Thursday 1 April 2010
প্রয়োজনের সময়ে নয়, অসময়ে পানি দিচ্ছে ভারত : তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের নাটক
ইলিয়াস খান
ভারত তিস্তার পানি নিয়ে এখন ‘নাটক’ শুরু করেছে। প্রয়োজনের সময় দিচ্ছে না, প্রয়োজন ফুরালে সয়লাব করে দিচ্ছে। আর অসময়ে পানি দিয়ে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করছে।
তিস্তা ব্যারেজের প্রথম পর্যায়ের সেচের আওতাধীন কৃষকদের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, জানুয়ারি ও ফেব্রুুয়ারিতে জমিতে পানির দরকার ছিল অনেক বেশি। সে সময় ধান লাগাতে এবং পরে পরিচর্যায় পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভারত সেসময় তিস্তা ব্যারাজের প্রথম পর্যায়ের জন্য পর্যাপ্ত পানি দেয়নি। পানি সরবরাহ বাড়িয়েছে মার্চের প্রথমদিকে।
জানা গেছে, গত বছর ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে আসে। এর পরে চলতি বছরের জানুয়ারিতেও আশাতীত পানি আসেনি তিস্তায়। পর পর আরও পানি কমে আসে। এমন অবস্থায় ব্যারেজ কর্তৃপক্ষও একটু সতর্কতার সঙ্গে ব্যারেজের উজানে পানি ধরে রেখে। ব্যারেজের মূল ৪৪টি গেটের প্রায় সবগুলো বন্ধ রেখেও সেচের পানি ধরে রাখা হয় অনেকদিন। ভয় ছিল এবার পানি যদি মার্চ-এপ্রিলে না আসে। তবে ভারত তিস্তায় পানির প্রবাহ বাড়িয়েছে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। আর এই পানি প্রবাহের বিষয়টি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালায় যে, ভারত তিস্তায় পানিতে সয়লাব করে দিয়েছে।
তিস্তার ব্যারেজের নীলফামারী ক্যানেলের সুবিধাভোগী এক কৃষক আবদুর রহমান বলেন, ‘এখন আর পানি দিয়ে কি করব? যখন দরকার তখন তো ভারত পানি দেয়নি। আমরা অনেকে ধানের চারা লাগাতে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তুলেছি।’
কৃষক মাহতাব হোসেন বলেন, এখন তিস্তায় অনেক পানি। আর এই পানি এখন কৃষকের কাজে আসছে না। তবে সর্বত্র প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তিস্তায় পানিতে সয়লাব। তিনি বলেন, তারা তিস্তা ব্যারেজের পানি এখন সেচের জন্য নিচ্ছেন না।
তিস্তায় পানি বেড়েছে ফেবু্রয়ারির শেষের দিকে। মার্চে আরও প্রবাহ বাড়িয়েছে ভারত। মার্চের ২৭ তারিখেও তিস্তায় পানির প্রবাহ ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিউসেক। ব্যারেজ সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে এই পরিমাণ পানি দেখা গেছে।
আর এই পরিমাণ পানি থাকা সত্ত্বেও কৃষকরা তিস্তা ব্যারেজের ক্যানেল দিয়ে তাদের জমিতে সেচের পানি নিচ্ছে না। তাদের মতে এই সময়ে ধানে থোড় আসবে। তাই তাদের প্রশ্ন—’এখন পানি দিয়ে কি করবো?’।
কৃষক জমিরউদ্দিনের মতে, যখন দরকার তখন নেই, এখন পানি দিয়ে ভারতের এমন বাহবা কুড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। আমরা পানি চাই শুষ্ক মৌসুমে ও একই সঙ্গে ঠিক সময়ে।
সিকিমে হিমালয়ের ৭ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে তিস্তার জন্ম। এই নদী নীলফামারী জেলার খড়িবাড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তিস্তার মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩১৫ কি.মি.। এর মধ্যে ১১৫ কি.মি. বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পড়েছে।
বাংলাদেশে তিস্তার পানি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তি ও প্রকৌশলীদের মেধা ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে তিস্তা ব্যারেজ। বর্তমানে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের সুবিধাভোগী এলাকা হচ্ছে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলা। এই উপজেলাগুলো হচ্ছে—ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, র্পা্বতীপুর, চিরিরবন্দর ও খানসামা। এইগুলো হচ্ছে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের সুবিধাভোগী এলাকা। তবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এই বারটি উপজেলার অনেকগুলোতেই সেচ দিতে তিস্তা ব্যারেজের পানি সরবরাহ করতে পারেনি। এই নদীর উজানে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশের তিস্তার ব্যারেজনির্ভর প্রকল্পগুলো মরণদশায় ঠেলে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে তিস্তা ব্যারাজের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্ত এই প্রকল্পের উপকৃত এলাকার পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ হেক্টর। কিন্তু উজান থেকে যেভাবে পানি আসছে তাতে করে সেচ দূরে থাক বাংলাদেশে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাঁচিয়ে রাখা দায় হয়ে গেছে।
তিস্তা প্রকল্পই হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যার মাধ্যমে রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও বগুড়ার তিন লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ প্রকল্পের জন্য শুষ্ক মৌসুমে ৮ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন হয়। তিস্তা ব্যারেজ দিয়ে এ পানি আসত। বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ভারত তিস্তা ব্যারেজের একশ’ কিলোমিটার উত্তরে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে সমস্ত পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে বর্তমানে ওই প্রকল্প এলাকায় তীব্র পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং গোটা প্রকল্প হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও ভারতকে পানিবণ্টনে চুক্তিবদ্ধ হতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছে। গত ৮ বছরে জেআরসির কোনো বৈঠকেই তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি এজেন্ডাভুক্ত করতে ভারত রাজি হয়নি। মূলত ভারতের অনীহার কারণেই চুক্তি হচ্ছে না। আর যদি চুক্তি হয়ও, তাহলেও বাংলাদেশের স্বার্থে হবে না। গঙ্গা চুক্তির মতো এটিও হবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেই। সম্প্রতি জেআরসির যে বৈঠক হলো, সেখানে ১০ ভাগ পানি নদীর নাব্যের জন্য রেখে অবশিষ্ট পানি দুই দেশ ভাগাভাগি করে নেয়ার যে প্রস্তাব বাংলাদেশ দিয়েছিল, ভারত তাতেও রাজি হয়নি। এটিও চুক্তি না হওয়ার ব্যাপারে তাদের অনাগ্রহের প্রকাশ। এছাড়া ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে তাদের দক্ষিণাঞ্চলে নেয়ার যে পরিকল্পনা করছে, বাংলাদেশের জন্য এটিও মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/02/25477
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment