Tuesday 7 December 2010

মহাসড়কে বেপরোয়া ট্রাক ডাকাতি : অসহায় পুলিশ



আলাউদ্দিন আরিফ

অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে সড়ক-মহাসড়কে ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ডাকাতি। গত এক বছরে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় দেড়শ’ ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ভর্তি মালামাল ডাকাতি হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। ওইসব মালামালের ক্ষতিপূরণ দিয়ে বহু পরিবহন ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। গত দুই বছরে সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের হাতে মারা গেছে অন্তত ৩০ জন চালক ও হেলপার। এই অবস্থায় কভার্ডভ্যান মালিক সমিতির লোকজন পুলিশি তত্পরতা বাড়িয়ে ডাকাতি রোধে একটি শক্তিশালী আইন করারও দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, হাইওয়েতে ডাকাতি রোধে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করা জরুরি।
কভার্ডভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের জেআর ইয়ার্ড থেকে বন্ধু পরিবহন অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির কভার্ডভ্যান (ঢাকা মেট্টো ট-১১-২৩৬১) গাড়িটি প্রায় ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ১৭৩ কার্টন সুতা নিয়ে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে আসছিল। পথিমধ্যে মালামালসহ গাড়িটি উধাও হয়ে যায়। পরে ২ ডিসেম্বর কভার্ডভ্যানটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ঢাকার আশুলিয়া থানার কাছ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ওই সুতার মালিক ছিল গ্রীনল্যান্ড গার্মেন্ট লিমিটেডের। গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ কভার্ডভ্যানের মালিকসহ কয়েকজনকে আসামি করে আশুলিয়া থানায় মামলা করেছে। ফলে একদিকে ক্ষতিপূরণ, অন্যদিকে মামলা নিয়ে বিপাকে পড়েছে মালিকপক্ষ। ডাকাতি হওয়া মালামাল উদ্ধারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা, পুলিশ প্রশাসন ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি।
জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকেই শক্তিশালী একটি চক্র হাইওয়ে ট্রাক ডাকাতিতে সক্রিয় রয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে কিছু অসাধু পুলিশ, ভুয়া চালক, হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন। এই চক্রের সদস্যরা বিআরটিএ থেকে নতুন লাইসেন্স সংগ্রহ করে পরিবহনে চাকরি নেয়। তারা হাইওয়েতে এসে দুর্বৃত্ত চক্রের মাধ্যমে ট্রাক ও কভার্ডভ্যান থেকে মালামাল উধাও করে দেয়। পরে ট্রাকটি পরিত্যক্ত অবস্থায় কোথাও ফেলে রাখে। অনেক সময় চালক ও হেলপারকে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে। পরে তারা ট্রাক বা কভার্ডভ্যান নিয়ে পালিয়ে যায়। খুন, জখম বা মারধর করেও মালামাল নিয়ে যাওয়া হয়।
দেশের অন্যান্য মহাসড়কের তুলনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাত চক্র বেশি সক্রিয়। এই চক্রের লোকজন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে ট্রাক বা কভার্ডভ্যানকে টার্গেট করে। এর মধ্যে উল্লেখয়োগ্য হলো চট্টগ্রামের কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ড, নিমতলী, অলংকার, মনসুরাবাদ, সীতাকুণ্ড, বড়দারোগার হাট, মিরসরাই, বড়তাকিয়া, হাজীপুর, কাপ্তানবাজার, মোহাম্মদ আলী, সুয়াগাজী, মিয়াবাজার, কুমিল্লার পদুয়ারবাজার বিশ্বরোড, চান্দিনা, ইলিয়টগঞ্জ, গৌরীপুর, গজারিয়া, কাঁচপুর, চিটাগাং রোড, সানারপাড়, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড ও আশুলিয়া। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীবাজারসহ গার্মেন্ট অধ্যুষিত আরও কিছু এলাকায় এই চক্রের লোকজন সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে টার্গেটকৃত কভার্ডভ্যান ও ট্রাকচালককে হাত করে নেয়। সেটা সম্ভব না হলে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। অনেক সময় চালক বা হেলপারকে খুন করতেও তারা দ্বিধা করে না। গত দুই বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় ৩০ জন চালক ও হেলপার খুন হয়েছে সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের হাতে।
সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ডাকাত চক্রের নেতাদের মধ্যে রয়েছে পিচ্চি মাসুদ, আজম, সেন্টু, মুসা, সাইদ, লোহা জসিম, আলী আহম্মদ, আবদুল মতিনসহ বেশ কয়েকজন। এদের অনেকেই এক সময় টোকাই বা ট্রাক শ্রমিক ছিল। কিন্তু এখন কোটি কোটি টাকা এবং গাড়ি-বাড়ির মালিক। হাইওয়ে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশও তাদের চেনে-জানে। কিন্তু তারাও কমিশন পায় বিধায় এদের গ্রেফতার করে না। ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা মামলা করার পর তাদের গ্রেফতার করা হলেও অনেক সময় মামলার চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেয়া হয়। চার্জশিটে নাম দেয়া হলেও অনেক সময় আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিয়ে দেন। কারণ তাদের সঙ্গে আইনজীবী, সরকারি আইনজীবীর (পিপি, এপিপি) যোগসাজশ রয়েছে। তারা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এদের মামলা থেকে জামিন ও খালাসের ব্যবস্থা করে দেন। ফলে অনেক মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও থানা পুলিশের কাছে যান না।
পাকশী টান্সপোর্টের মালিক এ রকম একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, তার একটি ট্রাকে ডাকাতি হওয়ার পর ২০০৬ সালে তিনি মামলা করেন। ওই মামলা সিআইডি তদন্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। কিন্তু তার সামনেই আইনজীবীদের সঙ্গে যোগসাজশে আদালত থেকে সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। পরে মামলার বাদী ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান জজকোর্টে।
চিটাগাং ট্রান্সপোর্ট ভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ নূরুল বাহার আমার দেশকে বলেন, হাইওয়েতে ডাকাতি দুর্বৃত্তায়ন রোধে অনেক দিন থেকেই একটি শক্তিশালী আইনের কথা বলে আসছি। কিন্তু সরকার সেটা করছে না। ফলে আমদানি-রফতানি খাত বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের বাইরে নকল বা খালি কন্টেইনার চলে যাচ্ছে। এতে দেশেরও সুনাম নষ্ট হচ্ছে। ডাকাতি যাওয়া মামলামালের ভর্তুকি দিয়ে অনেক পরিবহন ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে গেছেন অথবা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমদানি-রফতানিসহ পরিবহন সেক্টরে অচলাবস্থা দেখা দেবে। তিনি বলেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা বন্দর থেকে মালামাল খালাস করেই দায়িত্ব শেষ করে। এগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব পরিবহনের। এসব পণ্য পরিবহনে ইন্স্যুরেন্সেরও বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে কোনো মাল খোয়া গেলে পরিবহন ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ডাকাতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সরকারের উচিত প্রতিটি ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া। হাইওয়েতে ডাকাতি রোধে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া। এ জন্য শক্তিশালী একটি কমিটি গঠন করা। নূরুল বাহার আরও বলেন, তাদের দাবির প্রেক্ষিতে হাইওয়ে পুলিশ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, হাইওয়ে পুলিশ উল্টো চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত থাকে। মহাসড়কের নিকটবর্তী থানাগুলোর পুলিশও বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে। একেকটি থানায় পোস্টিংয়ের জন্য ওসিদের মোটা অংকের অর্থ খরচ করতে হয়। ফলে তারাও টাকা কামাইয়ের জন্য পরিবহন ডাকাতদের সঙ্গে যোগসাজশ করে। এসব কারণে কোনোভাবেই পরিবহন ডাকাতি রোধ করা যায় না।
এদিকে হাইওয়ে পুলিশ প্রধান ডিআইজি মো. সোহরাব হোসেন আমার দেশকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়ি লাগা থাকে, সেখানে এ রকম ডাকাতির অভিযোগ অবিশ্বাস্য। হাইওয়েতে পুলিশের পর্যাপ্ত টহল রয়েছে। নিয়োজিত থাকে জেলা ও থানা পুলিশের টিমও। তিনি বলেন, কিছু অসাধু মালিক-চালক নিজেরাই কভার্ডভ্যান বা ট্রাকের মালামাল উধাও করে দেন। পরে তারা চুরি ও ডাকাতির কথা বলেন। তাছাড়া হাইওয়ে পুলিশের প্রধান হাইওয়ে ট্রাফিকিং। অপরাধ দমন ও ডাকাতি দুর্বৃত্তায়ন রোধে আইনগত ব্যবস্থা নেয় সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা ও থানা পুলিশ। এরপরও এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলে হাইওয়ে পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

No comments:

Post a Comment