Thursday 22 April 2010

রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশের এসআই খুন : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে




স্টাফ রিপোর্টার
রাজধানীর বংশাল থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) গৌতম কুমার রায়কে (৪৩) গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। সোমবার রাতে থানা থেকে বাসায় যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা সূত্রাপুরের লালমোহন শাহ স্ট্রিটে তাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। এ ঘটনায় শামিম নামে তার এক বন্ধুও গুলিবিদ্ধ হন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুরনো ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদের বেশ কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতার ও ক্রসফায়ারে দেয়ার বদলা হিসেবে গৌতমকে খুন করা হতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। কয়েক মাস আগে দারোগা গৌতম রায়কে ডাকাত শহীদ ভারত থেকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার হুমকি দিয়েছে। তিনি হুমকির কথা সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনদেরও জানিয়েছেন। এরপর থেকেই তিনি ভীত ছিলেন। ডাকাত শহীদের টার্গেটে পড়ায় তিনি বদলির চিন্তাও করছিলেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গৌতমের লাশ দেখতে এসে লাশের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সাব-ইন্সপেক্টর খুনের ঘটনাকে তিনি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করেন।
বংশাল থানার ওসি আবদুল মান্নান জানান, সোমবার রাত পৌনে ২টায় গৌতম বাসার উদ্দেশে থানা থেকে বের হন। বন্ধু শামিমের জিপে করে ওয়ারীর বাসায় যাওয়ার কথা তার। এসময় তার সঙ্গে আজম নামে আরেক বন্ধু ছিলেন। গৌতম ছিলেন সাদা পোশাকে। তার সঙ্গে অস্ত্র ও ওয়াকিটকি ছিল। শামিমের গাড়িতে করে প্রায়ই গৌতম বাসায় যেতেন। প্রত্যক্ষদর্শী আজম জানান, তারা গাড়িতে করে থানা থেকে ৩শ’ গজ দূরে লালমোহন শাহ স্ট্রিটে আশরাফ ইলেকট্রনিক্স দোকানের গলিতে গিয়ে নামেন। সেখানে আগে থেকেই শামিম উপস্থিত ছিলেন। গাড়ি থেকে নেমে গৌতমসহ তিনজন হেঁটে সামনের দিকে যাচ্ছিলেন। গৌতম ছিলেন দুই বন্ধু থেকে একটু পেছনে। এসময় তিনি দেখতে পান রাস্তায় তিন যুবক ঘোরাফেরা করছে। তাদের দেখে সন্দেহ হলে গৌতম চ্যালেঞ্জ করেন। তিন যুবককে তল্লাশি করার জন্য এগিয়ে যান তিনি। একজনের দেহ তল্লাশি করার সময় তার কাছে অস্ত্র আছে বলে সন্দেহ হয়। এসময় সে দেহ তল্লাশিতে বাধা দিলে গৌতম সঙ্গে থাকা অস্ত্র বের করার চেষ্টা করেন। এসময় অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা দুই সন্ত্রাসী এগিয়ে এসে গৌতমকে চেপে ধরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি চালায়। তার শরীরে তিনটি গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়ে চিত্কার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন গৌতম। রক্তে ভিজে যায় রাস্তা। তাকে রক্ষার জন্য দুই বন্ধু এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। তখন শামিমের ডান হাতে এক রাউন্ড গুলিবিদ্ধ হয়। পরে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে এলাকা ত্যাগ করে। গুলির শব্দে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় দুই বন্ধু গৌতমকে পুরনো ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। তার অবস্থার অবনতি দেখে চিকিত্সকরা দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। রাত ২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেলে জরুরি বিভাগে পৌঁছার পর কর্তব্যরত চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত বন্ধু শামিমকে একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গৌতমের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ প্রশাসনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার সহকর্মীরা দ্রুত হাসপাতালে ছুটে আসেন। খবর পেয়ে গৌতমের স্ত্রী ডলি রায় ও আত্মীয়স্বজনরাও ছুটে আসেন হাসপাতালে। তারা গৌতমের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বামীর লাশ জড়িয়ে ধরে চিত্কার করে কাঁদতে থাকেন স্ত্রী ও দু’সন্তান। তাদের আর্তচিত্কারে হাসপাতালের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
