Tuesday 7 December 2010

পদোন্নতি জ্বরে ভুগছেন সরকারি কর্মকর্তারা : দলবাজদের আবারও পদোন্নতি দেয়ার উদ্যোগ : তালিকা করছেন জনতার মঞ্চের কুশীলবরা

কাদের গনি চৌধুরী

পদোন্নতি জ্বরে ভুগছেন সরকারি কর্মকর্তারা। সরকার দ্বিতীয় দফায় চার স্তরে পদোন্নতির উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে সরকারি কর্মকর্তারা অস্থির হয়ে উঠেছেন। সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়ে উঠেছেন আগেরবারের পদোন্নতি বঞ্চিতরা। পদোন্নতি পাওয়ার জন্য যা যা দরকার সব থাকার পরও সর্বশেষ পদোন্নতিতে তাদের বঞ্চিত হতে হয়। বিগত সরকারের সময় ভালো পদে ছিলেন এবং জনতার মঞ্চে যেসব কর্মকর্তা অংশ নেননি বর্তমান সরকার তালিকা করে তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করে। গতবারের মতো এবারও জনতার মঞ্চের কুশীলবরা পদোন্নতির তালিকা তৈরি করছেন বলে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছেন। এর ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের অস্থিরতা আরও বেড়েছে।সরকার এবারও পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে বিধিমালা চূড়ান্ত না করেই। সুনির্দিষ্ট বিধিমালা ছাড়া পদোন্নতির ফলে মেধাবী কর্মকর্তারা আবারও বাদ পড়ার আশঙ্কা করছেন। সূত্র জানায়, পদোন্নতির জন্য বিভিন্ন মহলে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। উপসচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতির খসড়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র। সাধারণ কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, এর আগেরবার যেসব দলবাজ কর্মকর্তা পদোন্নতির খসড়া তালিকা তৈরি করেছিলেন এবারও তারাই তালিকা করছেন। এবারের তালিকা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন বিদ্যুত্ সচিব আবুল কালাম আজাদ, মিজানুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর পিএস নজরুল ইসলাম খান, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মঈনুদ্দীন আবদুল্লাহ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুল মালেক, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জিল্লার রহমান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাহ কামাল, ঢাকার ডিসি মহিবুল হক, উপসচিব আনসার আলী, খাজা মিয়া, ফয়েজ আহমেদ ও মোশাররফ হোসেন। বর্তমান সরকারের আমলে গত ৭ সেপ্টেম্বর তিন স্তরে ৫০৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে ৬০ জন, যুগ্ম সচিব পদে ১৬৩ জন এবং উপসচিব পদে ২৭১ জন পদোন্নতি পান। একদিনে এত বেশিসংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতি প্রশাসনে এটাই প্রথম। এ পদোন্নতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। দলের অনুগত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে গিয়ে সাড়ে ৫০০-এরও বেশি কর্মকর্তাকে সুপারসিড করা হয়। গত ৭ সেপ্টেম্বর ৩ স্তরে পদোন্নতির আগে পদোন্নতি থেকে বাদ দেয়ার জন্য একটি কালো তালিকা তৈরি করা হয়। এ নিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিতদের পক্ষ থেকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর সংস্থাপন সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছে উকিল নোটিশও পাঠানো হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে যেসব উপসচিব জেলা প্রশাসক, মন্ত্রীর পিএস, প্রধানমন্ত্রী দফতরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নাম কালো তালিকায় স্থান পেয়েছে। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়। এদিকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত ৫৫৩ কর্মকর্তার আবেদন এখনও ফাইলবন্দি। তারা সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। তাদের পদোন্নতি প্রদানে রিভিউর আশ্বাস দেয়া হলেও তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। আবেদন গ্রহণ করার সময় পদোন্নতিবঞ্চিতদের ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনার কথা বলা হলেও সে ফাইল আর নড়েনি।

