খননকাজ হয়নি। এ কারণে নদীর মূল চ্যানেল ও তলদেশ ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে সামান্য পানিতেই দুই কূল ছাপিয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে পানির চাহিদা পূরণের অন্যতম আশ্রয়স্থল ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এ কারণে রাজধানীর মিরপুরের বেশ কয়েকটি গভীর নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তাকসেম এ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে তুরাগ নদীর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরপুর এলাকার গভীর নলকূপেও পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানির মান এ সময়ে খুবই নিম্নমানের হয়ে যায়। শোধন করেও তা ব্যবহার উপযোগী করা যায় না।
অন্যদিকে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আছে লবণাক্ত পানির সমস্যা। বিস্তীর্ণ এলাকায় ঢুকে পড়েছে লবণাক্ত পানি। এর প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। পানীয় জলের জন্য বৃষ্টিই এখন ওই অঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা।
ড. আইনুন নিশাত বলেন, পানির সমস্যা এখন শুধু রাজধানী বা কোনো বিশেষ এলাকাভিত্তিক নয়। এ সমস্যা সমধানে জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে ছোট ছোট প্লান্ট করা প্রয়োজন। এগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। তিনি পানি সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের যেকোনো একটি উপজেলায় একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালুর পরামর্শ দেন।

No comments:

Post a Comment