Saturday 3 April 2010

বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে থমকে গেছে গ্রামীণ অর্থনীতি



Shamokal | শনিবার | ৩ এপ্রিল ২০১০ | ২০ চৈত্র ১৪১৬ | ১৭ রবিউস সানি ১৪৩১

সেচ কার্যক্রম ব্যাহত
হিমাগারে পণ্য পচে যাচ্ছে
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে উৎপাদন নাজুক
মূল্যস্ফীতি বাড়ছে


দেলোয়ার হুসেন/আব্দুল কাইয়ুম তুহিন
বগুড়া সদর উপজেলার কৃষক আবদুর রহমান তার ক্ষেতে উৎপাদিত আলু অনেক কষ্টে রেখেছিলেন হিমাগারে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটের কারণে হিমাগারে রাখা আলু নষ্ট হতে থাকে। বাধ্য হয়ে তিনি কম দামে আলু বিক্রি করে দেন। এতে তার লাভের চেয়ে বরং লোকসানই হয়েছে। বিদ্যুৎ সংকটে হিমাগারগুলো অচল হয়ে পড়ায় অধিকাংশ কৃষকেরই একই অবস্থা। টেকনাফের বার্মিজ মার্কেটের ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান জানান, স্থানীয়ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ভালো হলেও বিদ্যুৎ সংকট তাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। নিজস্ব জেনারেটরও বেশিক্ষণ চালু রাখা সম্ভব হয় না। ফলে ভালো যাচ্ছে না বেচাকেনা। গাজীপুরের এক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা একটি প্লাস্টিক কারখানা চালান। বিদ্যুতের অভাবে দিনের বেশিরভাগ সময়ই তার কারখানা বন্ধ থাকে। পুঁজির অভাবে নিজস্ব জেনারেটর স্থাপন করতে পারেননি। ফলে তিনি চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের জোগান দিতে পারছেন না। এ কারণে ক্রেতা হারাচ্ছেন তিনি। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে ভারী শিল্প-কারখানার পাশাপাশি ছোট ছোট কারখানা মালিকরাও তাদের উৎপাদন চালু রাখতে পারছেন না। সেচ পাম্প চালাতে না পারায় ব্যাহত হচ্ছে ফসলি জমিতে সেচের কার্যক্রম। গ্রামের কৃষিভিত্তিক শিল্প ও অর্থনীতির উন্নয়নে গতিশীলতা লক্ষ্য করা গেলেও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটে হঠাৎ করেই যেন তা থমকে দাঁড়িয়েছে। এই দুই সংকটের সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা যোগ হয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির গতি রোধ করে দিয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবাসীদের পাঠানো
টাকা শহরের চেয়ে এখন গ্রামেই বেশি যাচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে টাকার প্রবাহ। এতে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পেঁৗছে যাচ্ছে যন্ত্রচালিত গাড়ি। গ্রামের দিকে প্রসারিত হচ্ছে নগর ও নাগরিক সংস্কৃতি। অপরিকল্পিতভাবে গ্রামে নগরায়ন প্রসারিত হওয়ায় একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে কমে যাচ্ছে কৃষি জমির পরিমাণ। গ্রামে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় মৌসুমের সময়ে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। মৌসুম শেষে একই পণ্য তাদের কিনতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে। বর্তমান সরকার গ্রামের কৃষিভিত্তিক শিল্প ও অর্থনীতির উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভয়াবহ সংকটসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
টাকার প্রবাহ বাড়ছে : গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। তবে এগুলো উৎপাদন খাতে না গিয়ে যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। ওই টাকায় গ্রামে বিলাসবহুল ঘরবাড়ি হচ্ছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রায় ৬০ শতাংশই যাচ্ছে গ্রামে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি বড় অংশ ১২ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণের প্রায় পুরোটাই যাচ্ছে গ্রামে। এছাড়া শিল্প খাতের ঋণের একটি অংশও যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে গ্রামে। তবে এখনও গ্রামের সঞ্চয় চলে আসছে শহরে। গ্রামে সঞ্চয়ের অর্থ মাত্র ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে। বাকি ৭৫ শতাংশ চলে আসছে শহরে। গ্রামে বিনিয়োগও হচ্ছে কম।
