Tuesday 6 April 2010

রাজধানী কারবালা : পানির অভাবে জনজীবন ওষ্ঠাগত



হাসান শান্তনু/কাজী জেবেল
পানির অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ঢাকাবাসী। নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে সামান্য পানিও মিলছে না। গরমের শুরু থেকেই ভয়াবহ লোডশেডিং ও গ্যাসের তীব্র সঙ্কটের পাশাপাশি পানির অভাবে নগরজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নগরীতে পানির ঘাটতি ৬০ থেকে ৭৫ কোটি লিটার। লোডশেডিংয়ের কারণে ওয়াসার ৫৩১টি পানির পাম্প প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। গাড়ির মাধ্যমে পানি সরবরাহের জন্য গত এক সপ্তাহে প্রায় পাঁচ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়লেও পানি দিতে পারেনি ওয়াসা। বাসায় খাবার, রান্না, হাত-মুখ ধোয়া এমনকি প্রক্ষালনের জন্য ব্যবহারের পানি পাচ্ছেন না রাজধানীবাসী। অভিজাত এলাকায় বোতলজাত পানি দিয়ে চলছে রান্নার কাজ। এ নিয়ে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং ওয়াসার কাছে প্রতিদিন অসংখ্য অভিযোগ জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ‘দেখছি’, ‘সমাধানের চেষ্টা চলছে’, ‘একটু কষ্ট করুন ঠিক হয়ে যাবে’, ‘প্রাণপণ চেষ্ট চলছে’—এমন সান্ত্বনা ছাড়া তাদের কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি কেউ। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা স্বীকার করছেন, গত ৫০ বছরে এমন সঙ্কট দেখা দেয়নি। পানির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না নগরবাসী। গতকালও মহাখালীসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খালি কলসি, বালতি নিয়ে বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধ করেছেন বিক্ষুব্ধরা। ওয়াসার দুর্গন্ধময়, ময়লাযুক্ত পানি পান করে অনেক মানুষ ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন। ওয়াসা বলছে, ঘন ঘন লোডশেডিং এবং লো ভোল্টেজের কারণে তাদের পাম্পগুলো বেশিরভাগ সময় বন্ধ রাখায় পানির সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। নগর বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে যে কোনো মুহূর্তে জনবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। জনরোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে এ আশঙ্কায় সরকার গত ১ এপ্রিল থেকে ওয়াসার সব জোনে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। এখনও সেই ঘোষণা কার্যকর হয়নি। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিক এ খান আমার দেশকে জানান, আগামীকাল থেকে সেনা মোতায়েন করা হবে। তবে তিনি দাবি করেন, ওয়াসার বৈধ গ্রাহকদের পানির সঙ্কট নেই। যারা অবৈধ গ্রাহক তাদেরই সঙ্কট রয়েছে। বৈধ গ্রাহকদের চাহিদা ১৮০ কোটি লিটারের বেশি নয়। আমরা তা উত্পাদন ও সরবরাহ করতে সক্ষম। পানিতে কোনো দুর্গন্ধ নেই বলে তিনি দাবি করেন।
জনদুর্ভোগ চরমে : জানা যায়, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন পানির চাহিদা ২৫০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসা সরবরাহ করতে পারছে ১৬০ কোটি লিটারের কিছু কম বা বেশি। ফলে ঘাটতি থাকে ৬০ থেকে ৭৫ কোটি লিটার। চৈত্রের প্রচণ্ড গরমে তাই পানির চরম সঙ্কটে রাজধানীজুড়ে চলছে হাহাকার। সাধারণ এলাকা তো বটেই, অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরায় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ এলাকায় দিনে এক বা দুইবার পানি এলেও তা বেশি সময় স্থায়ী হয় না। আবার লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজের কারণে ওই সময় মোটর না চালিয়ে পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ওয়াসার গাড়ির মাধ্যমে পানি চেয়ে গত এক সপ্তাহে নগরবাসী প্রায় ৫ হাজার আবেদন জানালেও পাওয়া গেছে যত্ সামান্য। রাস্তায় ওয়াসার কলগুলোতে খালি কলস নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন মানুষ। তবুও পানি মিলছে না। গৃহস্থালি কাজে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। রান্নাবান্না, গোসল হচ্ছে না ঠিকভাবে। মগবাজার, আমবাগান, নয়াটোলা, খিলগাঁও, বাসাবো ও শাহজাহানপুর এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত চারদিন ধরে তারা পানি পাচ্ছেন না। পানি না পেয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নামতে শুরু করেছেন। গতকালও মহাখালীর রাস্তা বন্ধ রেখে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন এলাকাবাসী। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক বন্ধ রেখে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানান। নাখালপাড়ার বাসিন্দারা জানান, সেখানে প্রায় এক মাস ধরে পানির সঙ্কট চলছে। এর প্রতিবাদে সম্প্রতি তারা কলসি মিছিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন খবরে ওয়াসা দ্রুত পানিবাহী গাড়ি নিয়ে সেখানে হাজির হয়। রাজধানীর আরও অনেক এলাকায় বর্তমানে পানির প্রকট সমস্যার খবর পাওয়া গেছে। অনেকে আমার দেশ কার্যালয়ে ফোন করে পানি সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে মিরপুর ১, ২, ১০, ১১ নম্বরসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকা, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, কল্যাণপুর, পাইকপাড়া, জনতা হাউজিং, শাহ আলীবাগ, পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার আহম্মেদনগর, বাসাবো, কদমতলা, খিলগাঁও, রামপুরা, হাজীপাড়া, মানিকনগর, মুগদাপাড়া, পুরান ঢাকার গোপীবাগ, ওয়ারী, নারিন্দা, তাঁতীবাজার, রাজার দেউড়ি, গোয়ালনগর, পানি টোলাসহ প্রায় সব এলাকা, মধ্য ঢাকার বাংলামোটর সংলগ্ন ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ইন্দিরা রোড, পশ্চিম রাজাবাজার, ধানক্ষেত মোড়সহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের বাবর রোড, তাজমহল রোড, নূরজাহান রোড প্রভৃতি এলাকা।
জনবিস্ফোরণের আশঙ্কা : পানির ক্রমাগত সঙ্কটে যে কোনো সময় জনবিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা গত ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে এক বৈঠকে এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমানে রাজধানীসহ দেশে পানি, বিদ্যুত্ ও গ্যাসের যে সঙ্কট চলছে, তা গত ৫০ বছরেও হয়নি। এ সমস্যা সমাধান করতে না পারলে অতীতের চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট কিংবা ডেমরার শনিরআখড়ায় সেসময় সরকারের বিরুদ্ধে যে জনবিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল সেরকম শত শত ঘটনা ঘটতে পারে। ওই বৈঠকে ঢাকার সরকারদলীয় সব সংসদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া এর আগে যেসব স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে সেখানেও ভুক্তভোগীরা একই ধরনের ইঙ্গিত দিয়ে বক্তব্য রাখেন।
যেসব কারণে পানির সঙ্কট : ওয়াসার কিছু কর্মকর্তার অনিয়ম, সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা, অবৈধ পানির সংযোগের মাধ্যমে চুরি ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ার কারণে পানি সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে। বর্তমানে ওয়াসার ৫৩১টি পাম্প রয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে সেগুলো প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। ওয়াসার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ বিদ্যুতের কারণে দিনে সবগুলো পাম্প গড়ে ৪৯৩ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। গত বছর বন্ধ ছিল ১ হাজার ৪৬৩ ঘণ্টা। আর চলতি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একই সময় গত ২৩ মার্চ বন্ধ ছিল ২ হাজার ২০৪ ঘণ্টা। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুত্ বিভ্রাটের কারণে সব পাম্প ১ হাজার ৭১১ ঘণ্টা বেশি বন্ধ ছিল। আর এ কারণে পানি সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে। এছাড়া ওয়াসার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৩৫ ভাগ গ্রাহকের বাড়িতে বৈধ মিটার সংযোগ নেই। এতে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটারের বেশি পানি চুরি হচ্ছে। সিস্টেম লস, ঢাকায় ১ হাজার ২০৯টি এবং নারায়ণগঞ্জে ৪৩৪টি রাস্তার কলের বেশিরভাগই সংরক্ষণের অভাবে খোলা থাকায় পানির অপচয় হচ্ছে। বর্তমানে ওয়াসার সিস্টেম লস ৩৮ শতাংশ বলে জানা গেছে। অন্যদিকে জাতীয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগ চলছে ধীরগতিতে। ওই নীতিমালায় বলা হয়েছ, ওয়াসার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়ানো। কিন্তু ওয়াসা মোট উত্পাদনের ৮৭ শতাংশ ভূগর্ভস্থ আর মাত্র ১৩ শতাংশ ভূউপরিস্থিত উত্স থেকে পানি সরবরাহ করছে।
দূষিত পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া : ওয়াসার পানি নিয়ে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন মানুষ। নগরীর অনেক এলাকায় ওয়াসার পানির লাইনের সঙ্গে নর্দমার লাইন একাকার হয়েছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও পানির লাইনের সঙ্গে স্যুয়ারেজ লাইন একাকার হয়ে দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি সরবরাহ হচ্ছে। এ পানি পান করায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া ও অন্য পানিবাহিত রোগ। গত জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআরবি) ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৪০ জন ভর্তি হয়েছেন। রোগীর ভিড় সামলাতে হাসপাতালের সামনে খোলা জায়গায় দুটি তাঁবু ফেলে বিছানো হয়েছে অতিরিক্ত ২৫০ শয্যা। চলতি বছর সর্বোচ্চ রোগী ভর্তির রেকর্ড ছিল গত রোববার। ওইদিন ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৯ রোগী। প্রতি ঘণ্টায় হাসপাতালে রোগী এসেছেন ৪২ জন করে। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসাপাতাল, শিশু হাসপাতালেও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আইসিডিডিআরবির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এসকে রায় ডায়রিয়ার জন্য ওয়াসার দূষিত পানিকে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন।
সমস্যা সমাধানে নেই সমন্বয় : গত ২৩ মার্চ থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি সঙ্কট মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ নেয় ওয়াসা। সঙ্কট দূর করতে ওয়াসার পানির পাম্পগুলো ডুয়েল লাইনের মাধ্যমে চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। একটি লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুত্ চলে গেলে যাতে আরেকটি লাইনের মাধ্যমে পাম্প চালিয়ে পানি সরবরাহ করা যায় এজন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত ১৮ মার্চ আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ডিপিডিসি ২০ মার্চের মধ্যে ১৯০টি পাম্পে আর ডেসকো মার্চের শেষ সপ্তাহের মধ্যে ৬৪টি পাম্পে ডুয়েল লাইন দেয়ার কথা জানায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দুটি প্রতিষ্ঠান গতকাল পর্যন্ত মোট ১০৮টি পাম্পে ডুয়েল লাইন দিয়েছে। ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় বাকি লাইনগুলোতে এখনও সংযোগ দেয়া হয়নি। এছাড়া ডিসিসি পানি পরিবহনে ওয়াসাকে গাড়ি দেয়ার কথা থাকলেও সমন্বয়ের অভাবে তা বাস্তবায়ন হয়নি।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/07/26301

No comments:

Post a Comment