Saturday 10 April 2010

কুয়াকাটায় খাসজমি দখলের উৎসব

শফিকুল ইসলাম জুয়েল ও রফিকুল ইসলাম কুয়াকাটা থেকে ফিরে
Kalerkantho ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ চৈত্র ১৪১৬, ২৩ রবিউস সানি ১৪৩১, ৯ এপ্রিল ২০১০

দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত ঘিরে বিস্তীর্ণ এলাকা এখন দখলবাজদের কবলে। বালুচর থেকে শুরু করে খাল, রাস্তা, বন, সমতল ভূমি_সবই দখলের উৎসবে মেতে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের একাধিক প্রভাবশালী চক্র। দখল দৌরাত্দ্যের তালিকায় আছে বেশ কয়েকটি হাউজিং কম্পানি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নাম।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করলেও ব্যবস্থা গ্রহণে তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে গড়িমসির অভিযোগ। জানা গেছে, সরকারি খাসজমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে সেগুলো কেনাবেচা দেখিয়ে চলছে এ নৈরাজ্য। এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক বলেন, এ দখলের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবও জড়িয়ে গেছে বলে তাঁরাও নিরুপায়। কুয়াকাটা বেড়াতে যাওয়া কয়েকজন পর্যটক এ দখল নৈরাজ্য দেখে কালের কণ্ঠের কাছে উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। তাঁরা বলেন, এভাবে চলতে থাকলে এ পর্যটন এলাকাটি সংকুচিত হবে, হারাবে সৌন্দর্য।
সরেজমিন কুয়াকাটার খাজুরিয়া থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত সৈকতের প্রায় ২২ কিলোমিটার ঘুরে দেখা যায়, কিছু দূর পরপরই টাঙানো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডগুলো লেখা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমানের ওশান সিটিসহ ওশান পার্ক, বাংলা ক্যাট, সাগর নীড় প্রকল্প, সেঞ্চুরি রিয়েলিটিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এলাকায় হোটেল কিং, নবোদয় হাউজিং, ইসরাত জাহান, গোলাম সারওয়ারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে সাইনবোর্ড ও সীমানা প্রাচীর দেখা গেছে।
গত কয়েক দিন ঘুরে দেখা গেছে, সৈকতের বালুচরসহ সমুদ্রের পানির ধারে মাথা তুলে রয়েছে মালিকানা দাবিদার এসব হাউজিং কম্পানি, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। বেড়িবাঁধের দুই পাশের রাস্তা-খাল দখল ও ভরাট করে তোলা হচ্ছে অসংখ্য সীমানা প্রাচীর। চলছে হোটেল-মোটেল, রেস্তরাঁ তৈরির কাজও। কেউ কেউ আবার গড়ছেন আধাপাকা ছোট ছোট দোকান। অনেকেই ভবিষ্যতে বড় স্থাপনা তৈরির লক্ষ্যে বাঁশ ও বেড়া দিয়ে তুলছেন খণ্ড খণ্ড প্রকৃতির ছোট-বড় ঘর।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী শুধু লতাচাপলী ইউনিয়নের ওই মৌজায় (সমুদ্রসৈকতের স্থানে) খাসজমির পরিমাণ তিন হাজার ৯৮৭ একর। এর ৭৫ ভাগই এখন বেদখল হয়ে আছে। তিনি জানান, ওই জরিপের পর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল বারিকের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান পারিচালিত হয়। তখন অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে প্রায় ১৫০ একর খাসজমি উদ্ধার হয়। দেখভালের অভাবে তা আবার বেদখল হয়ে গেছে।
ওশান সিটি লিমিটেড : সৈকত ও আশপাশের এলাকায় কয়েকটি ভাগে বড় বড় এলাকা নির্ধারণ করে কাজ করছে ওশান সিটি লিমিটেড। ওশান সিটির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি ওশান সিটির চেয়ারম্যান। তবে সরকারি জমি দখলের বিষয়টি আমার জানা নেই।' এলাকাবাসীর অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, 'অভিযোগ কালের কণ্ঠের কাছে না করে এমপি হিসেবে আমার কাছে করলে আমি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতাম। আর জমি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কমন কিছু অভিযোগ থাকে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।'
জানা যায়, ২০০৯ সালের ১০ মে কুয়াকাটা রাখাইন মহিলা মার্কেটের মাঠে প্রতিমন্ত্রীকে কম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উপহার হিসেবে ওশান সিটির পক্ষ থেকে হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি স্বর্ণের নৌকা। বিশাল ও বর্ণাঢ্য ওই সংবর্ধনা নিয়ে এলাকায় মুখরোচক আলোচনা আছে।
ওশান সিটি লিমিটেডের পরিচালক মেহেরুল হক জানান, কুয়াকাটা, মম্বিপাড়া ও মুসুলি্লয়াবাদ এলাকায়ও ওশান সিটি পৃথক পৃথক নামে প্রকল্পের কাজ করছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাকবাংলোর পশ্চিম পাশে 'ওশান পার্ক' নামে এবং এর পশ্চিম পাশে 'ওশান ভিআইপি' নামে অপর একটি প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে। যদিও ওশান ভিআইপি পরে 'বাংলা ক্যাট' নামে একটি সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
জহিরুল আলম জুয়েল নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, লতাচাপলি মৌজায় তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি ১ একর ৭১ শতাংশ। এর পাশে ৫০ শতাংশ খাসজমি রয়েছে, যা বন্দোবস্ত পাওয়ার আশায় তিনি আবেদনও করেছেন। আবেদনটি প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় ওশান সিটি ওই খাসজমিতে দেয়াল তুলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে ২০০৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ওশান সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আসামি করে কলাপাড়া সহকারী জজ আদালত পটুয়াখালীতে মামলা দায়ের করেন। এটি এখন বিচারাধীন। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দা মোবারক, মিরাজ ও শাজাহানের অভিযোগ, বায়না করেও তাদের মতো অনেক জমির মালিককে প্রকৃত মূল্য পরিশোধ না করেই জমিতে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দখলে নেমেছে ওশান সিটি।
কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ওশান সিটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারা একটি প্রতিবেদন উপজেলা ভূমি অফিসে পাঠান। তাতে বলা হয়, হাউজিং কম্পানিগুলো সরকারের খাসজমি দখল করে প্লট হিসেবে বিক্রি করছে। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে জলাশয় ভরাট বা খাস জায়গা দখল না করার জন্য ওশান সিটি কর্তৃপক্ষকে চারবার সতর্ক করা হয়। ওশান সিটি প্রথমে নির্দেশ মানার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আবার সরকারি জমি ভরাট করেছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ওশান সিটি লিমিটেডের পরিচালক মেহেরুল হক জানান, জমি দখলের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এখনো সব জমির রেজিস্ট্রি সম্পূর্ণ হয়নি বলেও তিনি তথ্য দেন। তাদের প্রকল্পের মধ্যে ১৭ শতাংশ খাসজমি থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ওই জমি ব্রিটিশ রেডক্রসের আবাসন প্রকল্পের জমির সঙ্গে এওয়াজ বদল (বদলে নেওয়া) করে নেওয়া হয়েছে। তবে তিনি সরকারি জলাশয় ভরাট করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সাগর নীড় প্রকল্প : কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত-সংলগ্ন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের ভেতরের পশ্চিম কুয়াকাটা এলাকায় তিন ভাগে ৬৫ একর জমি নিয়ে তাদের প্রকল্পের কাজ মোটামুটি শেষ করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, কিছু দিন আগেও এ এলাকায় খাসজমির ওপরে একটি লম্বা খাল ছিল। পাশ দিয়ে ছিল জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা। কিন্তু সাগর নীড় প্রকল্প খাল ভরাট ও রাস্তা দখল করে সীমানা দেওয়াল তুলে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে লতাচাপলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল বারেক মোল্লা বলেন, 'সাগর নীড় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যখন সরকারি রাস্তা দখলে নেয়, তখন আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে বন্ধ করার জন্য বলি। প্রথমে শুনলেও পরে তারা অমান্য করে।' তিনি জানান, ৩০ ফুটেরও বেশি সরকারি রাস্তা এবং পুরো খাল প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কলাপাড়া ভূমি অফিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সাগর নীড় প্রকল্পে দুই একর ২৩ শতাংশ খাসজমি রয়েছে, যা উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রকল্পের কুয়াকাটার দায়িত্বে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমাদের প্রকল্পে এক একর ৪৬ শতাংশ সরকারি খাসজমি রয়েছে। আমরা ওই খাসজমি পাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি।' তিনি জানান, ইতিমধ্যে এ প্রকল্পের ১০০টি প্লট বিক্রি হয়ে গেছে। তবে খাসজমি বন্দোবস্ত না পেয়ে কিভাবে প্লট করে বিক্রি চলছে, সে প্রশ্নে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
সেঞ্চুরি রিয়েলটি : কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত অন্তত ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে কাজ শুরু করেছে সেঞ্চুরি রিয়েলটি লিমিটেড। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দাবি, সেঞ্চুরির দখল করা জমির মধ্যে ৩০০ একরেরও বেশি খাসজমি রয়েছে। আর এর অধিকাংশই বনভূমি। ওই এলাকার দায়িত্বরত ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সরকারি জমি উদ্ধারের পদক্ষেপ নিয়েছি। উপরের নির্দেশনা পেলে দ্রুত উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।'
সেঞ্চুরি রিয়েলটির চেয়ারম্যান এম জি আর নাসির দাবি করেন, 'আমাদের প্রকল্পে কোনো খাসজমি নেই। ইতিমধ্যে এক হাজার ২০০ একর জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। বাকি জমির রেজিস্ট্রিকাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।'
প্রশাসনের বক্তব্য : কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী জানান, কুয়াকাটা এলাকায় অধিকাংশ হাউজিং প্রকল্পের মধ্যেই খাসজমি রয়েছে। একটি মহল এ জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে অকৃষি খাসজমি দেখিয়ে একসনা বন্দোবস্ত নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাস্তা ও জলাশয় ভরাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাস্তা ও জলাশয় ভরাটের খবর পেয়ে তহশিলদারকে পাঠিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে কিভাবে আবার ভরাট করা হয়েছে, তা দ্রুত দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. রিয়াজ আহমেদ বলেন, কুয়াকাটায় সরকারি জমি আর জলাশয় ভরাটের চেষ্টার খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসনকে তা বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। কুয়াকাটায় প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ খাসজমি আছে এবং সেসব জমি কী অবস্থায় আছে, তা পরিমাপের জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কাজও করছেন। দখলের এক প্রশ্নে জেলা প্রশাসক বলেন, 'বিষয়টি রাজনৈতিক। তাই মন্তব্য করতে চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি, দখলের পেছনে ক্ষমতার অপব্যবহার জড়িত।' তাঁর দাবি, কেউ ইচ্ছা করলেই সরকারি জমি দখল করতে পারবে না। যারা ইতিমধ্যে দখল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments:

Post a Comment