Friday 17 December 2010

প্রভাবিত প্রশাসনের অধীনে সুষ্ঠু পৌর নির্বাচন নিয়ে সংশয় : হামলা-মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীরা এলাকাছাড়া


কাজী জেবেল

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পৌর নির্বাচন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে এবং বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে ঠিকভাবে অংশ নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া লেভেল প্লেইং ফিল্ড সৃষ্টি নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এসব নিয়ে জাতীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে চলছে নানা আলোচনা ও গুঞ্জন। সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আপিল কর্তৃপক্ষ নিয়োগ, সব উপজেলায় সেনা মোতায়েন না করার ইসি’র সিদ্ধান্ত, সরকারদলীয় প্রার্থীদের জেতাতে নির্বাচনী পৌরসভায় উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, আচরণ বিধি লংঘন করে ক্ষমতাসীনদের প্রচারণায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা না দেয়া, ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক প্রবেশ করতে না দেয়ার জন্য প্রশাসনকে ইসির নির্দেশসহ বেশকিছু কারণে এসব সংশয় ও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হামলা-মামলার কারণে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক অনেকে নিজ এলাকায় যেতে পারছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এবারের নির্বাচন আগের তুলনায় অনেক ভালো হবে বলে দাবি করেছে কমিশন।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালীন কোনো নির্বাচন হলে বরাবরই ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করে আসছে। পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশন বেশকিছু আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করায় এ নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেয়ার প্রেক্ষাপটে পৌর নির্বাচন হয়তো নিরপেক্ষ হবে না। কারণ তারা সরকারি কর্মকর্তা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করায় ওই নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতাদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে বৃহত্ পরিসরে সেনাসদস্য মোতায়েন করা উচিত। এটা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য মঙ্গলজনক। কারণ রাজনৈতিক সরকারের আমলে পুলিশ নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চাই। একই সঙ্গে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাব, আপনারা চোখ-কান খোলা রাখুন। কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করবেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্বাচন কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, ‘দলীয় সরকারের আমলে কখনও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। কমিশনকে আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা দেয়া হলেও সরকারের হাতেই ক্ষমতা রয়ে গেছে। জনবল কম থাকায় কমিশন নিজ ইচ্ছামতো চলতে পারছে না।’
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনী ২৬২ পৌরসভায় ভোটকেন্দ্র ৩ হাজার ২৫০টি। এর মধ্যে ৭১২টি ভোটকেন্দ্র অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও ৪৭৫টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকি ২ হাজার ৬৩টিকে সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। বিগত নির্বাচনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা তৈরি করেছে। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ৭৩টি পৌরসভায় ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ১০ শতাংশ। খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ৫৫টি পৌরসভার ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৬০ শতাংশ। ঢাকা বিভাগের ৬৮টি পৌরসভার বেশকিছু বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ পৌরসভা আছে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের ৬৬টি পৌরসভা রয়েছে। নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী এবং চট্টগ্রাম জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ। সিলেটের ১৬টি পৌরসভায় ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৫ শতাংশেরও কম। ঝুঁকিপূর্ণ এসব কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দাপট বেশি। এছাড়াও অবৈধ অস্ত্র, সর্বহারা, চরমপন্থীদের আনাগোনা রয়েছে। ফলে সাধারণ প্রার্থীরা নির্বাচনী কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে করতে পারবে না বলে আশংকা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আড়াই হাজার জনবল রয়েছে। এর মধ্যে ৬০০ কর্মকর্তা। অথচ পৌর নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলা প্রশাসককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর এসব কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকলেও তাদের নিয়মিত সরকারি দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সরকারের আদেশ মেনেও তাদের কাজ করতে হচ্ছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিরপেক্ষ ও বিরোধী মতের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রেখেছে। পাশাপাশি আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তাদের পছন্দমতো জায়গায় বদলি ও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল করা হয়। এসব কর্মকর্তাই এখন নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করছেন। তারা দীর্ঘদিন একই স্থানে দায়িত্ব পালন করায় সঙ্গত কারণেই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে। নির্বাচনে এসব কর্মকর্তা সরকারদলীয় নেতাদের প্রভাবে প্রভাবিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের ১৪ জেলার ১৯ পৌরসভার উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদনের আয়োজন শুরু করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এসব উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হবে ৪৫১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট পৌরসভা প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর মধ্যে ১৫ পৌরসভায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হলো— গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া, মাদারীপুর জেলার শিবচর ও কালকিনি, কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর ও ভৈরব, ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী, ময়মনসিংহ সদর, জামালপুরের মাদারগঞ্জ, পাবনার সুজানগর, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, মৌলভীবাজরের কমলগঞ্জ, যশোরের নওয়াপাড়া এবং ভোলার চরফ্যাশন পৌরসভা। পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এসব পৌর এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থীকে জেতানোর উদ্দেশ্যে উন্নয়নমূলক প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এতে ওই প্রার্থীর সম্পর্কে জনমনে ভালো ধারণার সৃষ্টি হবে। ভোট পেতে সহজ হবে। যদিও নির্বাচন কমিশন থেকে তফসিল ঘোষণার পর নতুন করে কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করার জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এদিকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত ৯ পৌরসভা নির্বাচনে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৩০ জন ও সাধারণ কেন্দ্রে ২৮ জন পুলিশ, ব্যাটালিয়ন আনসার, আনসার ও ভিডিপি সদস্য ছিলেন। ওই সময়ে দেশে এক প্রকার সামরিক শাসন বহাল ছিল। এবার পৌর নির্বাচনের সবক’টিতে সেনাবাহিনীর সদস্য নিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ও বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত উপজেলাগুলোতে সেনা মোতায়েন করা হবে। বাকিগুলোতে র্যাব, পুলিশ, ব্যাটালিয়ন আনসার, আনসার, ভিডিপি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। এ প্রসঙ্গে শামসুল আলম, মো. কাওছার কামালসহ বিরোধীদলীয় কয়েকজন প্রার্থী বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাপটে এখনই এলাকায় থাকা যায় না। এরপর আবার তারা দলীয় প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দিলে অন্য প্রার্থীরা প্রচারণা চালাতে পারবে না। এছাড়া পুলিশ দলীয় কর্মীর ভূমিকা পালন করছে। ফলে বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা নির্বাচনী কাজ সঠিকভাবে করতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ তারা বলেন, গত ১০ ডিসেম্বর মেহেরপুর পৌরসভার সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইয়ারুল ইসলামের সমর্থনে নগরীতে এক মোটর শোভাযাত্রা বের হয়। এ সময় মোটরসাইকেল আরোহী যুবকদের হৈ চৈ ও বাঁশির শব্দে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জয়পুরহাটের কালাইয়ে আওয়ামী লীগের উপজেলা সেক্রেটারি তৌফিকুল ইসলাম তালুকদারের সমর্থনে একটি নির্বাচনী মিছিল করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে তারা সব পৌরসভায় সেনা মোতায়েনের দাবি জানান।
নির্বাচন নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তিনি বলেন, আমি ঢাকার পথে রয়েছি। এখন কিছু বলতে পারব না। অপর নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে আমরা কি করব? বিদেশ থেকে সেনাসদস্য এনে এদেশে নির্বাচন করা যাবে না। এছাড়া সব নির্বাচনে যদি সেনাসদস্য মোতায়েন করা হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক এদেশকে খাটো করা হয়। তিনি আরও বলেন, অতীতে যেমন নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে এবার আরও ভালো নির্বাচন হবে। সরকারি কর্মকর্তারা যদি আইনের বাইরে কোনো কাজ করেন অথবা কোনো প্রার্থীকে বিশেষ সুযোগ দেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সব জায়গায় যদি সেনা মোতায়েন করতে হয় তাহলে র্যাব-পুলিশ বাহিনী কি করবে। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে বলে আশা করি।

No comments:

Post a Comment