Tuesday 6 April 2010

রফতানি অর্ডার পেয়েও ধরতে পারছেন না উদ্যোক্তারা : বিদ্যুতের অভাবে চামড়া খাতে ৬৫ ভাগ উত্পাদন হ্রাস

সৈয়দ মিজানুর রহমান
গতবছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে চামড়া খাতে ৭২০ কোটি টাকার রফতানি আদেশ বাতিল করে দিয়েছিলেন বিদেশি ক্রেতারা। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই এমনটা হয়। তবে এবছর ঘটছে উল্টোটা। রফতানি আদেশের প্রায় ৬৫ ভাগই ফিরিয়ে দিচ্ছে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও রফতানিকারকরা। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে না পারায় রফতানি আদেশ ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে শুধু ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি দেশ থেকে রফতানি আদেশ পাওয়া যেত। এবার আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলো থেকেও ছুটে আসছেন ক্রেতারা। তবে সমস্যা হচ্ছে—যত রফতানি আদেশ পাওয়া যাচ্ছে, তার অর্ধেকও নিতে পারছেন না চামড়া খাতের রফতানিকারকরা। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে ট্যানারিগুলো প্রায় অচল। বিশেষ করে গত দু’মাসে বিদ্যুত্ সঙ্কটে ট্যানারিগুলোর প্রসেসিং ক্ষমতা ৬৫ ভাগ কমে গেছে। ফলে বিশ্ববাজারের চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে পারবে বাংলাদেশ, সেটি নিয়ে এখন দেখা দিয়েছে সংশয় ।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি রেজাউল করিম আনসারী গতকাল আমার দেশকে জানিয়েছেন, গতবছর চামড়া খাতে অর্ধেক রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে গিয়েছিল। তবে এবছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে কয়েকশ’ বিদেশি ক্রেতা বিভিন্ন ট্যানারি চষে বেড়াচ্ছেন। রফতানি আদেশ নিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুত্ ও গ্যাস নিয়ে। তিনি জানান, যা রফতানি আদেশ পাওয়া যাচ্ছে, তার ৬৫ ভাগও নেয়া যাচ্ছে না। তিনি জানান, বর্তমানে ট্যানারিগুলো বিদ্যুত্ পাচ্ছে দৈনিক গড়ে ৪/৫ ঘণ্টা। অথচ ট্যানারিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ থাকা জরুরি। তাপমাত্রা ঠিক রাখতে না পারায় হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকায় পচা-দুর্গন্ধও ছড়িয়ে পড়ছে আগের চেয়ে বেশি।
চামড়া খাতে মোট রফতানির ৭/৮ শতাংশ হয়ে থাকে হাজারীবাগের করিম লেদারস থেকে। গতকাল দুপুরে এ চামড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে, অন্ধকারে অলস বসে আছে শ্রমিকরা। পুরো ফ্লোর প্রায় ফাঁকা। প্রসেসিং হয়ে যে পরিমাণ চামড়া পাওয়া যাচ্ছে, তার সবই চলে যাচ্ছে বিদেশে।
করিম লেদারসের স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম জানান, ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে তারা বিদেশের বাজারে ১৭ লাখ ৬৩ হাজার বর্গফুট চামড়া রফতানি করেন। যা থেকে আয় এসেছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ ৭২ হাজার ৮২৫ টাকা। গতবছর একই সময়ে রফতানি হয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার বর্গফুট চামড়া। যা থেকে আয় এসেছে মাত্র ৭ কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার ৩৮০ টাকা। আর এবছর জানুয়ারি-মার্চ সময়ে রফতানি আদেশ পাওয়া গেছে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ বর্গফুট চামড়ার; কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তার অর্ধেকের রফতানি আদেশও চূড়ান্ত করা যায়নি।
দাম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএফএলএলএফইএ চেয়ারম্যান বলেন, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী চামড়ার দাম গড়ে প্রায় ২০ ভাগ বেড়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত অর্থবছরের মার্চে ফিনিশড্ বলে পরিচিত ১ থেকে ৪ নং কোয়ালিটির এক বর্গফুট চামড়ার রফতানি মূল্য ছিল ১ ডলার ৪০ সেন্ট। এখন একই মানের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ১ ডলার ৮০ থেকে ১ ডলার ৯০ সেন্ট দিয়ে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে (২০০৯-১০) চামড়া খাতে রফতানি আয়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ২৩০ দশমিক ৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রফতানি হয়েছে ১১৪ দশমিক ৯১ মিলিয়ন ডলার। জুলাই-জানুয়ারিতে রফতানি আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৯০ শতাংশ।
এ শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, ট্যানারিগুলোয় বিদ্যুত্ সঙ্কট না কাটলে এ শিল্পের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, প্রতিবছর দেশি বাজার থেকে প্রায় ২শ’ মিলিয়ন ঘনফুট বিভিন্ন ধরনের পশুর চামড়া সংগ্রহ হয়ে থাকে। এর মধ্যে কোরবানির পশুর চামড়াই থাকে ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বছরে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এ খাতে কর্মরত রয়েছে ৬৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। পুরো সক্ষমতা ব্যবহার ও পরিবেশসম্মত উত্পাদন নিশ্চিত করা হলে এ খাতে আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব আরও ৪ লাখ লোকের।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, নীতিগত সহায়তা অথবা নগদ সহায়তা যেভাবেই হোক, দেশি পণ্যের এ খাতকে রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলো কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে, সেগুলো মাথায় রেখে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/07/26305

No comments:

Post a Comment