Thursday 22 April 2010

মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ

শরিফুল হাসান | Prothom-alo তারিখ: ২১-০৪-২০১০

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। অথচ বর্তমান সরকারের ১৫ মাসে ওই দেশে গেছেন মাত্র ১৬ হাজার ৯২১ জন বাংলাদেশি কর্মী। একই সময়ে সেখান থেকে ফিরেছেন ৩১ হাজার ৩০৬ জন। আগের বছরগুলোতে গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ লোক সৌদি আরবে গেছেন। জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি খাতে গত তিন দশকের মধ্যে কখনোই এমন বিপর্যয় হয়নি।
একই অবস্থা কুয়েতেও। গত ১৫ মাসে কুয়েতে গেছেন মাত্র ২১ জন কর্মী। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিতে গড়ে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার বাংলাদেশি যেতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বাকি চার দেশের মধ্যে কাতার, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেও জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। তবে কিছুটা বেড়েছে বাহরাইনে।
৭০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে ৪০ লাখই থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে। এর মধ্যে সৌদি আরবে প্রায় ২০ লাখ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৪ লাখ, ওমান ও কুয়েতে আড়াই লাখ করে পাঁচ লাখ, বাহরাইনে দেড় লাখ ও কাতারে এক লাখ ২৪ হাজার।
জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অভিযোগ, কিছু বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে খুন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে, সৌদি আরবে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এসবের পাশাপাশি গত ১৫ মাসে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি মহল দেশে-বিদেশে এক ধরনের নেতিবাচক প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু সরকার কূটনৈতিকভাবে এর জবাব দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও পরিস্থিতি বদলায়নি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সংকট উত্তরণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসগুলোতে চিঠি পাঠিয়েছে। তাতে কেন হঠাৎ করে এভাবে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাচ্ছে, তার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার চলছে। দূতাবাসগুলো এর জবাব দিতে পারছে না। এমনকি দূতাবাসগুলোর কোনো গণমাধ্যম শাখাও নেই। ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে এখন মধ্যপ্রাচ্যে একটি ভুল ধারণা জন্মাচ্ছে। ফলে তারা বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া রাতারাতি কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনশক্তি খাতকে বাঁচাতে হলে যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ঠিক করতেই হবে। এ জন্য সরকারের সম্ভাব্য যা যা করণীয়, সবই করা উচিত।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ সরকার জনশক্তি রপ্তানি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। কাজেই এ খাতের সব সমস্যাই সমাধান করা হবে। তবে রাতারাতি সেটি সম্ভব নয়।
মন্ত্রী বলেন, সৌদি আরবে রোহিঙ্গারা নানা সমস্যা করছে। কুয়েতে কিছু বাংলাদেশি বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিল। এসব কারণে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সৌদি আরবে লোক যাওয়া বন্ধ হয়নি। বরং তারা কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া আধুনিক (বায়োমেট্রিক্স) করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলোর বাজার খুব শিগগিরই আরও ভালো হবে বলে আশা করেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়গুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া শাখার মাধ্যমে দেখভাল করা হয়। এ বিষয়ে জানতে ওই শাখার মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাফরের সঙ্গে গতকাল রাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক বিষয়সহ অন্যান্য বিষয় দেখে। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি একান্তই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখভাল করে। কাজেই তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তার সবই নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের পর সেখানকার পরিস্থিতি ইতিবাচক। কুয়েত লোক না নিলেও সেখানে এখন কর্মীরা আকামা পরিবর্তন করতে পারছেন। আরব আমিরাত খুব শিগগির আরও লোক নেবে। মন্দা, কিছুসংখ্যক বাঙালির অপরাধসহ নানা কারণে বাজার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে খুব শিগগির বাংলাদেশ আবার বাজার ফিরে পাবে। এ জন্য করণীয় সব কিছুই করা হবে।
আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৌদি আরবে: বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত কতজন বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন, সে হিসাব সংরক্ষিত আছে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে।
সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৮ সালেও এক লাখ ৩২ হাজার ১২৪ জন কর্মী এবং ২০০৭ সালে দুই লাখ চার হাজার ১১২ জন কর্মী সেখানে গিয়েছিলেন। ২০০৬ সালে এ সংখ্যা ছিল এক লাখ নয় হাজার ৫১৩। ১৯৭৬ সাল থেকে গত ৩৩ বছরের সংরক্ষিত হিসাব থেকে দেখা গেছে, ’৭৬ সালের পর প্রতিবছরই সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ছিল। আশির দশকে প্রতিবছর গড়ে সেখানে গেছেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক। ১৯৯২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই গড়ে গেছেন এক থেকে দেড় লাখ কর্মী। কিন্তু ২০০৯ সালের শুরু থেকে হঠাৎ করেই এ সংখ্যা রাতারাতি কমে যায়।
বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া রাতারাতি কমিয়ে দিলেও বিশ্বের একমাত্র হিন্দুপ্রধান দেশ নেপাল ও ভারত থেকে লোক নিচ্ছে সৌদি আরব। শুধু জনশক্তি রপ্তানি কমানো নয়, সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতিপত্রও (আকামা) বদল করতে দিচ্ছে না। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ছয় থেকে সাত লাখ কর্মীকে।
সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের নেতাদের এখানে প্রচণ্ড দাপট। মূলত তাঁরা বিভিন্ন সময়ে সৌদি সরকারকে বোঝাচ্ছেন, বাংলাদেশে ইসলামি দলগুলোর বিরুদ্ধে নিপীড়ন চলছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া শুরুর পর নিপীড়ন বেড়েছে। ফলে খুব সহজে বাজার স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
দরজা বন্ধ কুয়েতে: গত ৩৩ বছরে কুয়েতের জনশক্তি রপ্তানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭৬ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতিবছর ১০ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন। ’৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের পক্ষে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সুনাম বেড়ে যায়। এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে গেছেন ২৫ হাজার লোক। ২০০১ সালের পর তা বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। তবে ২০০৯ সালে এসে এ ধারা এক প্রকার বন্ধই হয়ে যায়। ২০০৯ সালে মাত্র ১০ জন লোক কুয়েতে গেছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েত সফর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কুয়েতের আমিরের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানান। তবে এখনো ইতিবাচক কোনো সাড়া মেলেনি।
অন্য চার দেশের অবস্থা: ২০০৮ সালে ২৫ হাজার ৪৪৮ জন কর্মী কাতারে, ৫২ হাজার ৮৯৬ জন কর্মী ওমানে এবং চার লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। আর গত ১৫ মাসে ১৪ হাজার ১৬৬ জন কাতারে, ৪৮ হাজার ৬১৪ জন ওমানে ও তিন লাখ ১৪ হাজার ৬২৩ জন সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন। আগের বছরের তুলনায় এই তিন দেশে জনশক্তি রপ্তানি ১৫ মাসে এক লাখ ২০ হাজার কমেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে একমাত্র বাহরাইনেই জনশক্তি রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। ২০০৮ সালে বাহরাইনে গিয়েছিলেন ১৩ হাজার ১৮২ জন কর্মী। আর ২০০৯ সালে ২৮ হাজার ৪২৬ জন কর্মী দেশটিতে গেছেন। গত তিন মাসে দেশটিতে গেছেন আরও পাঁচ হাজার কর্মী।
বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরবের অবস্থা খুবই খারাপ। এই বাজার চালু করতে না পারলে ভবিষ্যৎ খুবই সংকটাপন্ন। এ জন্য এখনই জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও কেন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না, এখন কী করলে সমস্যার সমাধান হবে, সে বিষয়গুলো খুঁজে বের করা দরকার।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-04-21/news/57844

No comments:

Post a Comment