Friday 17 December 2010

চট্টগ্রামে ২৫ হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা : টঙ্গীতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিক্ষোভ অবরোধ



স্টাফ রিপোর্টার

রফতানি আয়ের সর্ববৃহত্ খাত তৈরি পোশাক শিল্প এখনও শান্ত হয়নি। গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় গতকালও রাজধানীর অদূরে টঙ্গী এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে।
টঙ্গীতে পোশাক শ্রমিকদের সড়ক অবরোধের কারণে প্রায় তিন ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গতকাল বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ে সরকার, মালিক পক্ষ ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পোশাক শ্রমিকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে রোববারের ঘটনায় গতকাল চট্টগ্রামে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নামে-বেনামে ২৫ হাজার শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। বেপজা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনার পর কোরীয় প্রতিষ্ঠান ইয়ংওয়ানের ১১টি প্রতিষ্ঠান আজ থেকে ফের খুলে দেয়া হবে।
আমাদের টঙ্গী সংবাদাতা জানিয়েছেন, টঙ্গীতে নাসা গ্রুপের লিজ অ্যাপারেলস গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামো যথাযথ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবিতে গতকাল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অবরোধ চলাকালে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ প্রায় ২০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগের শিকার হন। স্কুল কলেজগামী ছাত্রছাত্রী ও অফিসগামী লোকজন হেঁটে নির্ধারিত সময়ের পর গন্তব্যে পৌঁছলেও দূরপাল্লার যাত্রীদের পরিবহনে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
রোববার লিজ গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের নভেম্বরের বেতন দেয়া হয়। গতকাল সকালে শ্রমিকরা বেতন বৈষম্যের অভিযোগে কাজে যোগদান না করে কারখানার গেটে জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা সরকার ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন, সাপ্তাহিক ছুটি কার্যকর ও পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিলসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। খবর পেয়ে গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, শিল্প পুলিশের স্থানীয় ওসিসহ ২ জন এএসপি, টঙ্গী ও জয়দেবপুর থানার ওসি এবং জেলার ২ জন ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে বহু অনুরোধ করেও শ্রমিকদের অবরোধ ভাঙতে পারেনি। অবশেষে নাসা গ্রুপের পরিচালক সাইফুল আলম ঢাকা থেকে এসে শ্রমিকদের সব দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেয়।
শ্রমিকরা জানায়, কারখানা কর্তৃপক্ষ নতুন বেতন কাঠামো অনুসরণ না করে অপারেটরদের গড় বেতন ৩ হাজার ৫০০ টাকা, নতুন হেলপারদের বেতন ২ হাজার ৫০০ টাকা ও পুরাতন হেলপারদের বেতন ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে এবং ওভারটাইমের মজুরি আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া কারখানায় সাপ্তাহিক ছুটি ও শুক্রবার জুমা নামাজের বিরতি দেয়া হয় না। এমনকি মহিলা শ্রমিকদের হিজাব পড়ে কারখানায় ঢুকতে দেয়া হয় না। শ্রমিকদের অভিযোগের ব্যাপারে নাসার চেয়ারম্যান সাইফুল আলম বলেন, সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামো যথাযথ অনুসরণ করেই শ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো সম্পর্কে শ্রমিকদের ধারণা না থাকায় তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। সিনিয়রিটি ও জুনিয়রিটি মেনে গ্রেডওয়ারি বেতন নির্ধারণ করায় সাধারণ শ্রমিকরা বিষয়টিকে বেতন বৈষম্য মনে করছে।
অবরোধ চলাকালে ভাংচুরের আশঙ্কায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় পাশের দোকানপাট ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। খাবার ও ওষুধের দোকানসহ সব ধরনের দোকানই বন্ধ দেখা গেছে।
কালিয়াকৈরে দেড়শ’জনের বিরুদ্ধে মামলা : কালিয়াকৈরে ফ্যাক্টরি ভাংচুরের ঘটনায় নামে-বেনামে প্রায় দেড়শ’ শ্রমিককে আসামি করে মামলা হয়েছে। উপজেলার মৌচাক শিল্পাঞ্চলে মোয়াজউদ্দীন টেক্সটাইল মিল লিমিটেডে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাটের মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগে দেড়শ’ শ্রমিকের বিরুদ্ধে ফ্যাক্টরি ম্যানেজার (প্রশাসন) আবদুল মালেক বাদী হয়ে সোমবার দুপুরে কালিয়াকৈর থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ৬৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে মামলায় ২৫ হাজার আসামি : রোববারের ঘটনায় বন্দর থানা পুলিশের তিন এসআই বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা করেছেন। এর মধ্যে একটি মামলা করা হয়েছে শ্রমিক ও পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করার অভিযোগে। অন্য দুটি মামলা পুলিশের ওপর হামলা এবং কর্তব্যে বাধাদানের অভিযোগে। তিনটি মামলায় ঘটনার দিন আটক ৩১ জনসহ প্রায় ২৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বন্দর থানা পুলিশ।
ইয়ংওয়ান কর্তৃপক্ষ দায়ের করতে যাচ্ছে পৃথক আরেকটি মামলা। এ কারণে শ্রমিকদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। ইপিজেডের ভেতরে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও তিন-চারদিন সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে। কোরিয়াভিত্তিক ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের মালিকানাধীন ১১টি কারখানা অবশ্য গতকালও চালু হয়নি। আজ এসব প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে বলে ইয়ংওয়ান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল সকাল থেকে কড়া পুলিশ পাহারায় ইপিজেড গেট শ্রমিকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো সকাল ৮টা থেকে একের পর এক খুলতে থাকে। মোট ১৫৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪০টি প্রতিষ্ঠান বিকাল নাগাদ চালু হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ হলেও শ্রমিক উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকায় পূর্ণ উত্পাদনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সকাল থেকে বেপজা চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ খান, সংসদ সদস্য এম এ লতিফ ও সিইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক আবদুর রশিদ ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলো পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা কারখানা কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি শ্রমিকদের সঙ্গেও কথা বলেন। বেপজা চেয়ারম্যান দুপুর ১২টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা পুরো এলাকা ঘুরে দেখেছি। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছে। শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছে। রোববারের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু বেতন-ভাতার কারণে এত বড় ঘটনা ঘটেনি। এতে বাইরের ইন্ধন আছে বলে মনে হচ্ছে। তবে ইন্ধনদাতা কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। রোববারের ঘটনা তদন্তে কমিটিকে সাত দিন সময় দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ইয়ংওয়ানের আইন কর্মকর্তা আফতাব আহমেদ জানান, গতকাল এ গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে আজ একযোগে ১১টি প্রতিষ্ঠান চালু করা হবে। তিনি আরও জানান, হামলায় চট্টগ্রামে ইয়ংওয়ানের প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ব্যাপারে ইয়ংওয়ান কর্তৃপক্ষ পৃথক একটি মামলা দায়ের করবে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছিল বলে তিনি জানান।
ফের অসন্তোষ : কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই গতকাল নতুন করে ইপিজেডের ভেতরে ৪ নম্বর রোডের এক্সেলসিওর সু কোম্পানির কারখানায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। দুপুরে কারখানাটির কয়েকশ’ শ্রমিক দুই মাসের বকেয়া বেতন ও মহার্ঘ্য ভাতার দাবিতে কাজ বন্ধ করে দিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ ও বেপজা কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তাদের সামনেই মালিক পক্ষ বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা এক ঘণ্টা পর কাজে ফিরে যায়।
নিহত ৪ জনের পরিচয় : রোববার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ৪ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে ৩ জনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। অপরজন মারা যায় সংঘর্ষ চলাকালে পালাতে গিয়ে হার্ট এটাকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতরা হলো আরিফুল ইসলাম বেলাল (২২), মো. মনজু (২২) ও মিলন (২৮)। আরিফুল পেশায় রিকশাচালক। সে দিনাজপুরের মঠবাড়িয়া গ্রামের পবা মিয়ার ছেলে। মনজু ইপিজেডের ইউনিটি গার্মেন্টের শ্রমিক। সে পটুয়াখালীর গলাচিপা এলাকার লিটনের ছেলে। মিলন ইপিজেড এলাকায় ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করত। সে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার উত্তর বাহেরচর গ্রামের ফরিদ উদ্দিনের ছেলে। নিহত অপরজন হলেন রুহী দাস (৪৫)। তার বাসা নগরীর পাথরঘাটা গুর্খা ডাক্তার লেইন এলাকায়। তিনি ইপিজেডের একটি গার্মেন্টের কাটিং মাস্টার। সংঘর্ষের সময় তিনি প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান । হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ৪ জনের লাশই রোববার রাতে আত্মীয়-স্বজন বুঝে নিয়েছেন বলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, শনিবার দুপুরে ইপিজেডের ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের একটি গার্মেন্টে শ্রমিক অসন্তোষের সূত্রপাত ঘটে। সিনিয়র ও জুনিয়রদের একই স্কেলে বেতন দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শ্রমিকরা কারখানাটিতে ভাংচুর চালায়। একই সময় একই গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠানে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে কর্তৃপক্ষ সবক’টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। পরদিন রোববার সকালে ইয়ংওয়ানের কয়েক হাজার শ্রমিক কাজে যোগ দিতে গিয়ে কারখানা বন্ধ দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে দুপুর পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোটা ইপিজেড এলাকা। এ সময় ভাংচুর করা হয় ২৫-৩০টি যানবাহন ও ৩০টির মতো কারখানা। একপর্যায়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি চালায়। এতে অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়। সংঘর্ষ চলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আহত হয় ৩৫ পুলিশ, ৫ সাংবাদিকসহ দুই শতাধিক শ্রমিক। এর পরই ইপিজেডের সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

No comments:

Post a Comment