Thursday 22 April 2010

গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে থমকে গেছে বিনিয়োগ* রপ্তানি আয় নিম্নমুখী, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে না

আবদুর রহিম হারমাছি সাহাদত হোসেন কিরণ। KalerKantho|ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ বৈশাখ ১৪১৭, ৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০১০

দেশের অন্যতম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডেকো গ্রুপের চেয়ারম্যান। ব্যবসা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তার পাশে 'ডেকো টেক্সটাইল' নামে একটি বড় বস্ত্র মিল স্থাপনের সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। বেসরকারি একটি ব্যাংক এ প্রকল্পে ঋণ দিতেও সম্মত হয়েছিল। তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে প্রকল্পটি লাভজনক হবে কি না সে হিসাব-নিকাশ কষতে গিয়ে সাহাদত হোসেন মিলটি স্থাপনের কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছেন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারপর তিনি এর কাজ শুরু করবেন।
শুধু সাহাদত হোসেন নন, সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকটে অনেক শিল্পমালিকই এখন নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ না করে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও নিম্নমুখী। আর এ পরিস্থিতিতে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায়ও দু-একটি ছাড়া অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক ছিল। তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বমন্দার ও বিদ্যুৎ সংকটের প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়ের ওপর। চলতি অর্থবছরে প্রথম আট মাসে এই আয় কমেছে ৩ শতাংশের ওপরে। ফলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতিতে সুসংবাদ নেই_এটা এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে, তা দ্রুত কাটার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে সব ক্ষেত্রেই একধরনের হতাশা বিরাজ করছে।
এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি আয় ও বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ইতিবাচকই বলা যায়। প্রায় সাত মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করছে। রাজস্ব আদায় বাড়ছে। মন্দার কারণে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের ধস নামবে বলে আশঙ্কা করা হলেও তেমনটি হয়নি। তবে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন মোটেই সন্তোষজনক নয়। এ অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকট সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী নেতারাও আশঙ্কা করছেন।
গতকাল সোমবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সাহাদত হোসেন বলেন, 'আমার টেক্সটাইল মিলটি চালু হলে কম করে হলেও দেড় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু বাধ্য হয়ে আমি মিলটি স্থাপনের কাজ বন্ধ রেখেছি। আমার মতো অনেকেই এখন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন না করে অপেক্ষা করছেন।'
তবে আশার বাণী শুনিয়েছে আন্তর্জানিক খ্যাতিসম্পন্ন দুটি ঋণমাণ (ক্রেডিট রেটিং) সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর (এসঅ্যান্ডপি) ও মুডিস। প্রথমবারের মতো এ দুটি সংস্থা বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের রেটিং করেছে। দুটি রেটিংয়েই বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এসঅ্যান্ডপির রেটিংয়ে বাংলাদেশ ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের কাতারে; শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ওপরে। আর মুডিস রেটিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভিয়েতনামের চেয়েও তিন ধাপ ওপরে। দুটি রেটিংয়েই ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। এ দুটি রেটিং বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ-সহায়তার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি ছাড়া আমাদের অর্থনীতি বেশ মজবুত ভিত্তির ওপর রয়েছে। বিশ্বমন্দা আমাদের অর্থনীতিকে যতটা আঘাত করবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে ততটা হবে না। তার পরও আমরা বিশ্ব পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।'
তিনি বলেন, 'গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে আমরা নিজেরাও শংকিত। এ দুটি সমস্যা না থাকলে আমরা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতাম। এসঅ্যান্ডপি ও মুডিস রেটিংয়েও আমাদের এ সমস্যার কথা বলা হয়েছে।'
'তবে এ কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমরা (সরকার) গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, শিগগিরই এর ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে'_বলেন মুহিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, এক অর্থে মন্দা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলই বয়ে এনেছিল। মন্দার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্যসহ প্রায় সব জিনিসের দাম কমে এসেছিল। আমদানি ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার এটাও অন্যতম কারণ। তবে গত কয়েক মৌসুম ফসলের (ধান ও গম) বাম্পার ফলন আমদানি ব্যয় কমাতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে বলেও জানান তিনি।
ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি আনিসুল হক বলেন, 'বাংলাদেশের এখন এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ। আমাদের উন্নয়নের পথে এখন এ দুটি সমস্যাই প্রধান অন্তরায়। দ্রুত যদি আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে না পারি তাহলে আমাদের এতদিনের অর্জনও নস্যাৎ হয়ে যাবে।'
রিজার্ভ সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে
সাত মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করছে; যা দিয়ে ছয় মাসেরও বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। গত বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। গতকাল রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন (এক হাজার ৫২ কোটি) ডলার।
রেমিট্যান্স বাড়ছেই
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ছেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশে ৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয় কমছে
বিশ্বমন্দার কারণে রপ্তানি আয় কমলেও তা আশঙ্কা অনুযায়ী কমেনি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলানায় দেশে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ রপ্তানি আয় কম এসেছে। এ সময় ১০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আর আগের বছরের এ সময় রপ্তানি হয়েছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি পণ্য।
কমছে আমদানি ব্যয়ও
প্রতি মাসেই আমদানি ব্যয় কমছে। অর্থবছরের সাত মাসে অর্থ্যাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় কমেছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ায় জানুয়ারি মাসে আমদানি ব্যয় ৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৪৭ দশমিক ০৪ শতাংশ।
আট মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৭ শতাংশ
এ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় ১৭ দশমিক ০৭ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় মোট ৩৫ হাজার ৭৬৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরে একই সময় এর পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই
মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে উঠেছে। জুন মাসে এ হার ছিল ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। জুলাই মাসে ছিল ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সব ধরনের জিনিসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে (বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়) মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশে ওঠে। এর পর আস্তে আস্তে কমে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তা ৬ দশমিক ০৩ শতাংশে নেমে আসে।
বিনিয়োগে খরা কাটছে না
বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটছে না। দেশি-বিদেশি দুই ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই নাজুক অবস্থা। ব্যাংকগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা অলস (অতিরিক্ত তারল্য) পড়ে আছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মূল এডিপির ৩৯ শতাংশ মাত্র বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে সরকার মূল এডিপি থেকে দুই হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে পিপিপির মাধ্যমে (সরকারি-বেসরকারি অংশিদারি উদ্যোগ) দেশের উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

No comments:

Post a Comment