জানা যায়, গৌতম রায়ের বন্ধু শামিমের ধোলাইখাল ভূঁইয়া মার্কেটে মোটরপার্টসের ব্যবসা আছে। তার দোকানের নাম নেয়ামুল মোটরস। গৌতমের সঙ্গে শমিম ও আজমের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। গৌতমের বাসায় যাওয়ার পথে শামিম ও আজমের বাসা। তাই প্রায়ই শামিমের গাড়িতে গৌতম বাসায় যেতেন। কখনও শামিম, আবার কখনও আজম সঙ্গে থাকতেন। ঘটনার দিন রাতে শামিম আগেই বাসায় যান। আজমকে নিয়ে শামিমের গাড়িতে করে বের হয়েছিলেন গৌতম। গাড়ি চালাচ্ছিলেন গৌতম নিজেই। সূত্রমতে, প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার সময় সূত্রাপুরের ৫২/৪, লালমোহন শাহ স্ট্রিটে মহিউদ্দিন মার্কেটের গলিতে নেমে তিনজনে গল্প করে সময় কাটাতেন। এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে গৌতম বাসায় চলে যেতেন। প্রতিদিনের মতোই সেদিন রাতে গৌতম, শামিম ও আজম আশরাফ ইলেকট্রনিক্স মার্কেটের কাছে মহিউদ্দিনের গলিতে নেমে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এসময় সেখানে আগে থেকেই তিন সন্ত্রাসী ওঁত্ পেতে ছিল। তাদের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছর হবে। গৌতম রায় বাসায় যাওয়ার পথে রাতে যে ওই এলাকায় প্রতিদিনই আসেন, তা সন্ত্রাসীদের আগে থেকেই জানা ছিল। তাই পরিকল্পিতভাবেই সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। কেননা, তিন বন্ধুকে নিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তিন যুবক গৌতমের কাছেই ছিল। তারা গৌতমের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করতে থাকায় সন্দেহ হলে গৌতম তাদের চ্যালেঞ্জ করে। তদন্ত সূত্র জানায়, ওই তিন যুবক ছিনতাইকারী হলে তারা গৌতমের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন, সঙ্গে থাকা অস্ত্র ও ওয়াকিটকি নিয়ে যেত। গৌতমকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
সহকর্মীরা বলেন, গৌতম রায় ছিলেন পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি ৫ মাস ধরে বংশাল থানায় অপারেশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে ৩ মাস ছিলেন চকবাজার থানায়। তারও আগে পৌনে দু’বছর ছিলেন সূত্রাপুর থানায়। সূত্রাপুরের আগে ছিলেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ওয়ারী জোন ও কেরানীগঞ্জে চাকরিকালে এলাকার অপরাধীদের সম্পর্কে তার কাছে অনেক তথ্য ছিল। সূত্রাপুর থানায় থাকাকালে ডাকাত শহীদের ১৪ সহযোগীকে গ্রেফতার করেন গৌতম। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে ৪ জন মারা যায়। এসব কারণে পলাতক ডাকাত শহীদ তার ওপর ক্ষেপা ছিল।
বংশাল থানা পুলিশ জানায়, ’৯৮ সালে এসআই পদে প্রশিক্ষণ শেষে কাজ শুরু করা গৌতম রায় সর্বশেষ পরিদর্শক পদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। ২০০৯ সালে বংশাল থানা উদ্বোধন হওয়ার ১ মাস পর তিনি চকবাজার থেকে বংশাল থানায় যোগ দেন। ৫ ভাই ১ বোনের মধ্যে সবার বড় গৌতম রায়ের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জে। তার বাবার নাম ইন্দুভূষণ রায়। দু’সন্তান গৌরব এবং অদিতি। গৌরব (১৬) এবছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে গাজীপুরের রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে। অদিতি (৬) পড়ছে লক্ষ্মীবাজার সেন্ট প্রিপারেটরি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে।
এ ব্যাপারে সূত্রাপুর থানার এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ জানায়, এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পুরো এলাকায় তল্লাশি চলছে। পুলিশের ধারণা, ৭০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহম্মদ কমিশনার হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আহম্মদ কমিশনার হত্যায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদের একাধিক সহযোগীকে গ্রেফতার করার পেছনে গৌতম রায়ের ভূমিকা ছিল। ১৬/৯ ওয়ারী র্যাংকিং স্ট্রিটে ডমিনিয়ন অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জে। দুপুরে তার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনরা।
এদিকে লাশ দেখতে হাসপাতালে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সোবহান শিকদার, ডিএমপি কমিশনার একেএম শহীদুল হক, র্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত আইজি নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। ঘটনার পরই ঘাতকদের গ্রেফতার করতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, পুলিশ, সিআইডি পৃথকভাবে তদন্ত চালাচ্ছে। র্যাবের গোয়েন্দা উইং পৃথকভাবে তদন্ত করছে। সিআইডি লাশের বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছে।
গৌরীপুরের বাড়ীতে শোকের মাতম
গৌরীপুর প্রতিনিধি জানান, গৌতম রায়ের মরদেহ গতকাল বিকাল ৫টায় তার নিজ বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জ এসে পৌঁছলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। হাজার হাজার মানুষ গৌতম রায়ের লাশ একনজর দেখার জন্য সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও ভাইবোনদের আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। নিহতের স্ত্রী ডলি রায় এ সময় বারবার মূর্ছা যেতে থাকেন। একমাত্র ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী গৌরব রায় বারবার বলতে থাকে, বাবা বলত আমাকে ভালো ফলাফল করতে হবে। আমি আমার রেজাল্ট কাকে দেখাব। ছয় বছরের শিশুকন্যা অবুঝ অদিতি রায়কেও এসময় ক্রমাগত কাঁদতে দেখা যায়।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/21/28434

No comments:

Post a Comment