Thursday 1 April 2010

বিপর্যয়ের মুখে শিল্প খাত

মনজুর আহমেদ | Prothom-alo তারিখ: ০২-০৪-২০১০

গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে দেশের অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন-বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আরও হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান চলছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ উৎপাদন নিয়ে।
রপ্তানি-আয়ের ৭৬ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে। আর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের বস্ত্র খাত। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে এসব খাত এখন চরম সংকটে।
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দায় এরই মধ্যে দেশের রপ্তানি-আয় অনেকখানি কমে গেছে। বিশ্বমন্দা কেটে যাওয়ায় রপ্তানি-আয় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হলেও জ্বালানি-সংকটে তা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে চীন-ভারত-ভিয়েতনামসহ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো।
জানা গেছে, বিদেশি ক্রেতারা এখন বেশি বেশি কাজ দিতে চায় বাংলাদেশকে। কিন্তু কাজ নিতে পারছেন না এ দেশের উত্পাদকেরা। যাঁরা কাজ নিয়েছিলেন, তাঁদের বড় অংশই সময়মতো পণ্য সরবরাহের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
বেহাল অবস্থা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শিল্প স্থাপনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেও গ্যাস-সংযোগের অপেক্ষায় মাসের পর মাস ধরে বসে আছেন।
নিয়মিত বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না বলে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থাত্ ক্যাপটিভ বা স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর ব্যবহার করে। এগুলো চলে গ্যাসে। কিন্তু এখন অনেক এলাকায় গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে দীর্ঘ সময় উৎপাদন বন্ধ করে বসে থাকতে হচ্ছে। যাঁরা খানিকটা অবস্থাপন্ন তাঁরা জরুরি উৎপাদন চালিয়ে নিতে ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করছেন। কিন্তু এতে খরচ বেড়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাতে হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এ অবস্থা আর এক মাস চললে বড় বিপর্যয় ঘটবে শিল্পে। বন্ধ করে দিতে হবে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। তাতে কর্মসংস্থান হারাবে অসংখ্য মানুষ। নতুন বিনিয়োগ করা নয়, বিদ্যমান উৎপাদন-বিপর্যয় ঠেকানো নিয়েই মালিকেরা এখন শঙ্কিত।
ঢাকার আশপাশে সবচেয়ে বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে। এসব এলাকায় গিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের তীব্র সংকটের এই ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।
গাজীপুর এলাকা: গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সফিপুরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান রহিম টেক্সটাইলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মালেক স্পিনিংয়ে গত বুধবার বেলা ১২টায় গিয়ে দেখা যায়, তিনটি ইউনিটের এ কারখানার ৬৪ হাজার টাকুর (স্পিন্ডাল) মাত্র ১৬ হাজার চালু রয়েছে। সকাল নয়টায় চালু ছিল ৩২ হাজার টাকু, ১০টায় কমে চালু ছিল ২৩ হাজার এবং বেলা ১১টায় ১৭ হাজার।
ছয়টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ৩২৬ টন সুতা দেওয়ার চুক্তি রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের। সুতা দিয়ে কাপড় তৈরি করে তবেই রপ্তানি করা হবে। কিন্তু সেই সুতা তারা দিতে পারছে না। মালেক স্পিনিং ২০ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি) চাপের গ্যাসের জন্য সরকারের অনুমোদন নিয়েছে। দুপুর ১২টায় চাপ ছিল তিন পিএসআইয়ের কম। ৫০ লাখ টাকা খরচ করে গ্যাসপাইপের সঙ্গে সংযোগ নিয়েও খুব বেশি লাভবান হয়নি তারা।
এই এলাকার রতনপুরে এক বছর আগে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সালেক স্পিনিং প্রতিষ্ঠা করা হয়। বেলা একটায় সরজমিনে তিন হাজার ৬০০ ‘রোটোর্সের’ এ প্রতিষ্ঠানটির মাত্র ৭০০ ‘রোটোর্স’ চলতে দেখা যায়। কেননা গ্যাসের চাপ মাত্র এক পিএসআইয়ের নিচে নেমে এসেছিল।
প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ মতিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মন্দার পর বিশ্ববাজারে একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা তো সম্ভবই নয়, উল্টো এই শ্রমিক-কর্মচারীসহ কারখানা আদৌ খুলে রাখা যাবে কি না সেটাই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চন্দ্রা এলাকাতে স্থাপিত হয়েছে দেশের বেসরকারি খাতের একমাত্র মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি। সরজমিনে গিয়ে জানা গেল, সকাল নয়টায় কাজ শুরু হওয়ার পর মাত্র এক ঘণ্টা গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ থাকে, তারপর কমে যায়। ফলে ডিজেলচালিত জেনারেটর চালু রাখতে হচ্ছে। এতে একদিকে উৎপাদন কমে গেছে ২০ শতাংশ, আবার ডিজেল ব্যবহারে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ। এই এলাকায় অবস্থিত ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালেরও একই অবস্থা বলে জানা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ এলাকা: একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জে। এখানেও উদ্যোক্তারা গ্যাস পাচ্ছেন চাহিদার অর্ধেক বা তারও অনেক কম। ফলে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে কাজ সারছে।
ফতুল্লার ভোলাইল এলাকার নিট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মিনার ইন্ডাস্ট্রিজে ডিজেল দিয়ে কাজ করায় খরচ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। প্রতিদিন তারা এক লাখ টাকার ডিজেল কিনছে। অথচ গ্যাসে চলতে খরচ হতো ২০ হাজার টাকার মতো। আবার তাদের উৎপাদন কমে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আমরা এ বছর রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলাম, তা কোনোভাবেই অর্জন করা সম্ভব হবে না। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্জন করা যেতে পারে।’
তিনি জানান, এ এলাকায় ১৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। আর গ্যাস থাকে রাত ১১টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত। এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আর এক মাস এভাবে চললে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।’
এ কারখানাতে শ্রমিকেরা পোশাকপ্রতি মজুরি পেয়ে থাকেন। শ্রমিকদের আয়ও চার ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে।
ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের এনায়েতনগর এলাকায় গত মঙ্গলবার গিয়ে জানা যায়, বৃহত্ রপ্তানিমুখী নিটওয়্যার উৎপাদনকারী কারখানা এনআর গ্রুপ, ক্রনি গ্রুপ ও ফারিয়া অ্যাপারেলস গ্যাস-সংকটের কারণে তাদের ডায়িং ইউনিটগুলো প্রায় বন্ধ করে রেখেছে।
ক্রনি গ্রুপের এমডি এ এইচ আসলাম সানি বলেন, ‘আমাদের ডায়িং ইউনিটে প্রতিদিন গড়ে ১৫ টন কাপড় রং করা যায়। গ্যাস-সংকটের কারণে মাত্র পাঁচ-ছয় টন কাপড়ে রং করা যাচ্ছে।’ তিনি জানান, এই ডায়িংয়ের বয়লার চালাতে ১০ পিএসআই ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাসের চাপ থাকা প্রয়োজন। অথচ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩ পিএসআই। এর প্রভাবে কারখানার পোশাক-উৎপাদনক্ষমতা ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে।
আড়াইহাজার উপজেলার ধূপতারা ইউনিয়নে অবস্থিত রায়া স্পিনিং মিলে সুতা বানানো, কাপড় তৈরি ও রং করে ঢাকার ইসলামপুরে সরবরাহ করা হয়। দেশীয় শাড়ি তৈরির এ কারখানার মালিক আমির আলী জানান, গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস, ডায়িং, প্রিন্টিং, রি-রোলিং ও স্টিল মিলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর বেশির ভাগই গ্যাসনির্ভর। কিন্তু গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ না থাকায় প্রায় অচল হয়ে পড়েছে শিল্প-কারখানাগুলো।
বিদেশি বিনিয়োগেও গ্যাস-সংযোগ নেই: ৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে শিল্প স্থাপন করার পর গ্যাস-সংযোগ না পেয়ে কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) একটি তাইওয়ানি কোম্পানি বসে আছে। হান-সিন টেক্সটাইল বিডি নামের এ প্রতিষ্ঠানটি এক বছরে কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ করে এখন মাসের পর মাস ধরে গ্যাস-সংযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক বিপ্লব চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব ধরনের অনুমোদনের পরও গ্যাস-সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। বেপজার চেয়ারম্যান এই শিল্পে গ্যাস-সংযোগ দিতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করে চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।’
দুর্দশায় শ্রমিক-কর্মচারীরা: বেশ কয়েকটি স্পিনিং মিলে গিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের দুর্দশার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। সুতা উত্পাদনের সময় ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় বলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে। ওপরে পাখার সাহায্যে বাইরের বাতাস এনে ভেতরে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবাহিত করা হয়। আর নিচে মেঝেতে থাকা আরেক ধরনের পাখায় একই সঙ্গে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তুলা ও ধুলাবালি এবং গরম বাতাস টেনে নেওয়া হয় ভেতর থেকে।
বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকেরা ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করছেন বলে দেখা গেছে। শ্রমিকের জন্য সহনীয় তাপমাত্রা নিশ্চিত করতে হলে ব্যয় বেড়ে গিয়ে মিলই বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এই পরিস্থিতি শ্রমিকেরা জেনেশুনে মেনে নিয়েছেন বলে জানান নারী-শ্রমিক রাসু। বিকল্প হিসেবে মিলগুলোর চালু স্পিন্ডালের নিচ দিয়ে পানি ঢেলে তাপমাত্রা খানিকটা কমিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে এখানে।
নরসিংদী: গ্যাস-সংকটে নরসিংদীর শিল্প-কারখানাগুলোও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। জেলার পাঁচ শতাধিক শিল্প-কারখানা গ্যাসের সংকটে রয়েছে। মাধবদী শিল্প এলাকার এমএমকে ডায়িং প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং ইন্ডাস্ট্রিতে গতকাল বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, গ্যাসের চাপ কম থাকায় পুরোদমে উৎপাদন চালানো যাচ্ছে না। মিলের ৭০০ শ্রমিকের মধ্যে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। মিলের এমডি আবদুল মোমেন মোল্লা জানান, গ্যাসের চাপ কম হওয়ায় কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
নরসিংদীর পাকিজা স্পিনিং মিলে কাজ করেন প্রায় সাড়ে চার হাজার শ্রমিক। গ্যাসের সমস্যায় এই মিলেও উৎপাদন অনেক কমে গেছে।
মানিকগঞ্জ: গ্যাস-সংকটে বন্ধ হয়ে আছে মানিকগঞ্জের রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান মুন্নু ফেব্রিক্স। গত বছর অক্টোবর মাসে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুন্নু গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি আফরোজা খান বলেন, অব্যাহত গ্যাস-সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। লোকসান ঠেকাতে কিছু শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। কিন্তু শ্রমিকেরা তা মেনে না নিয়ে আন্দোলনে নামে। এ অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যস্থতায় কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গ্যাস-সংকটে সাভার-আশুলিয়া এলাকায় শিল্প-কারখানাগুলোতেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কবীরপুর এলাকার তোহা টেক্সটাইলের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, তাঁদের কারখানার ৩৫ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন গাজীপুরের মাসুদুল হক, নারায়ণগঞ্জের আসিফ হোসেন, সাভারের অরূপ রায়, নরসিংদীর সুমন মোল্লা, কালিয়াকৈরের মাসুদ রানা।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-04-02/news/53359

No comments:

Post a Comment