Tuesday 7 December 2010

নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যানকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করল আ’লীগ ক্যাডাররা : রাজপথে বিএনপির মিছিলে হামলা, পৌর মেয়র ও ৪ সাংবাদিকসহ আহত ৪০ : কাল নাটোরে হরতাল

আবদুস সালাম, নাটোর

নাটোরের বনপাড়ায় বিএনপির মিছিলে হামলা করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা বিএনপি নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছে। নিহতের নাম সানাউল্লাহ নূর বাবু (৪০)। একমাত্র ছেলের আকস্মিক খুন হওয়ার খবর শুনে হার্টঅ্যাটাক করেন বাবা ডা. সাবের হোসেন। তাকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিএনপি কাল নাটোরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। নিহত বাবু বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান এবং বনপাড়া পৌর বিএনপি সভাপতি ছিলেন। হামলায় ৪ সাংবাদিকসহ ৪০ জন আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বনপাড়া পৌর বিএনপির উদ্যোগে কেন্দ্রঘোষিত মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে দুলু বনপাড়ার কাছাকাছি এসেছেন—এমন খবর এলে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও বনপাড়া পৌর বিএনপি সভাপতি সানাউল্লাহ নূর বাবুর নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। এর আগে আওয়ামী লীগও একটি বিক্ষোভ মিছিল করে। বিএনপির মিছিলটি উপজেলা চত্বর থেকে শুরু হয়ে বনপাড়া বাজারে এলে আগে থেকেই ওঁত্ পেতে থাকা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা হামলা চালায়। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, ছাত্রলীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা রাকিব, জামিল ও বাবলু। দেড় শতাধিক সশস্ত্র ক্যাডার অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ চালায়। এ সময় সানাউল্লাহ নূর বাবুকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নাটোর-পাবনা মহাসড়কে ফেলে দেয়। চেয়ারম্যান বাবুকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে হামলাকারীদের আঘাতে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও বড়াইগ্রাম বিআরডিবির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন আলী, উপজেলা যুবদল সভাপতি রফিক সরদার, নাজিম উদ্দিন, আবদুল আলিম ও মোজাম্মেল হকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন। নাটোর থেকে যাওয়া কয়েকজন সাংবাদিক ঘটনার ছবি তুলতে গেলে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হামলায় দৈনিক ডেসটিনি, সোনালী সংবাদ ও বাংলার চোখের নাটোর জেলা প্রতিনিধি শেখ তোফাজ্জ্বল হোসেন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নাটোর জেলা প্রতিনিধি নাসিম উদ্দিন, এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান রানা আহম্মেদ ও দিগন্ত টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান লেমন হোসেন আহত হন। শেখ তোফাজ্জ্বল হোসেনের ডান পা ভেঙে গেছে এবং বাম হাত গুরুতর জখম হয়েছে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের নাটোর জেলা প্রতিনিধি নাসিম উদ্দিন ও এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান রানা আহম্মেদের মাথা ফেটে গেছে। দিগন্ত টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান লেমন হোসেনকে লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। আহত চার সাংবাদিকসহ অন্যদের নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতাল ও স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় দুটি টিভি ক্যামেরা ভাংচুর ও তিনটি ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া হয়। হামলায় বড়াইগ্রাম পৌরসভার মেয়র ইসাহাক আলী, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও বড়াইগ্রাম বিআরডিবির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন আলীসহ আরও ৪০ জন আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা রাস্তায় চলাচলকারী তিনটি মাইক্রোবাস, তিনটি প্রাইভেটকার ও সাতটি সিএনজি অটোট্যাক্সি ভাংচুর করে। ঘটনার পরপরই বড়াইগ্রাম পৌরসভা বিএনপি বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করেছে। নাটোর জেলা বিএনপি সভাপতি সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন।
ঘটনার সময় বড়াইগ্রাম পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা মো. ইসাহাক আলীকে বহনকারী মাইক্রোবাস ভাংচুর এবং তাকে মারধর করা হয়। গুরুতর আহত বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে প্রথমে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে আনা হলেও অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় কিছু সময় পরই উন্নত চিকিত্সার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে নেয়ার পর দুপুর আড়াইটার দিকে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর খবরে নাটোরে শোকের ছায়া নেমে আসে। এলাকায় এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বড়াইগ্রাম ও নাটোরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলায় ঢাকা-রাজশাহী ও নাটোর-পাবনা মহাসড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। বনপাড়া বাজারের সব দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ার্ত মানুষ দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। হামলাকারীরা রাস্তায় চলাচলকারী তিনটি মাইক্রোবাস, তিনটি প্রাইভেটকার ও সাতটি সিএনজি অটোট্যাক্সি ভাংচুর করে।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, হামলার সময় পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। হামলার পর দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে দুপুর ১টার দিকে বড়াইগ্রাম পৌরসভা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট শরিফুল হক মুক্তার নেতৃত্বে পৌর এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বলেছেন, বর্তমান সরকার ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা করে দিচ্ছে বলেই হত্যাকারীরা উত্সাহিত হচ্ছে। রাজপথে জনপ্রিয় নির্বাচিত একজন তরুণ উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা তারই প্রমাণ। কোনো কারণ ছাড়া প্রকাশ্যে আজকের এ হামলা, একজন জনপ্রিয় নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা এবং সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন বর্তমান সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্র্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।
আমার দেশ’র বড়াইগ্রাম উপজেলা সংবাদদাতা হাসানুল বান্না উজ্জ্বল জানান, জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবু পূনম, পরমা ও উপমা নামের তিন কন্যাসন্তানের জনক। গত উপজেলা নির্বাচনের আগে তিনি বনপাড়া পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। তার মাত্র কয়েক বছর আগে থানা ছাত্রদলের সভাপতির পদ থেকে সরাসরি পৌর বিএনপি সভাপতির দায়িত্ব পান। তিনি রাজশাহী স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. সাবের হোসেনের একমাত্র ছেলে। আজ সকাল ১১টায় বনপাড়া মুসলিম হাইস্কুল মাঠে নিহত সানাউল্লাহ নূর বাবুর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি এখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
কাল নাটোরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল : নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বনপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি সানাউল্লাহ নূর বাবু নিহত হওয়ার ঘটনায় নাটোর জেলা বিএনপি শুক্রবার রাত ৮টায় সংবাদ সম্মেলন করেছে। জেলা বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির স্বনির্ভর সম্পাদক সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বক্তব্য রাখেন। তিনি এই ঘটনার প্রতিবাদে আগামী রোববার নাটোরে পূর্ণদিবস হরতাল ও শনিবার থেকে তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। শনিবার সকাল ১১টায় বনপাড়া স্কুল মাঠে নিহতের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজার পর বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। দুলু বলেন, একজন উদিয়মান তরুণ নেতাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে রগ কেটে হত্যা করার মাধ্যমে এই সরকার ফ্যাসিবাদী আচরণ করেছে। তিনি বলেন, খুনের আসামিদের ক্ষমা করার মাধ্যমে সরকার নাটোরে হত্যার রাজনীতিকে উত্সাহিত করেছে। রাত ৮টায় নিহতের লাশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নাটোর জেলা বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ঘটনার পর থেকে শহরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment