Thursday 22 April 2010

মাঠ প্রশাসনে অস্থিরতা

সাবি্বর নেওয়াজ : Samakal ঢাকা | ১৯ এপ্রিল ২০১০
মাঠ প্রশাসনে অস্থিরতা বাড়ছে। গতি কমেছে প্রশাসনিক কাজে। জনদুর্ভোগও বেড়েছে। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়সহ কৃষি, পশুসম্পদ, সমবায়, থানা শিক্ষা অফিস, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে নথি নিষ্পত্তির গতি আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। এ মূল্যায়ন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন শাখার। উপজেলা পরিষদ নতুন করে যাত্রা শুরু করার পর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও মর্যাদা নিয়ে চরম বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা (ইউএনও)। কাজের গতি কমার জন্য এই দ্বন্দ্বকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের নির্দেশনা মতো উপজেলা প্রশাসন চালাচ্ছেন ইউএনওরা। উপজেলা চেয়ারম্যানরা কোথাও কাজের সুযোগ পাচ্ছেন, আবার কোথাও একেবারেই পাচ্ছেন না। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা চেয়ারম্যান বাবেল গোলন্দাজের সঙ্গে স্থানীয় সাংসদ ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। সাংসদ যদি 'পূর্ব' বলেন, তবে উপজেলা চেয়ারম্যান সরাসরি বলে দেন 'পশ্চিম'। আর এ অবস্থায় চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার দশা হয়েছে ইউএনও খেনচানের। তিনি দু'জনকেই আস্থায় এনে প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করেও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে স্থানীয় সাংসদ সুলতানা তরুণের পছন্দের প্রার্থীকে কলেজের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ায় সাংসদের
লোকজন ইউএনও নূরুজ্জামানকে মারধর করে গুরুতর আহত করে। এরপর ওই ইউএনওকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। চাঁদপুরের কচুয়ায় দিনকয়েক আগে সরকারদলীয় ক্যাডাররা উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোস্তাফিজুর রহমানকে মারধর করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে আসে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে চলতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গতি হারাচ্ছে মাঠ প্রশাসন।
মাঠ প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, 'উপজেলা পরিষদ নিয়েই নানা অস্পষ্টতা। সবার আগে সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে, উপজেলা পরিষদের ভূমিকা কী হবে আর সেখানে ইউএনওর ভূমিকাইবা কী হবে। এ বিষয়টি যতক্ষণ স্পষ্ট না হবে ততক্ষণ কোনো সমাধান মিলবে না।' তিনি বলেন, 'সরকার যদি স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীই করতে চায় তবে সেখানে সরকারি কর্মকর্তার ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট করে সরকারকে বলতে হবে।'
জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনে এখন সবচেয়ে তীব্র চাপের মুখে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। স্থানীয় পর্যায়ে তাদের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়েছে প্রচণ্ডভাবে। আইন ও সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী অনেকে কাজ করতে পারছেন না। প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে নানারকম বরাদ্দ, হাট-ঘাট, জলমহাল ও বালুমহাল ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে চাপের মুখে অনিয়ম করতে হচ্ছে তাদের। এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ইচ্ছানুযায়ী তাদের কাজ করতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যান দ্বন্দ্বে চরম কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন ইউএনওরা। সরকারি বিভিন্ন কর্মকালোঞ্ছিত হয়েছেন। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে তারা লিখিতভাবে জানিয়েছেন। অনেক স্থানে জেলা প্রশাসকরা চেষ্টা করছেন সমঝোতা করে প্রশাসন চালিয়ে নিতে।
পাবনার একটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কয়েকদিন আগে সমকালকে জানান, মহাসড়কের পাশে সরকারি জমিতে অবৈধ ক্লাবঘর তৈরি করে প্রতিদিন জুয়া খেলার আয়োজন করেছিল স্থানীয় কিছু যুবক। জানতে পেরে তিনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অবৈধ ওই স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। ক্লাব পরিচালনাকারীরা সরকারি দল সমর্থিত হওয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন। তিনি ইউএনওকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন।
ইউএনও বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান। এতে উপজেলা চেয়ারম্যান আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি এখন ইউএনওকে ওই উপজেলা থেকে বদলি করে দিতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নানা লোক দিয়ে প্রতিদিন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করাচ্ছেন। সাতক্ষীরা জেলায় কর্মরত একজন ইউএনও জানান, ঢাকায় অবস্থানরত তার একমাত্র ছেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে জানিয়ে ঢাকা রওনা হয়ে যান। তবে সংসদ সদস্য তাকে যেতে নিষেধ করেন। এরপর ইউএনও ফিরে আসেন। দু'এক ঘণ্টা পর ছেলের অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে তিনি শেষতক ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন। পরদিন সংসদ সদস্য উপজেলায় তার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে এসে ইউএনওকে না পেয়ে ফোন করে গালমন্দ করেন।
মাগুরার একজন ইউএনও সমকালকে বলেন, 'বাস্তবতা হলো অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, উপজেলা চেয়ারম্যানরা উপজেলার সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চান। কিন্তু আইনের কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবার সরকারি চিঠিপত্রের ভাষা ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না।' তিনি বলেন, 'একজন ইউএনও একই সঙ্গে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটও। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ইউএনও উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা, পাবলিক পরীক্ষা, ১৪৪ ধারা জারি ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে থাকেন। এই ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও অনেক চেয়ারম্যান হস্তক্ষেপ করতে চান।' পাবনার একটি উপজেলায় কর্মরত একজন ইউএনও বলেন, হাট-বাজার ও জলমহাল ইজারা কমিটির চেয়ারম্যান ইউএনও। একজন ইউএনও চান সরকারের সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে। অথচ চেয়ারম্যানরা অনেক ক্ষেত্রেই এ কমিটির ওপর চাপ সৃষ্টি করেন দলীয় বিবেচনায় কাউকে কম টাকায় এগুলো ইজারা দিতে। একইভাবে ভূমি উন্নয়ন কমিটিরও আহ্বায়ক ইউএনও। খাসজমি, অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি সরকারি দলের লোকদের বরাদ্দ দিতে সরাসরি এমপি বা চেয়ারম্যানরা চাপ সৃষ্টি করে থাকেন।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ইউএনও রদবদলে এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের তদবিরে মাঠ প্রশাসনে রীতিমতো অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ডিও লেটার দিয়েও কাজ না হলে ইউএনও প্রত্যাহার চূড়ান্ত করতে অনেকে সরাসরি মন্ত্রণালয়ে এসে জোর তদবির করছেন। এতে মাঠ প্রশাসনে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। নিয়ম-কানুন না মেনে কোনো কোনো ইউএনও বাধ্য হয়ে এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের মন জুগিয়ে চলছেন। একজন উপ-সচিব জানান, প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ইউএনওকে সরিয়ে দেওয়ার তদবির নিয়ে আসেন।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের ১৪ মাসে এ পর্যন্ত শতাধিক এমপি এবং অর্ধশতাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান ইউএনও রদবদলের জন্য সংস্থাপন সচিবকে ডিও লেটার দিয়েছেন। অনেকে তদবির করেন টেলিফোনে। কেউ আসেন সরাসরি অভিযোগ নিয়ে। গত এক মাসে ইউএনও রদবদলের জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন ২০ জন এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। এর মধ্যে ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, বান্দরবান, সাতক্ষীরা, পাবনা, কুষ্টিয়া, নড়াইল, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলার কয়েকটি উপজেলা রয়েছে। ইতিমধ্যে ডিও লেটার দেওয়া কয়েকজনের প্রস্তাব কার্যকর করেছে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, যৌক্তিক কারণ থাকলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে এমপি কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান ইউএনও রদবদলে ডিও লেটার দিতে পারেন। তবে ইদানীং বদলি করার জন্য হরহামেশা ডিও লেটার দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোতে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয় না। ইউএনওকে না রাখার কারণ হিসেবে বলা হয়, ইউএনও কথা শুনতে চায় না। আর কথা না শোনা মানেই ধরে নেওয়া হয়, তিনি বিরোধী দলের সমর্থক কিংবা দুর্নীতিবাজ। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এভাবে প্রশাসন চালাতে গেলে একসময় সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ওপর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আস্থা হারিয়ে ফেলবেন। এতে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতাও ধরে রাখা যাবে না।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ হাওলাদার গতকাল পাল্টা অভিযোগ করে সমকালকে বলেন, 'একজন ইউএনও যত অন্যায়ই করুন না কেন তাকে তার জেলা প্রশাসক রক্ষা (সেভ) করেন। আবার ডিসিকে সেভ করেন বিভাগীয় কমিশনার। কমিশনারকে সেভ করেন সচিব। এভাবে তারা একটা চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে রক্ষা পেয়ে যান। এখন পর্যন্ত তাদের কারও মনোভাবই গড়ে ওঠেনি জনপ্রতিনিধিদের অধীনে কাজ করার জন্য। এটা দুঃখজনক।'
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'ইউএনওরা চাকরি করেন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সেদিকে আনুগত্য রয়েছে। আবার তাদের বলা হচ্ছে উপজেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা করতে। কাঠামোগত আইনের দুর্বলতার কারণেই মাঠ প্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'আইনের আওতায় ইউএনও-উপজেলা চেয়ারম্যান পরস্পরকে সহযোগিতা ও সম্মান করলে জনগণের উপকার হবে। এতে কারোরই ক্ষমতা খর্ব হবে না। কারণ উপজেলা চেয়ারম্যান কাজ করতে গেলে একজন সরকারি কর্মকর্তা তার লাগবেই। আবার সরকারি কর্মকর্তাদেরও বোঝা উচিত, জনপ্রতিনিধিদের অধীনেই তাদের কাজ করতে হবে। কারণ এটাই স্বাভাবিক, এটাই জনগণের রায়।'
ত্রিমুখী বিরোধ মিটিয়ে উপজেলা প্রশাসনকে কীভাবে কার্যকর করা যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আসলে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এসব সমস্যা দূর করা কোনো ব্যাপারই নয়। সরকার কি আসলেই চায়, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় হোক? খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় যেভাবে একের পর এক সার্কুলার মাঠ প্রশাসনে পাঠাচ্ছে, তাতে উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাজ করার কোনো সুযোগই থাকছে না। আবার সরকার প্রত্যেক এমপিকে সরাসরি ১৫ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয় সরাসরি অনেক প্রকল্প মাঠ পর্যায়ে ইউএনওদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে। এটা না করে সম্মিলিতভাবে উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে এগুলোর বাস্তবায়ন করা দরকার।' ড. তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী আরও বলেন, সাংসদের পরামর্শও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিতে হবে। কেননা, তারাও জনরায় নিয়ে এসেছেন। তাদের ওপরও জনগণের প্রত্যাশা রয়েছে।'

http://www.samakal.com.bd/details.php?news=13&view=archiev&y=2010&m=04&d=19&action=main&option=single&news_id=60118&pub_no=311

No comments:

Post a Comment