Tuesday 6 April 2010

বখাটেদের উৎপাত বাড়ছে

যৌন নিপীড়ন রোধে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত

আইরীন নিয়াজী মান্না | বুধবার | ৭ এপ্রিল ২০১০ | ২৪ চৈত্র ১৪১৬ | ২১ রবিউস সানি ১৪৩১

দেশে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। ফলে বখাটেদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। এদের অত্যাচারে একের পর এক প্রাণ দিতে বাধ্য হচ্ছে সম্ভাবনাময় মেয়েরা। সিমি, পিংকি, ফাহিমা, তৃষা, রুমী, রাহেলার পর এবার বখাটেদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রাণ দিতে হলো নন্দীপাড়ার স্কুলছাত্রী ইলোরাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উদাসীনতা, জনসচেতনতার অভাব, অজ্ঞতা এবং এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করার কারণে এ উৎপাত বাড়ছে। সরকার এ বিষয়ে কঠোর না হলে বখাটেদের এ উৎপাত আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তারা বলছেন, নীতিমালা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাইকোর্টের যে নির্দেশ রয়েছে তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। যার কারণে শুধু ইভটিজিংই শেষ নয়, বখাটেদের অত্যাচারে সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে কিশোরী ও তরুণীরা।
এ ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি রোধে নির্দেশনা চেয়ে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাদী হয়ে একটি রিট মামলা করেন। এই রিটের নিষ্পত্তিতে গত বছর ১৪ মে হাইকোর্ট একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেন এবং তা কার্যকর করতে নির্দেশ দেন। একটি আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে আদালতের রায়ে বলা হয়, যত দিন পর্যন্ত আইন প্রণয়ন করা না হবে তত দিন হাইকোর্টের বেঁধে দেওয়া এ নীতিমালা বহাল থাকবে এবং তা বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হবে।
জানা গেছে, নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন বন্ধে হাইকোর্টের নীতিমালা তৈরির প্রায় এক বছর হতে চললেও তা এখনও উপেক্ষিত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও রাস্তাঘাটে নারী, শিশু ও কিশোরীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষায় এখনও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া এ ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে আজও অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়নি। এ অবস্থায় দেশে একের পর এক নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও এলাকায় নারীর ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন মা-বাবা, অভিভাবক ও সচেতন মহল।
যৌন নির্যাতনের সংজ্ঞা সম্পর্কে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক যে কোনো ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোন বিড়ম্বনা, যে কোনো ধরনের পর্নোগ্রাফি, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণ সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। শুধু কর্মস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে না। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় যে কোনো ধরনের অশালীন উক্তি, কটূক্তি ও বাজে দৃষ্টিতে তাকানোও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। হাইকোর্ট দেশের সাংবিধানিক আদালত। এ আদালত যে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন, তা পালন করা বাধ্যতামূলক। এসবের বাস্তবায়ন করতে আইন সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিক্ষা সচিব, শ্রম সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ইউজিসি, বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বার কাউন্সিল, পুলিশ, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া হয় তখন।
রিটকারীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম সমকালকে বলেন, আমরা শুনেছি দু'একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি রোধে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে হাইকোর্ট থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করা হয়েছে। দেখা যাক তারা এর উত্তরে কী বলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী সমকালকে বলেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের এ রায় সব প্রতিষ্ঠান মানতে বাধ্য। কিন্তু অধিকাংশই মানছে না। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা, আইন তৈরি হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বলেন, নির্যাতিত মেয়েটি যাতে অভিযোগ করতে পারে সেজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে নারীবান্ধব কমিটি করতে হবে। তাছাড়া এমন একটি নীতিমালা রয়েছে দেশে, তা অধিকাংশই মানুষই জানে না। নীতিমালায় অপরাধের শাস্তি কী আছে তাও জনগণকে জানাতে হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। একই সঙ্গে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমরা সচেতন নই বলে বারবার এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটছে। তিনি জানান, এ বিষয়ে একটি খসড়া আইন প্রণয়নের কাজ করছি আমরা। শিগগির এটি আইন কমিশনে পাঠানো হবে।
মহিলা আইনজীবী সমিতির উপ-পরিচালক অ্যাডভোকেট কোহিনুর বেগম বলেন, এই নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে এ ধরনের মৃত্যু বা বখাটেপনা সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধে সরকারসহ আমাদের সবাইকে সামাজিকভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারের পক্ষে শুধু আইন বা নীতিমালা করে বসে থাকলেই চলবে না। নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না তা মনিটর করতে হবে। এ সমস্যা বন্ধ করতে সরকারকে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম সমকালকে বলেন, সরকারকেই সঠিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে। যে কোনো নীতিমালা বা আইনের সঠিক বাস্তবায়নে সরকারকে তার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাছাড়া দেশের মেয়েদেরও সচেতন হতে হবে অপ্রত্যাশিত ঘটনা মোকাবেলা করতে। সমানভাবে সচেতন হতে হবে ছেলে ও মেয়েদের অভিভাবকদেরও।
এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, শুধু আইন প্রণয়ন বা নীতিমালা দিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব নয়। এজন্য সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা জরুরি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীই শুধু নয়, এজন্য ছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষকদেরও সচেতন করতে হবে। এক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব আনতে হবে। অপরাধীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে অন্যরা এ শিক্ষা পায়। এছাড়া আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। প্রত্যেক মেয়েকে আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে।
বখাটেদের উৎপাত বন্ধে নতুন কোনো আইন করা হবে কি-না জানতে চাইলে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ইলোরার আত্মহত্যা খুবই দুঃখজনক। দেশে ইভটিজিংসহ এ ধরনের হয়রানি বন্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের অভিভাবকদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইলোরার মৃত্যুর পর সরকার বখাটেদের তৎপরতা বন্ধে তৎপর। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি স্কুলের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার গণমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার বসবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে সে বিষয়টিও সরকার খতিয়ে দেখবে।
তিনি জানান, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বর্তমান নীতিমালাই যথেষ্ট। এ নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়ন যাতে হয় রাষ্ট্র সেদিকে নজরদারি করবে। এ মুহূর্তে এ-সংক্রান্ত আইনের বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেনি।

No comments:

Post a Comment