Tuesday 7 December 2010

দলীয় লোক ছাড়া চাকরি নেই

কাদের গনি চৌধুরী

দেশজুড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণের মচ্ছব চলছে। সরকারি দলের বাইরে কারও চাকরি হচ্ছে না। কোথাও প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নিলে সেখানে সরকারি দল হামলে পড়ছে। পরীক্ষা ভণ্ডুল, পরীক্ষার উত্তরপত্র ও রেজাল্টশিট লুট, সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা-হুমকি ও ভাংচুরসহ হেন অপকর্ম নেই, যা তারা করছে না। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানেই নয় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও চরম দলীয়করণ হচ্ছে। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি না পেয়ে অনেকে হতাশ হয়ে চাকরির জন্য আবেদন করা বন্ধ করে দিয়েছেন। গত পক্ষকাল ধরে সিভিল সার্জন অফিস ও ডিসি কার্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে শাসক দলের নেতাকর্মীরা তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে সারাদেশে। কিন্তু এসব বন্ধের কোনো উদ্যোগই নেই সরকারের।
সাম্প্রতিক পাবনায় তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে ছাত্রলীগ, যুবলীগের বাধা, পরীক্ষা ভণ্ডুল, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মারধরের জন্য দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলেও সারাদেশে নিয়োগ নিয়ে এ ধরনের অসংখ্য কেলেঙ্কারি হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিভিল সার্জন অফিসে নিজেদের পছন্দের লোকজনের চাকরি না হওয়ায় ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান’র ব্যানারে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা গতকাল হামলা চালিয়েছে। তাদের হামলায় একজন চিকিত্সক ও তিন কর্মচারী আহত হয়েছেন। সরকারি দলের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে ব্যাপক ভাংচুরও করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারাও সরকারি দলের লোক। কিন্তু সরকারি দলের বিবদমান গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকে যেভাবে লিস্ট দেয়া হয়েছে সেভাবে সবাইকে নিয়োগ না দেয়ায় এ গণ্ডগোল।
গাইবান্ধায় স্বাস্থ্য বিভাগে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। তারা জানান, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে দলীয় বিবেচনায় সরকারি দলের লোকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত শনিবার সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও, ভাংচুর ও বিক্ষোভ মিছিল করেন নিয়োগবঞ্চিতরা। তারা অবিলম্বে পূর্বপরিকল্পিত ও প্রহসনমূলক নিয়োগ বাতিলসহ সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলামের অপসারণ দাবি করে। স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার গাইবান্ধা স্বাস্থ্য বিভাগে স্টোরকিপার পদে ৩ জন, পরিসংখ্যানবিদ ২ জন, ড্রাইভার ২ জন, জুনিয়র মেকানিক ৫ জন, অফিস সহকারী ৬ জন, এমএলএসএস ১০ জন, নিরাপত্তা প্রহরী ৯ জন, মালী ৪ জন, আয়া ৬ জন, কুক ৫ জন, ওয়ার্ডবয় ৬ জন ও সুইপার পদে ১০ জনসহ ৬৮ জন লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। ওইসব পদে বাছাইকৃত ২ হাজার ৭৮০ প্রার্থী অংশ নেন। নিয়োগবঞ্চিতদের অভিযোগে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ২৭ সেপ্টেম্বর রাতেই পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম স্বাস্থ্য বিভাগের উত্তরাঞ্চলের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশে এবং স্থানীয় সরকারি দলের কিছু প্রভাবশালী নেতার দেয়া তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ তালিকা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেন। শুক্রবার রাতে সিভিল সার্জন নিয়োগ কমিটির গোপন বৈঠকের মাধ্যমে একটি নিয়োগ তালিকা চূড়ান্ত করেন এবং শনিবার বেলা ১১টায় সবার অগোচরে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের তালিকা তার অফিসের গেটের পাশে ঝুলিয়ে দিয়ে গোপনে অফিস ত্যাগ করেন। নিয়োগপ্রত্যাশীরা পরে তালিকা দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা ইটপাটকেল ছোড়ে ও সিভিল সার্জন অফিসের জানালা-দরজা ভাংচুর এবং বিক্ষোভ মিছিল করে সিভিল সার্জনের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ জানিয়ে তার অপসারণ দাবি করেন। খবর পেয়ে সদর থানার পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। শুধু গাইবান্ধায়ই নয়, শনিবার শরীয়তপুর, ঝিনাইদহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগে লোকবল নিয়োগকে কেন্দ্র করে অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের বিক্ষোভ, সিভিল সার্জন কার্যালয় ঘেরাও করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে অবশেষে গতকাল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় সরকার।
দেশের সরকারি স্বাস্থ্যখাতে জনবল নিয়োগকে কেন্দ্র করে এক মাস ধরেই বিশৃঙ্খলা চলে আসছে। সিভিল সার্জন অফিসে কর্মচারী নিয়োগের পর এবার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সরকারদলীয় লোকজন। স্থানীয় প্রভাবশালী সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সরকারপন্থী চিকিত্সক নেতা থেকে শুরু করে স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে খোদ সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে নিয়োগ-বাণিজ্যেরও। নিয়োগ কমিটিকে পাশ কাটিয়ে উত্তীর্ণদের তালিকা হচ্ছে ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদফতরে। পরিস্থিতির কারণে মুখ খুলছেন না সিভিল সার্জনরা। নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে নিয়োগ বাতিলের দাবিতে পথে নেমেছেন অনুত্তীর্ণ প্রার্থীরা।
শরীয়তপুর স্বাস্থ্য বিভাগে লোক নিয়োগের জন্য গত ২৫ আগস্ট আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল। যাচাই-বাছাই শেষে ৮৪টি পদে ২ হাজার ৯৭১ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ এক হাজার ৮৯১ প্রার্থী গত শুক্রবার মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। গত শনিবার দুপুরে নিয়োগপ্রার্থীদের পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা টাঙানো হয়। অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক বিবেচনা, স্বজনপ্রীতি ও উেকাচের বিনিময়ে এসব প্রার্থীর প্রায় সবার নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। কেউ কেউ সরকারি দলের নেতাদের টাকা দিয়েও চাকরি পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, শনিবার প্রকাশ করা নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে, মেয়ে, ভাইসহ অনেক রাজনৈতিক নেতার আত্মীয়স্বজন এবং সিভিল সার্জন অফিসে কর্মরত অনেক কর্মচারীর আত্মীয়স্বজন। মেধার ভিত্তিতে চাকরি না দিয়ে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের চাকরি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আর নিয়োগপ্রাপ্তদের বড় একটি অংশকে চাকরি দেয়া হয়েছে উেকাচের বিনিময়ে। এ ছাড়া শরীয়তপুর জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের চাকরি দেয়ার কথা থাকলেও পার্শ্ববর্তী খুলনা, বরিশাল, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের ভুয়া নাগরিকত্বের সনদ নিয়ে টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয়া হয়েছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে।
ঝিনাইদহ জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, জেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের ৩০টি পদে সহস্রাধিক প্রার্থী গত আগস্টের প্রথমদিকে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। গত বৃহস্পতিবার থেকে নির্বাচিতদের নামে নিয়োগপত্র ছাড়া শুরু হয়। খবর পেয়ে শনিবার সরকারি ছুটির দিন হলেও বঞ্চিত প্রার্থীরা দুপুরের দিকে অফিসের সামনে এসে বিক্ষোভ করেন। অফিস ছুটি থাকায় কাউকে না পেয়ে পরে তারা সদর হাসপাতালে আরএমওর চেম্বারে হামলা করে অফিসের চেয়ার ভাংচুর করেন।
বঞ্চিত একাধিক প্রার্থীর অভিযোগ, ‘অফিস বোর্ডে প্রকাশ্যে ফলাফল না টাঙিয়ে অনেকের বাড়িতে নিয়োগপত্র পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাদের অভিযোগ, আমরা চাকরি পেলাম কী পেলাম না, তাও আমরা বুঝতে পারছি না। সিভিল সার্জন মোটা অঙ্কের বিনিময়ে অযোগ্য লোকদের চাকরি দিয়েছেন।’ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় এমএলএসএস পদের প্রার্থী লিটু বিশ্বাাস বলেন, ‘আমার বাবা জেলার একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। আমি সব ধরনের কাগজপত্র জমা দিয়েছি। পরীক্ষাও ভালো দিয়েছি। তারপরও আমার চাকরি হয়নি।’
গত সোমবার পঞ্চগড়ে লিখিত পরীক্ষায় পছন্দের প্রার্থীরা উত্তীর্ণ না হওয়ায় সিভিল সার্জন অফিসের গাড়ি ভাংচুর করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা। এমনকি পরীক্ষার খাতা ও রেজাল্টশিট নিয়ে গেছে তারা।
পটুয়াখালীতে শুধু ভাংচুরই নয়, প্রধান অফিস সহকারীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এছাড়া যশোরে আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে গেছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। পিরোজপুরেও স্থগিত করা হয়েছে নিয়োগ কার্যক্রম। এর আগে পাবনা জেলা প্রশাসনে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় বাধা সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা।
পটুয়াখালীতে নিয়োগ নিয়ে গত সোমবার দুপুরে সিভিল সার্জন অফিসে হামলা-ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় শাসকদল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অফিসের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল ভাংচুর এবং অফিসের প্রধান সহকারী মো. আবুল কালামকে মারধর করলে তিনি গুরুতর আহত হন। তাকে পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
যশোরে ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপের কারণে সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে গেছে। সোমবার যশোর সিভিল সার্জন অফিসে কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা চলাকালে সেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা হানা দেয়ায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। নেতাদের পছন্দমতো প্রার্থীদের চাকরি দেয়ার দাবিতে নিয়োগ পরীক্ষায় বাধা দেয়ার এ ঘটনা ঘটে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। সিভিল সার্জন ডা. তরুণ কুমার শিকদার সাংবাদিকদের জানান, দুপুরে এ ঘটনার পর বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হলে বিকালে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত সংক্রান্ত মৌখিক নির্দেশ জারি করা হয়।
পিরোজপুরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পিরোজপুর সিভিল সার্জন অফিসের সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা সোমবার স্থগিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৫২ পদে প্রায় ২ হাজার ২০০ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। সোমবার দুপুরের পর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশে সিভিল সার্জন তা স্থগিত ঘোষণা করেন। সম্প্রতি কুড়িগ্রামে সব উপজেলার চিকিত্সা কেন্দ্রে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে ৪৫ জনের নিয়োগ নিয়ে একই ঘটনা ঘটে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা হুমকির মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের সুস্থতার সার্টিফিকেট আদায় করে নেন। এ বছরের এপ্রিলে দলীয় লোকদের চাকরি দিতে বাধ্য করতে গিয়ে সাত জেলার ১৫ উপজেলায় হামলা চালায়। গত ৩০ আগস্ট দিনাজপুর সিভিল সার্জন অফিসে ৬৮ পদে আওয়ামী লীগের দলীয় লোক নিয়োগ দেয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাকরিবঞ্চিতরা সিভিল সার্জনের অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর মেডিকেল অফিসার পদে দলীয় লোকদের নিয়োগ দিতে বাধ্য করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বাচিপ ও বিএমএ নেতারা তুলকালাম ঘটান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। ‘চিকিত্সা কর্মকর্তা’ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা পাস না করায় তারা বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাকে কিছুক্ষণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। শুক্রবার অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরদিন দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ও সমর্থক সংগঠনের নেতাকর্মীদের মারমুখী আচরণ, হট্টগোলে হাসপাতালের রোগী, তাদের অভিভাবক, দর্শনার্থীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ৭০টি পদে দলীয় ও পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ৪০০ জনের তালিকা এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে উপাচার্যের কাছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের তিন নেতার তিনটি তালিকায় আছে ৭০ যুবলীগ চিকিত্সকের জন্য তদবির। এক মন্ত্রী পাঠিয়েছেন ৬০ জনের নামের তালিকা; যার মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা আছেন ২০ জন। এছাড়া সরকার সমর্থক চিকিত্সকদের সংগঠন স্বাচিপ ও বিএমএ নেতাদের আছে ২০০ প্রার্থীর নিয়োগের সুপারিশ।
দলীয় লোকদের নিয়োগ নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে চলতি বছর একাধিকবার একইরকম ঘটনা ঘটে। তাতে সরকার সমর্থক কর্মকর্তা, চিকিত্সক নেতারা লাঞ্ছিত হন। সহকারী সার্জন পদে স্বাচিপ সদস্যরা বাদ পড়ায় তুলকালাম ঘটে গত ৩১ মে। ওইদিন চূড়ান্তভাবে মনোনীত ৩ হাজার ৫৫১ সহকারী সার্জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বাদপড়া স্বাচিপ সদস্যরা ওইদিন এ চিকিত্সা কেন্দ্রের চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমদ ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের কক্ষে ঢুকে চেয়ার, টেবিল, দরজা, জানালা ভাংচুর করেন। তারা সেদিন ডা. ইকবাল আর্সলানকে প্রায় তিন ঘণ্টা তার কক্ষে আটকে রাখেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যেখানেই নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেখানে প্রভাব খাটিয়ে দলীয় লোকদের চাকরি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে সরকারি দলের চাপের কাছে নিয়োগ কর্মকর্তারা মাথানত করেননি, সেখানেই নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। গত এপ্রিলে দলীয় প্রার্থীরা নির্বাচিত না হওয়ায় ঢাকা বিভাগের খাদ্য অধিদফতরে নিয়োগ বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন জজ আদালতেও একই কারণে কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রেও হয়েছে মহাকেলেঙ্কারি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ১৫৫ কর্মকর্তার মধ্যে ৫৫ জনেরই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বয়স ছিল ১০ বছরের নিচে। তাদের দুজনের বয়স ছিল ৫ বছর, ৯ জনের ৬ বছর, ১৬ জনের ৭ বছর, ১১ জনের ৮ বছর এবং ১৫ জনের ৯ বছর। সহকারী বন সংরক্ষক নিয়োগেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। দলীয়করণ থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশ বিমানের সিভিল এভিয়েশন। সম্প্রতি বিভিন্ন বিমানবন্দরের জন্য ৮২ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে ৪৮ জনের বাড়ি প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জে। শুধু তা-ই নয়, নিয়োগপ্রাপ্তদের ১৮ জনের বাড়ি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা টুঙ্গিপাড়ায়। এলজিআরডির মশক নিবারণী দফতরে লোক নিয়োগেও চরম দলীয়করণের ঘটনা ঘটেছে।
শুধু সরকারি অফিসেই নয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেও হচ্ছে চরম দলীয়করণ। মেধার শ্রেষ্ঠত্ব, যোগ্যতা ও একাডেমিক ফলাফল যেখানে নিয়োগ লাভের শর্ত হওয়ার কথা, সেখানে বিবেচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে দলীয় পরিচয় আর এলাকা ও স্বজনপ্রীতি। যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তিনটি বিভাগে দলীয় পরিচয়ে তিনজনকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ পাওয়া তিনজনই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তিনটি বিভাগেরই প্রভাষক পদে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হারুন-অর-রশীদ। নিয়োগ কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, তাদের আপত্তি সত্ত্বেও সহ-উপাচার্য প্রভাব খাটিয়ে এদের নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তাদের নিয়োগ নিশ্চিত করা হয়।
এদের মধ্যে দুলাল চন্দ্র গাইন অঙ্কন ও চিত্রায়ন (ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং) বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ছাত্রজীবনের চারটি পরীক্ষার মধ্যে তিনটিতে তার দ্বিতীয় শ্রেণী। দুলাল চারুকলা অনুষদের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। প্রিন্ট মেকিং বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ নাজির হোসেন খান। শিক্ষাজীবনের তিনটিতেই তার দ্বিতীয় শ্রেণী। তিনিও চারুকলা অনুষদের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। অপরজন সীমা ইসলাম গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি ছাত্রলীগের রোকেয়া হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের চারটি পদে প্রভাষক পদে চাকরির জন্য ৩৫ জন প্রার্থী আবেদন করেন। গত ৫ জুলাই বাছাই কমিটি তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়। পরে ২৯ জুলাই ছাত্রলীগের চারুকলা অনুষদের সাবেক সভাপতি দুলাল চন্দ্র গাইনকে নিয়োগের ব্যাপারে সুপারিশ করে কমিটি। দুলাল চন্দ্র গাইন ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ চারুকলা অনুষদ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুলাল চন্দ্র কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা ছাড়াই ময়মনসিংহের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে সরাসরি নিয়োগ পান। তখন তার নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করেন আরেকজন প্রার্থী।
প্রিন্ট মেকিং বিভাগের দুটি প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন ১৫ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী ছিল দুজনের এবং তিনটি প্রথম শ্রেণী ছিল ছয়জনের। এদের মধ্যে সবগুলো প্রথম শ্রেণী পাওয়া একজনকে নিয়োগ দেয়া হলেও বাকিদের বাদ দিয়ে তিনটি পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণী পাওয়া নজির হোসেন খানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের তিনটি প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন ১৩ জন প্রার্থী। এদের মধ্যে সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পাওয়া দুজন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তিনটিতে প্রথম শ্রেণী থাকা সীমা ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সীমা ইসলামের প্রার্থী বিবরণীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখে রেখেছে, তিনি অসত্য তথ্য ব্যবহার করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাজোট সরকারের ১৯ মাসে ১৭৪ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এসব নিয়োগ আগের সব কেলেঙ্কারিকে ছাড়িয়ে গেছে। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দিতে গিয়ে প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে চলছে। বাণিজ্যও চলছে বেশ রমরমা। ফলে তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। নিয়োগে সরকারি বিধিবিধানও লঙ্ঘন করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাজোট আমলে বিভিন্ন বিভাগে শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বর্তমান ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর নিয়োগ লাভ করেন গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি। যোগদানের ২০ দিনের মাথায় ১৪ মার্চ প্রকাশ করা হয় ৪৯ জন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। অথচ ২০০৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের নিয়োগের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল। এরপর বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন সময়ে মেধা ও যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় পরিচয়, আত্মীয়করণ, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাবিতে নিয়োগে প্রায় সব ব্যাপারেই ভালো ফলধারীদের বঞ্চিত করে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মই নিয়ম। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্ির্থত ৪৬ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অথচ কলেজ থেকে পাস করা প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ারও ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে পাস করা রাজিয়া সুলতানা নামে এক প্রার্থী নিয়োগ পেয়েছেন ফুড অ্যান্ড টি (খাদ্য ও চা) বিভাগে। এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পর্যন্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে। এভাবে ভুয়া ‘পাবলিকেশন’ (গবেষণা) দেখিয়েও কয়েকজন নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বিপরীতে বাদ পড়েছেন যোগ্য প্রার্থীরা।
প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে কিছুই না জানিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার ৭৯৫ জন কর্মচারী নিয়োগ চূড়ান্ত করে ফেলে। পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান, আবেদনপত্র সংগ্রহ ও বাছাই, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ সবকিছুই সম্পন্ন হয়ে যায়। বিপত্তি বেধেছে নিয়োগপত্র দিতে গিয়ে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত ফাইল এলে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা তাজ্জব বনে যান।
সারাদেশে ৪ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ নেতাদের পছন্দের প্রার্থী নিতে ব্যাপক চাপের মুখে আছেন পুলিশ সুপাররা। অ্যাডহক ভিত্তিতে চিকিত্সক নিয়োগের নামে ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যাপকভাবে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।


Amardesh

No comments:

Post a Comment