Thursday 1 April 2010

চুক্তি অনুযায়ী পানি নেই পদ্মার বুকে ধুধু বালুচর : ছোট-মাঝারি নদনদী শুকিয়ে গেছে, অগভীর নলকূপগুলো বিকল



সরদার এম. আনিছুর রহমান, রাজশাহী
গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। ফলে পদ্মায় পানির প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে অস্বাভাবিকহারে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার এ সময় পানির উচ্চতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। নদীর বুকে জেগে উঠেছে ধু-ধু বালুচর। নদীর মূলধারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে অসংখ্য সরু ও ক্ষীণ স্র্রোতধারায়। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ চর ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার মাঠ এবং ফসলি জমি হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জনজীবন, কৃষি ক্ষেত্র ও পরিবেশের ওপর। উত্তরাঞ্চলের ছোট ও মাঝারি ধরনের নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা এখন অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চল ক্রমেই মরুময়তার দিকে এগোচ্ছে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় পদ্মাসহ অন্যান্য শাখা-প্রশাখা ও নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। অনেক নদী মরে গেছে। বিলুপ্তির পথে আরও অর্ধশত নদী।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ পানি কম পেয়ে প্রতিবছরই লিখিত-অলিখিতভাবে প্রতিবাদ করে এলেও এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন হলেও গত ১৩ বছরে কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। শুধু আশ্বাসের বাণীই শোনানো হয়।
এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মানদীর তীরবর্তী এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মার পানি এবার তুলনামূলকভাবে দ্রুত কমেছে। নদীর বুকে সর্বত্র একূল-ওকূল পর্যন্ত ছোট-বড় অসংখ্য চর জেগে উঠে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ এবং তার উজানে গঙ্গা নদীর পানি এবার আগেভাগেই একতরফাভাবে প্রত্যাহারের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) স্থানীয় অফিস সূত্রে জানা যায়, ১ সেপ্টেম্বর রাজশাহী (বোয়ালিয়া-রামপুর) পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ২৮ মিটার, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৫.৮৯ মিটার। ৩০ সেপ্টেম্বর দাঁড়ায় ১৪.৩৫ মিটার। এরপর ১৫ অক্টোবর পানির উচ্চতা দাঁড়ায় ১৫.৪৩ মিটারে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তা দ্রুত কমে ৩১ অক্টোবর ১২.৯৩ মিটারে এসে দাঁড়ায়। গত ১ নভেম্বর পানির উচ্চতা ছিল ১২.৯০ মিটার, ৩০ নভেম্বর ১০.৮৯ মিটার, ১ ডিসেম্বর ১০.৮৫ মিটার, ৩১ ডিসেম্বর ৯.৯৬ মিটার, ১৫ জানুয়ারি ৯.৯১ মিটার, ৩১ জানুয়ারি ৯.৪৩ মিটার, ১ ফেব্রুয়ারি ৯.৪৫ মিটার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল ৯.০৩ মিটার। চলতি মাসের ১ মার্চ ছিল ৯.০০ মিটার এবং ২২ মার্চ ছিল কিছুটা বেড়ে ৯.২২ মিটার। যেভাবে পদ্মার পানি কমছে তাতে আগামী মাসের শেষ নাগাদ ৮ মিটারের নিচে নেমে যাবে বলে অভিজ্ঞজনের অভিমত। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এপ্রিল-মেতে পানি প্রবাহ আগের যে কোনো বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছবে।
অন্যদিকে এর আগের মৌসুমে ২০০৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর রাজশাহী (বোয়ালিয়া-রামপুর) পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৭.৯৫ মিটার। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তা দ্রুত কমে ২৪ সেপ্টেম্বর দাঁড়ায় ১৪.৬৮ মিটারে। এরপর ৩১ অক্টোবর আরও কমে ১২.৬৭ মিটারে এসে দাঁড়ায়। ১ নভেম্বর পানির উচ্চতা আরও কমে ১২.৬৩ মিটার এবং ৩০ নভেম্বর ১২.৩২ মিটার। একইভাবে ১ ডিসেম্বর ১১.২৬ মিটার এবং ৩১ ডিসেম্বর ১০.১৫ মিটার। ২০০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি ৯.৫৬ মিটার, পহেলা মার্চ ছিল ৮.৯০ মিটার এবং ৩১ মার্চ ছিল ৮.৩৯ মিটার।
সংশ্লিষ্ট দফতরের তথ্যমতে, ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগে ১৯৯৫ সালে শুকনো মৌসুমে অর্থাত্ মার্চ-এপ্রিলে পদ্মায় পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ ছিল ৯.২০ মিটার এবং ১৯৯৬ সালে ৯.৪৫ মিটার। ১৯৯৭ সালে মার্চ-এপ্রিলে পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ ছিল ৯.৮৬ মিটার। চুক্তি কার্যকরের পর ১৯৯৮ সালে কিছুটা বেড়ে ৯.৯৭ এবং ১৯৯৯ সালে ৯.৯৮ মিটার হয়। এরপর থেকে আবার কমতে থাকে ২০০০ সালের মার্চে সর্বনিম্ন ৯.১৪ মিটার, ২০০১ সালে ৯.১৯ মিটার, ২০০২ সালে ৯.৮৮ মিটার, ২০০৩ সালে ৯.০৬ মিটার, ২০০৪ সালে ৯.০৬ মিটার, ২০০৫ সালে ৯.৬৯ মিটার, ২০০৬ সালে ৭.৭২ মিটার এবং ২০০৭ সালে ১ এপ্রিল সর্বনিম্ন ৯.১০ মিটার পানি প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। ২০০৯ সালে ১ মার্চ পানির উচ্চতা ছিল ৮.৯০ মিটার এবং ১ এপিল ছিল ৮.১৫ মিটার। আর এ বছর মার্চেই ৯ মিটারে নেমে এসেছে। এতে প্রমাণিত হয়, ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিচ্ছে না। বরং পানিবণ্টনের নামে বাংলাদেশের পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলকে প্রতারিত করছে। ভারতের আচরণ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী জুনে বর্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত পানি প্রবাহের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এতে বাংলাদেশ বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এতে কৃষি ক্ষেত্র, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যসহ সর্বত্র নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর তুলনামূলক এই সময় এ বছর পদ্মা নদীতে (বোয়ালিয়া-রামপুর) পয়েন্টে পানির প্রবাহ সবচেয়ে কম। গঙ্গা নদীর উজানে, বিশেষ করে ফারাক্কা বাঁধ পয়েন্টে আগেভাগেই ভারতের অতিরিক্ত হারে পানি প্রত্যাহার এবং ১ জানুয়ারি থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয় পাউবো বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এদিকে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এর বিরুপ প্রভাবে নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে এসব এলাকায় হাজার হাজার হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠার পরিমাণও কমে গেছে। কয়েকশ’ অগভীর নলকূপ অচল হয়ে গেছে। আরও অনেক নলকূপ বিকল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, গঙ্গা নদী থেকে কমপক্ষে ৪০ হাজার কিউসেক (প্রতি সেকেন্ডে এক ঘনফুট) পানি ভাগীরথী-হুগলি নদীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারত গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। ১৯৭৫ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পর বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা না দিয়ে ভারত গঙ্গা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিতে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। কয়েকটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার পর ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ভারত ও বাংলাদেশ অবশেষে স্বাক্ষর করে ৩০ সালা পানিবণ্টন চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর ১ জানুয়ারি থেকে ১৫০ দিন গঙ্গার পানিবণ্টন করা হয়। চরম শুকনো সময় (১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত) উভয় দেশের ১০ দিন পরপর কমপক্ষে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, ভারত এ চুক্তি পুরোপুরি অনুসরণ করে না। প্রতিবছরই বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/02/25476

No comments:

Post a Comment