প্রশাসনের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত চার স্তরে পদোন্নতির প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের একদফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত ৮১৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। প্রথম দফায় ৫০৩ কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ৭২ কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয় ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ পদোন্নতির সময় অতি আস্থাভাজন কর্মকর্তারা পদোন্নতি পান। তৃতীয় দফা পদোন্নতি দেয়া হয় ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। এ সময় ৮৮ কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। এসব পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে বড় করে দেখা হয়। ফলে সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছেন অনেকেই। ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে ২৮৪ নম্বরকে পদোন্নতি দেয়ার মতো অনিয়মও হয়েছে এসময়।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পদোন্নতির জন্য প্রচলিত বিধান অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য ২৫ নম্বর, গত পাঁচ বছরের বার্ষিক বা গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় ৩০ নম্বর, চাকরি জীবনের শুরু থেকে গত পাঁচ বছরের আগ পর্যন্ত সব বছরের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় নম্বর ২৫, সামগ্রিক চাকরি জীবনে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকার জন্য বোনাস নম্বর ১০ এবং সামগ্রিক চাকরি জীবনে কোনো শাস্তি না থাকার জন্য ১০ নম্বর নির্ধারিত রয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন বিধিমালায় চাকরি জীবনের শুরু থেকে গত পাঁচ বছরের আগ পর্যন্ত সব বছরের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় নম্বর ২৫ বিধানটি সম্পূর্ণ বাতিল করা হচ্ছে। নতুন বিধিমালায় শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য ২৫ নম্বর, গত পাঁচ বছরের বার্ষিক বা গোপনীয় প্রতিবেদনের গড় নম্বর ৫০, সামগ্রিক চাকরি জীবনে বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকার জন্য বোনাস নম্বর ১০ এবং সামগ্রিক চাকরি জীবনে কোনো শাস্তি না থাকার জন্য ৫ নম্বর, সাক্ষাত্কারের জন্য ১০ নম্বর রাখা হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের একটি সূত্র জানায়, সরকার নিজেদের পছন্দের বিশ্বস্ত আমলাদের দিয়ে চারটি ধাপে প্রশাসন সাজানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে তারই অংশ হিসেবে তারা এ পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক কর্মকর্তাদের দ্রুত ও বেশি সংখ্যায় পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসন পিরামিডকে শক্ত বৃত্তের মধ্যে বেঁধে ফেলার কৌশল হিসেবে সরকার হঠাত্ এ পদোন্নতির উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে পদোন্নতিকে ঘিরে মহা টেনশনে আছেন সরকারি কর্মকর্তারা। পদোন্নতি পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। বিগত বিএনপি সরকারের সময় ডিসির দায়িত্বে থাকা সরকারি এক কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, ছাত্রজীবনে কোনো দিন রাজনীতি করিনি। বিগত সরকার এসিআর দেখে আমাকে ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়। এ সময় আমার ব্যাচের অনেকে আমাকে পদোন্নতি দেয়ায় নাখোশ ছিলেন। তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, আমি সরকারি দলের অনুগত নই, তারপরও কেন ডিসি করা হলো। ডিসি থাকাকালে দলবাজির কোনো অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে নেই। অথচ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত সরকারের সময় ডিসি ছিলাম বলে আমাকে পদোন্নতি দেয়া হলো না। বর্তমান সরকারের অত্যন্ত বিশ্বস্ত আমার এক ব্যাচমেটের কাছে গতকাল গিয়ে আমার ওপর যাতে অবিচার না হয় তা খেয়াল রাখার অনুরোধ করেছি।
সাবেক এক মন্ত্রীর পিএস (৮৪ ব্যাচের) আমার দেশকে জানান, ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বিএনপি সরকারের আমলে হঠাত্ আমার এক ব্যাচমেটের কারণে মন্ত্রীর পিএসের দায়িত্ব পাই। সেসময় বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা আমার বিরুদ্ধে মন্ত্রীকে অভিযোগ করেন। মন্ত্রী আমাকে সরাসরি বিষয়টি জানান। আমি মন্ত্রীকে জানাই, আমি ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। চাকরি জীবনে এসে রাজনীতি ত্যাগ করেছি। এখন পুরোপুরি সরকারি কর্মকর্তা। মন্ত্রী আমার কথা শুনে বললেন, ঠিক আছে, ভালোভাবে কাজ করুন। বিগত সরকারের সময় মন্ত্রীর পিএস ছিলাম এ অপরাধে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলো আমাকে। আমার এক বন্ধু এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। বর্তমানে একটি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব। সরকারের খুবই বিশ্বস্ত। শুনছি পদোন্নতির তালিকা তৈরির সঙ্গেও নাকি সে জড়িত। গতকাল ফোন করে তার কাছে জানতে চেয়েছি মন্ত্রীর পিএসের দায়িত্ব পালন করলে কি বিএনপি হয়ে যায়? সে জবাবে বলেছে দোস্ত এসব কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।

No comments:

Post a Comment