ব্যাংকের শাখার দিক থেকে সার্বিকভাবে গ্রামীণ শাখার সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর ৬০ শতাংশের বেশি শাখা গ্রামে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা বেশি শহরে। এই ব্যাংকগুলোও গ্রামে তাদের শাখার সংখ্যা বাড়াতে শুরু করেছে। গ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য ও টাকার প্রবাহ বাড়ায় তারা সেখানে ছুটে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ সমকালকে বলেন, গ্রামে মানুষ বাড়ছে। যেখানে মানুষ আছে সেখানেই ব্যবসা বাড়ছে। এ কারণে এখন গ্রামে ব্যবসার ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা শ্রেণী। গ্রামের নারীরাও অভাবনীয় সাফল্যের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। অতিদরিদ্র শ্রেণী থেকে মানুষ বেরোতে শুরু করেছে। এসব কারণে এখন উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে গ্রাম।
মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে : খাদ্যের উৎপাদনের কেন্দ্র হচ্ছে গ্রাম। সেই গ্রামেই এখন খাদ্যের দাম বেশি। এ কারণে শহরের পাশাপাশি গ্রামেও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। গত জানুয়ারিতে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৮১ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্য খাতে প্রায় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ তথ্যই বদলে দিচ্ছে গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র। গ্রামের সাধারণত খাদ্যের চাহিদাই বেশি। খাদ্য উৎপাদনও হয় বেশি। এ কারণে খাদ্যের দাম ও মূল্যস্ফীতির হার সেখানে কম হওয়ার কথা। আগে তা-ই ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বর্তমানে বদলে গেছে। গ্রামে কৃষিপণ্য নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তারা মজুদদারির মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়াতে ব্যাপক তৎপর। এটিও মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেছেন, গ্রামে বিশেষ করে উৎপাদন খাতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে। উৎপাদন না বাড়ালে গ্রামের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। গ্রামে বর্তমানে যেভাবে প্রবাসীদের অর্থ যাচ্ছে এতে করে তাদের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। এই অর্থ গ্রামের উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করতে পারলে দেশের উৎপাদনশীল খাতে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর হিসাবে দেখা যায়, গ্রামে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ১৮২ টাকায় যে পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী কেনা যেত, তা কিনতে এখন লাগছে ২৩৭ টাকা। একই সময়ে গ্রামে ১৮৩ টাকায় যে চিকিৎসা পাওয়া যেত, এখন তা পেতে লাগে ২০৪ টাকা। এভাবে প্রায় প্রতিটি পণ্যেই ব্যয় বেড়েছে।
মঙ্গার প্রকোপ কমেছে : কয়েক বছর আগেও দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গার প্রকোপ লেগেই থাকত। এখন তেমনটি আর নেই। সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলের সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামে আগের মতো আর অভাব নেই। মঙ্গাপ্রবণ এলাকাগুলোতে চাষের জন্য উন্নত মানের ধানবীজ আবিষ্কার করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে মঙ্গার সময়ে উত্তরাঞ্চলের মানুষ বাড়তি দুটি ফসল পাচ্ছে। এতে তাদের মঙ্গার সময়টা ভালো যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা জেলায় এখন ব্যাপকভাবে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এ কাজে বেসরকারি খাতের এনসিসি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কম সুদে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে। মঙ্গার সময় ধান ও ভুট্টার চাষ হওয়ায় ভূমিহীনরা কাজ পাচ্ছে, ভূমির অধিকারীরা পাচ্ছে বাড়তি ফসল। উত্তরাঞ্চল ও চরাঞ্চলের অভাবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ সমকালকে বলেন, বিভিন্ন অর্থায়ন কর্মসূচি চালু করায় এখন গ্রামে অভাবের তীব্রতা কমে এসেছে। গ্রামভিত্তিক পিকেএসএফের কর্মসূচিগুলোকে আরও এগিয়ে নেওয়া হবে।
ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক : ২০০৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর কৃষিতে বাম্পার ফলন হচ্ছে। এর মাধ্যমে কৃষক গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছেন। তবে এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে, কৃষক তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। বিশেষ করে এবার মৌসুমের সময় কৃষক ধান, আলু ও টমেটোসহ অন্যান্য পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাননি। অথচ একই পণ্য মৌসুমের পর চড়া দামে কৃষককে কিনতে হচ্ছে।
কৃষক এখনও আগের মতো অবহেলিতই আছেন। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ায় ২০০৭ সালে সরকার ধাক্কা খাওয়ার পর কৃষকের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি পড়েছে। এ কারণে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলেও পণ্যের ন্যায্যমূল্য এখনও নিশ্চিত হয়নি। এছাড়া কৃষিপণ্য সংরক্ষণে গ্রামে অবকাঠামোও তৈরি হয়নি।
উৎপাদনে পদে পদে বাধা : উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে গ্রাম। কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের বেশিরভাগই গ্রামে। সেই গ্রামেই লেগে থাকছে বিদ্যুৎ সংকট। চাষাবাদের জন্য কৃষকের কাছে টাকা থাকলেও নেই বিদ্যুৎ। এ কারণে তারা ফসলের মাঠে সেচ দিতে পারছেন না। বৃষ্টি না থাকায় বিদ্যুতের চাহিদা আরও প্রকট হয়েছে। দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ সব খানেই একই চিত্র।
শুধু বিদ্যুৎ নয়, যেখানে বিদ্যুৎ নেই সেখানে গ্রামের হাটবাজারগুলোতে ডিজেলও মিলছে না ঠিকমতো। বাধ্য হয়ে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে কেরোসিন। এতে সেচ খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সেচ খাতে কৃষককে ভর্তুকি দেওয়ার কথা থাকলেও এই অর্থ সময়মতো কৃষকের হাতে যাচ্ছে না। সেচের ভর্তুকির টাকা পেতে কৃষকের নামে ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার নিয়ম করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলো নানা সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলছে না। এছাড়া রয়েছে ভালো বীজ ও সারের সংকট।
একই অবস্থা গ্রামের শিল্প উৎপাদনে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটে শিল্প-কারখানাগুলো উৎপাদন অব্যাহতভাবে চালাতে পারছে না। এদিকে তাদের নিজস্ব কোনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও নেই। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও গাইবান্ধাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন এলাকা এবং দেশের দক্ষিণের জেলা কক্সবাজার ও টেকনাফে সরেজমিনে ঘুরে ক্ষুদ্র শিল্পের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে একদিকে যেমন উদ্যোক্তাদের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এই দ্বিমুখী সংকটের কারণে উৎপাদন খাতে বিপর্যয় নেমে আসছে।
তাঁত শিল্পের শহর হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় দেড় লাখ তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছে। এই এলাকার তাঁতির সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ছোটখাটো তাঁত। স্থানীয়দের পাশাপাশি আশপাশ জেলার শ্রমিকরাও এখানে এসে কাজ করেন। তাঁতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিরাজগঞ্জে নতুন নতুন শিল্প-কারখানাও গড়ে উঠছে। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের মাছুমপুরের সুফিয়া খাতুন জরির সুতা উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেছেন। বিদ্যুৎ সংকটে এ এলাকার সুতা শিল্পে নিয়োজিত লোকজনেরও নাভিশ্বাস উঠেছে।
হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি শিল্পের নগরীতে পরিণত হয়েছে বগুড়া জেলা। বগুড়ার বিসিক শিল্পনগরী ছাড়িয়ে এখন আবাসিক এলাকাগুলোতে গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। যেখানে কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিদ্যুৎ সংকট তাদের অগ্রযাত্রাকে অনেকটা থামিয়ে দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment