Tuesday 7 December 2010

সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ

কাদের গনি চৌধুরী

পাবনায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর শাসক দল আওয়ামী লীগের হামলার পর দেশের জেলা প্রশাসনগুলোতে অস্থিরতা বাড়ছে। প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সারাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা পাবনা জেলা প্রশাসনের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের জেলা শাখাগুলো গত দু’দিন ধরে বৈঠক করে পাবনার প্রশাসনের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা আমার দেশকে জানান, তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে চেয়ে আছেন, দেশে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা দেখে তারা কর্মসূচি নেবেন। কেমন কর্মসূচি নিতে পারেন জানতে চাইলে সরকারি কর্মকর্তারা জানান, প্রয়োজনে সব সরকারি কর্মকর্তা একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন। তারা বলেন, ইজ্জত-সম্মান খোয়াব, বিনা কারণে মার খাব এর চেয়ে চাকরি না করাই ভালো। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঘটনার ১১ দিন পর গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম পাবনা গিয়েছেন। সেখানে তিনি প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, পাবনাসহ সারাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে। বিশেষ করে ২৩ সেপ্টেম্বর পাবনায় সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তারা নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা শোনার পর সারাদেশে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্যাডে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, সংস্থাপন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও স্থানীয় সরকার সচিবের কাছে প্রতিকার চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মহাসচিব এবং দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। সংগঠনের ব্যানারে সভার আয়োজন করছেন তারা। ওই সভা থেকে মাঠ প্রশাসনের সর্বশেষ অবস্থা জানাচ্ছেন মাঠ প্রশাসনের এসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত তদবির ও হুমকির কারণে মাঠ প্রশাসনের স্থবিরতার চিত্র থাকছে চিঠিগুলোতে। ওইসব চিঠিতে পরিস্থিতি খারাপের জন্য সরকারি দল ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দোষারোপ করে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের বৈরী আচরণ ও অসহযোগিতার কারণে দিন দিন সন্ত্রাসীদের হাতে মার খাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য চিঠিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, হবিগঞ্জ শাখা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাবনার ঘটনা পরবর্তী অবস্থা নিয়ে একটি সভা করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাহমুদ হাসান। সভায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর এ হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। একই সঙ্গে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। ওই সভায় হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলেন, প্রশাসনে চাকরি করেও আজ প্রশাসনের কর্মকর্তারা লাঞ্ছনার শিকার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় একদিকে পুলিশ বৈরী আচরণ ও অসহযোগিতা করছে অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অযাচিত তদবির ও হুমকিতে মাঠ প্রশাসন এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, পাবনার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের ন্যায়সঙ্গত কাজে বাধা দিয়ে কার্যত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সরকারি উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এটা বর্তমান সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, আলোচনায় অংশ নিয়ে বানিয়াচংয়ের ইউএনও আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্তি জেলা প্রশাসকদের অপসারণ দাবি করে আলটিমেটাম দেয়া এবং এ দাবিতে ঝাড়ু ও জুতা মিছিলের হুমকি উন্মত্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্ত একদল লোকের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।
পাবনা জেলায় কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দেন রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার স্বপন কুমার রায়। তার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, পাবনা জেলার পরিস্থিতি নিয়ে ওই জেলার সব কর্মকর্তা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এসব চিঠি ছাড়াও বিভিন্ন জেলা প্রশাসন থেকে সরকারের ঊর্ধ্বতনদের কাছে মাঠ প্রশাসনের অবস্থা জানিয়ে চিঠি দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গতকালও কয়েকটি জেলা থেকে এ ধরনের চিঠি এসেছে। এদিকে পাবনার ঘটনায় সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। গতকাল সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নেতারা কয়েকজন সচিবের সঙ্গে দেখা করে প্রশাসনকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। তারা পাবনাসহ সারাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা মার খাওয়ার পরও কেবিনেট সচিব ও সংস্থাপন সচিব কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
গতকাল আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপকালে সচিবালয়ের সরকারি কর্মকর্তারা সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন অফিসাররা মার খাচ্ছেন, অথচ তারা কিছুই করছেন না। অতীতে যখনই প্রশাসনের ওপর আঘাত এসেছে, ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করা হয়েছে। কিন্তু এবার কিছুই করছেন না তারা। সিনিয়র এক সরকারি কর্মকর্তা মাঠ কর্মকর্তাদের ওপর বারবার হামলার পরও সরকারের নীরবতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এরশাদ সরকারের সময় একবার নেত্রকোনার পূর্বধলায় সরকারি দলের এক এমপি ইউএনওর গায়ে হাত তোলার পর প্রশাসনের সব কর্মকর্তা একজোট হয়ে এর প্রতিবাদ জানান। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত বিষয়টি জানান। এর ফলে ওই এমপিকে ক্ষমা চাইতে হয়। সিলেটে এক উপমন্ত্রী সরকারি কর্মকর্তাকে গালি দেয়ার পর ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তারা দেশের কোথাও তাকে প্রটোকল না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একপর্যায়ে ওই উপমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে ছাড়া পান। অথচ এখন প্রতিদিনই সরকারি কর্মকর্তারা মার খাচ্ছেন কিন্তু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কর্মকর্তারা কোনো প্রতিবাদ করছেন না।
সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। সরকারি দলের হাতে প্রতিনিয়ত তাদের লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। গত এক বছরে অর্ধশতাধিক ইউএনও এবং এসি ল্যান্ড নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সরকারি দলের নেতাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমর্থন না দিলেই সেখানে নেমে আসছে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন। মাঠ প্রশাসনের এসব কর্মকর্তার নিরাপত্তার জন্য কোনো উদ্যোগই নেই সরকারের। প্রথম থেকেই রুখে দাঁড়ালে এতো সাহস পেতো না তারা।
তারা জানান, সম্প্রতি বিরল উপজেলা চেয়ারম্যানের হাতে লাঞ্ছিত হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এর কিছুদিন আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করতে গিয়ে দখলদারদের হামলায় লাঞ্ছিত হন গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং এসি-ল্যান্ড। এ সময় অবৈধ দখলকারীদের ইটপাটকেলের আঘাতে রাজাবাড়ী ভূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা তারাজুল ইসলামসহ ৮ জন আহত হন। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের কাছে উপজেলার রাজাবাড়ী ভূমি অফিসের সামনে অবৈধভাবে স্থাপিত বেশকিছু দোকানপাট উচ্ছেদের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ড. জুলিয়া মঈন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহবুব আলম ও গোদাগাড়ী মডেল থানার পুলিশ কর্মকর্তাসহ ওই এলাকায় যান। সেখানে ইউএনও অবৈধ দোকানদারদের মালামাল সরানোর নির্দেশ দিলে অনেকেই তা সরাতে শুরু করেন। এ সময় উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক রাজু তার দলবল নিয়ে কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায়।
একই দিন হবিগঞ্জের ইউএনওকে অফিস থেকে বের করে দিয়ে রুমে তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা। ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারি জায়গায় মার্কেট তৈরিতে বাধা দেয়ায় কচুয়ায় এসি-ল্যান্ডের মাথা ফাটিয়েছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা এসি-ল্যান্ড মোস্তাফিজুর রহমান ওইদিন সন্ধ্যায় তার অফিসে বসে কাজ করার সময় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আওলাদের নেতৃত্বে সরকারি দলের ক্যাডাররা গিয়ে পিটিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও যুবলীগ ক্যাডারের হাতে নোয়াখালী সোনাইমুড়ীর ইউএনওকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। ওইদিন দুপুরে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং এসি-ল্যান্ড মোজাম্মেল হক সরকারি সম্পত্তি দখলে বাধা দেয়ায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা তার ওপর চড়াও হয়। চিহ্নিত ক্যাডাররা তার অফিসে গিয়ে হামলা চালিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নাজেহাল করে। কিছুদিন আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের লোকদের হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা চেয়ারম্যানের হাতে সেখানকার ইউএনও লাঞ্ছিত হন। গত এপ্রিল মাসে উপজেলা চেয়ারম্যান ওই ইউএনওকে অফিস ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র অফিস করার নির্দেশ দেন। বাগেরহাট ডিসি অফিসে সভা চলাকালে সরকারি দল সমর্থক এক উপজেলা চেয়ারম্যান ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দেন ইউএনওর। ক’দিন ধরে সিভিল সার্জন অফিসে কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়েছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের বাধায় কাজে যোগদান করতে পারেননি ভোলার নবাগত সিভিল সার্জন ডা. এটিএম মিজানুর রহমান। গত সোমবার পঞ্চগড়ে লিখিত পরীক্ষায় পছন্দের প্রার্থীরা উত্তীর্ণ না হওয়ায় সিভিল সার্জন অফিসের গাড়ি ভাংচুর করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা। এমনকি পরীক্ষার খাতা ও ফলের তালিকাও নিয়ে গেছে তারা। পটুয়াখালীতে শুধু ভাংচুরই নয়, প্রধান অফিস সহকারীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এছাড়া যশোরে আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে গেছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। পিরোজপুরেও স্থগিত করা হয়েছে নিয়োগ কার্যক্রম। এর আগে পাবনা জেলা প্রশাসনে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় বাধা সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা। সর্বশেষ রোববার নিজের পছন্দের লোককে পুলিশে চাকরি না দেয়ায় কালিহাতী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন।

No comments:

Post a Comment