Friday 17 December 2010

সাকা চৌধুরী গ্রেফতার : নির্মম নির্যাতন : পাঁচ দিনের রিমান্ড



স্টাফ রিপোর্টার

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিশিষ্ট পার্লামেন্টেরিয়ান ও দেশের আলোচিত রাজনীতিক সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপিকে গ্রেফতার করে পাঁচদিনের পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বিপুলসংখ্যাক র্যাব ও সাদা পোশাকধারী পুলিশ বৃহস্পতিবার ভোররাতে রাজধানীর বনানী এলাকার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে বলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আটকের সময় ও পরে ক্যান্টনমেন্ট থানায় এবং ডিবি অফিসে তাকে দফায় দফায় নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে সাকা চৌধুরী আদালতে জানিয়েছেন। বিবস্ত্র করে বর্বর কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে তার আইনজীবী জানান। নির্যাতনে তার শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠলে দ্রুত তাকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সা দেয়া হয়। আদালতে হাজির করার সময়ও তার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। মুখ এবং হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে যখমের চিহ্ন দেখা যায়। তার পরনের জামা-প্যান্টেও রক্তের দাগ লেগেছিল। আদালতে নেয়ার সময় তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। পুলিশের কাঁধে ভর করে তাকে আদালতে হাজির করানো হয়।
বুধবার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের আবেদন করা হয়। সে আবেদনের শুনানি আগামী রোববার হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগেই তাকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতার দেখানো হলো ২৭ জুন বিএনপির ডাকা হরতালের আগের রাতে মগবাজারে গাড়ি পোড়ানো মামলায়। যদিও গ্রেফতারের পর গতকাল ভোরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায়ই গ্রেফতার করা হয়েছে। এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একই কথা বলেছেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। নিজ এলাকা চট্টগ্রামে রোববার অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বাধা দেয় এবং সেখান থেকে সংসদ সদস্য শাম্মি আক্তারসহ কয়েকজনকে আটক করে।
গ্রেফতারের পর ক্যান্টনমেন্ট থানা ও পিজি হাসপাতালের পর দুপুর পর্যন্ত তাকে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে রাখা হয়। দুপুরের পর কঠোর নিরাপত্তায় আদালতে পাঠিয়ে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায়। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শেষে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
আত্মীয়-স্বজনরা জানান, গতকাল ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে পিজি হাসপাতালে আনার সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নাকে-মুখে ও গালে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার শার্টে ও প্যান্টে রক্তের ছোপ লেগেছিল। শার্টের সামনের দিক দিয়ে ছেঁড়া ছিল। পরে তাকে পিজি হাসপাতাল থেকে হুইল চেয়ারে করে পুলিশের গাড়িতে তুলে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। দুপুরে দুই পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে আদালতে বিচারকের এজলাসে নেয়া হয়। এ সময় তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। নাকে রক্ত লেগেছিল। আত্মীয়-স্বজনরা জানান, ডিবি কার্যালয়ে তার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি।
আদালতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বক্তব্যের অনুমতি চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট ২ মিনিট সময় দেন। এ সময় গুরুতর অসুস্থ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আটকের পর আমাকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের আঘাতের চিহ্ন ও রক্তের দাগ তিনি আদালতকে দেখান। রক্তাক্ত একটি রুমালও বের করে দেখান। বিচারকের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনার কাছে আমি আর কী বিচার চাইব। এর বিচার আমি মহান আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিলাম। আদালতকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, মানুষ ভালোবাসে বলেই বারবার তারা আমাকে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছেন। তিনি মন্তব্য করেন, যদি শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতেন তাহলে আমাকে এ নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হতো না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো জানেন না আমার ওপর কী ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭৮ সালে মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর জাতীয় পার্টির আমলে সব কয়টি নির্বাচনে অংশ নেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদ সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন তিনি। পরে এনডিপি গঠন করে চেয়ারম্যান হন। এনডিপি থেকে নির্বাচন করে ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সময় বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপত্ভাবে অংশ নেন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বহু বৈঠকে উপস্থিত থেকে তখনকার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়িতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বৈঠকও হয়েছিল। একপর্যায়ে সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগও করেন আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়ে। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপি দলীয় প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিগত জোট সরকারের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। গত বছর বিএনপি স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠিত হলে তিনি দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য হন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জাতীয় সংসদে এবং বাইরে বিভিন্ন সময় বক্তব্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে তার বোন হিসেবে সম্বোধন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্কের কথাও বলেছেন বিভিন্ন সময়। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে গেলে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন বলেও বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এক সাক্ষাত্কারে জানান, তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর হাত ধরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।
যেভাবে গ্রেফতার : গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় র্যাবের গোয়েন্দা উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে র্যাব ও পুলিশের একটি যৌথবাহিনী বনানীর একটি বাসা থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। বনানী ৮ নম্বর রোডের ২৫ নম্বরে তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার কক্ষে ছিলেন তিনি। ওই বাড়ির মালিক সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এক বন্ধু। গোয়েন্দা তথ্যে নিশ্চিত হয়ে রাত ৩টার দিকে র্যাব, ডিবি, গুলশান থানা পুলিশসহ কয়েকশ’ পুলিশ ঘিরে রাখে। পরে সাদা পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা দ্বিতীয় তলার কক্ষ থেকে তাকে আটক করে নিচে নিয়ে আসে। অভিযানের সময় ওই বাড়ির প্রতিটি তলায় র্যাব ও পুলিশ অবস্থান নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এ সময় কাউকে বাসার বাইরে বের হতে দেয়া হয়নি। এরপর তাকে কঠোর নিরাপত্তায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতনে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। সালাহউদ্দিন কাদের স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী বলেন, দু’তিনদিন ধরে তার স্বামী বাসায় থাকেন না। মঙ্গলবার রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধানমন্ডির বাসায় অভিযান চালানোর পর থেকেই তিনি অন্য স্থানে রাতযাপন করতেন। তবে বুধবার রাত ১টায় স্বামীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। তবে তাদের ফোন গোয়েন্দা মনিটরিংয়ে থাকায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তিনি প্রশ্ন করেননি কোথায় রাতযাপন করছেন। তিনিও এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। ফারহাত কাদের চৌধুরী বলেন, ভোররাতে ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় তার মোবাইলে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, আপনার স্বামী গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেননি। পরে স্বামীর মোবাইলে ফোন করলেও কেউ রিসিভ করেননি। কিছুক্ষণ পর একটি বেসরকারি টেলিভিশনের স্ক্রলে গ্রেফতারের খবর দেখতে পান। খবর নিয়ে জানতে পারেন বনানীতে এক বন্ধুর বাসা থেকে র্যাব-গোয়েন্দারা তাকে গ্রেফতার করেছে। তবে কার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা নিশ্চিত নয় পরিবারের সদস্যরাও।
নির্যাতনের অভিযোগ : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। গতকাল ডিবি কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের কাছে এ অভিযোগ করেন তার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে ফাইয়াজ কাদের চৌধুরী। ফারহাত কাদের চৌধুরী বলেন, গ্রেফতারের পর তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। এ নির্যাতনের চিহ্ন ঢাকতেই রাতে তার স্বামীকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেয়া হয়েছিল। ট্রানজিট ও সরকারের বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রম সম্পর্কে তার মতামত ছিল সুস্পষ্ট। তাই সরকার ভীত হয়ে তাকে গ্রেফতার করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বড় ছেলে ফাইয়াদ কাদের চৌধুরী বলেন, সকাল থেকে বসে থেকেও তার বাবার সঙ্গে তিনি ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও দেখা করতে পারেনি। তিনি বলেন, তার বাবাকে একটি হুইল চেয়ারে করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তার বাবার শার্টের কলার ছেঁড়া ও রক্তের দাগও চোখে পড়েছে। ওই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল তার বাবার শরীরের বিভিন্ন অংশেও আঘাত করা হয়েছে। স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী বলেন, দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে ডিবি অফিসে থাকা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ফোন করে বলেন, আমার গরম পোশাক প্রয়োজন, আমাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। একথা বলেই ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, তার স্বামীকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছে। এ অভিযোগ করে ফারহাত কাদের বলেন, আটকের সময়ই যদি এভাবে নির্যাতন চালানো হয় তবে রিমান্ডে নিয়ে কী করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ছেলে হুমমাম কাদের চৌধুরী বলেন, বাবা এমন কোনো অপরাধ করেনি যে তাকে নির্যাতন করতে হবে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ব্যক্তিগত আইনজীবী ব্যারিস্টার পারভেজ আহমেদ জানান, ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে পিজি হাসপাতালে নেয়া হয় সালাহউদ্দিন চৌধুরীকে। সেখানকার ডাক্তার সায়ান্ত বলেছেন, মুখে রক্তের দাগ ছিল। তার গালে ও ঘাড়ে আঘাতের চিহ্ন এবং শার্ট ছেঁড়া ছিল। স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী জানান, ’৭১ সালের এপ্রিল থেকে ’৭৪ পর্যন্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী করাচিতে ছিলেন। দেশে অনুপস্থিত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনাকে অযৌক্তিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও সরকারকে খুশি করার জন্যই তার স্বামীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলেছে।
ডিবি অফিস এলাকায় বিক্ষোভ : ভোর থেকেই মিন্টো রোডে ডিবি কর্যালয়ের সামনে ভিড় করেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্বজন ও বিএনপি’র বিভিন্নস্তরের নেতা-নেত্রী। সকাল ৯টায় দেখা যায়, মহিলা দল নেত্রী শিরিন সুলতানা, বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকন, সংসদ সদস্য নিলুফার চৌধুরী মনিসহ ২০/৩০ জন নেতাকে। পরে সেখানে আসেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সেক্রেটারি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ বিএনপির আরও নেতাকর্মী। ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, একজন আইনজীবী হিসেবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ডিবির কর্মকর্তারা আমাকে দেখা করতে দেননি। আইনজীবী হিসেবে আসামির সঙ্গে দেখা করার বিধান থাকলেও এর তোয়াক্কা করেননি ডিবির কর্মকর্তারা। এদিকে ডিবির কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বেলা ২টা ৫ মিনিটে মিন্টু রোডের গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আদালতে নেয়া হয়। গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পথে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের, বড় ছেলে ফাইয়াজ কাদের, ছোট ছেলে হুমমাম কাদের, একমাত্র মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরীসহ আত্মীয়স্বজন এবং উপস্থিত বিএনপি ও তার সংগঠনের নেতাকর্মীরা গোয়েন্দা কার্যালয়ের প্রধান প্রবেশপথে তাকে বহনকারী গাড়ি বহরের সামনে দাঁড়ান। এসময় পুলিশ তাদের হটিয়ে দেয়। দলীয় নেতাকর্মীরা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মুক্তির দাবিতে বেশ কয়েকবার মিছিল করে। বেলা ২টার দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কোর্ট হাজত থেকে বের করে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম নজরুল ইসলামের চারতলার আদালতে নেয়া হয়। এ সময় তার পরনে ছিল প্যান্ট, শার্ট ও চাদর। পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে পুলিশের কাধে ভর দিয়ে অনেকটা পাঁজাকোলে করে তাকে আদালতের এজলাসে নেয়া হয়।
রিমান্ডের শুনানি : বেলা আড়াইটার দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কোর্ট হাজতে নিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে বেলা পৌনে তিনটায় দু’জন পুলিশ তার দুইহাত কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে তাকে সিএমএম কোর্টের ৪র্থ তলায় ১১নং এজলাসের কাঠগড়ায় হাজির করান। নির্যাতনে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজ শক্তির ওপর ভর করে দাঁড়াতে পারেননি। এ সময় তার নাক দিয়ে থেমে থেমে রক্ত পড়ছিল। হাতের রুমাল দিয়েই তিনি তা মুছে নেন। মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলাম এজলাসে বসার পর অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে কাঠগড়ায় তার বসার ব্যবস্থা করেন।
আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে মগবাজার এলাকায় গত ২৬ জুন একটি গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে রমনা থানায় দায়ের করা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ইন্সপেক্টর ফজলুর রহমান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। এ আবেদনে বলা হয়েছে, এ মামলায় অন্যান্য আসামিদের নাম জানার জন্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এ রিমান্ড আবেদনের পক্ষে পিপি আবদুল্লাহ আবু, অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নানসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন আইনজীবী শুনানি করেন। শুনানিতে তারা রিমান্ড মঞ্জুর করার জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা জানান। রিমান্ড আবেদন না মঞ্জুর করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জামিন দেয়ার আবেদন জানিয়ে আদালতে অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, রমনা থানার যে মামলাটিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে ওই একই মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত বিরোধী দলের প্রায় সব নেতাকেই গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তারা সবাই এ মামলার অভিযোগ থেকে জামিন পেয়েছেন। সানাউল্লাহ মিয়া মামলার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালতে বলেন, কথিত ও হাস্যকর অভিযোগ এনে দায়ের করা এ মামলার বিষয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন যে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এ গাড়িটিতে আগুন ধরেছে। অথচ এ মামলার সূত্র ধরেই সব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ২৬ জুনের এ ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ এর তিন দিন আগে থেকেই তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন এবং তিন দিন পরে তিনি ঢাকায় এসেছেন। এটা হলো বাস্তবতা। তিনি কি করে চট্টগ্রামে থেকে ঢাকায় গাড়িতে আগুন দিলেন তা বিশ্বের কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া আদালতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দিকে ইঙ্গিত করে আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, মাননীয় আদালত, দয়া করে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো এ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের দিকে একটু তাকান। তিনি জাতীয় সংসদের ৬ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। অথচ তাকে বিনা ওয়ারেন্টে আটক করে ক্যান্টনমেন্টে ও ডিবি অফিসে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্যাতন করে তার জীবন মরণাপন্ন অবস্থায় নিয়ে এসেছে। রিমান্ড মঞ্জুরের আগেই যদি এমন নির্যাতন করা হয়, তাহলে রিমান্ডে তার ওপর কি পরিমাণ নির্যাতন করা হবে তা আপনি একটু অনুধাবন করুন। তার নাক দিয়ে এখনও রক্ত পড়ছে। তাকে এতটাই নির্যাতন করা হয়েছে যে, জরুরি ভিত্তিতে তাকে চিকিত্সার জন্য হাসপাতালেও নিতে হয়েছে। এটা কোনো মানুষের প্রতি মানুষের আচরণ হতে পারে না। ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবারই রয়েছে। এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া, অ্যাডভোকেট গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল, অ্যাডভোকেট বোরহানউদ্দিন, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন মেসবাহসহ বিপুলসংখ্যক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার দিকে নজর রেখে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন আদালত।
এটাই হচ্ছে স্বাধীন আদালতের নমুনা : আদালত থেকে বেরিয়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আটকের পর একটি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ঘটনার তিন দিন আগে থেকে যে লোকটা চট্টগ্রামে অবস্থান করছিল এবং ঢাকায় এসেছে ঘটনার তিন দিন পরে, তিনি কিভাবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় একটি গাড়িতে আগুন দিলেন তা অন্তত আমার বুঝে আসছে না। কিন্তু আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য গ্রহণ করে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এটাই হচ্ছে আমাদের স্বাধীন আদালতের নমুনা। তিনি বলেন, বিচারের আগেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এ ঘৃণ্য নজির ওয়ান ইলেভেনের জরুরি অবস্থার সরকারও করেনি। তিনি বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানোর জন্য সরকার আবেদন করেছে। আগামী রোববার ওই আবেদনের ওপর শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়েছে। অথচ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা বলছেন যে, তাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আদালতের নির্দেশে আটক করা হয়েছে। অপরদিকে পুলিশ তাকে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে। এ ধরনের তুঘলকি কাণ্ড আমার ওকালতি জীবনে দেখিনি।
শুনানির সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ আত্মীয়রা উপস্থিত ছিলেন। আদালত থেকে বেরিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমার স্বামী নির্দোষ। এর আগেও তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আদালত থেকেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেরিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও ১৫টি মামলা করা হয়েছিল। তিনিও অনেক মামলায় ইতোমধ্যেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। আশা করছি একইভাবে আমার স্বামীও আদালতের রায়েই নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কেননা তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
আওয়ামী লীগের উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণ : আদালতে আনা-নেয়ার সময় পুলিশের প্রোটেকশনে ঝাড়ু ও জুতা দেখায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা। এসময় তারা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচার চেয়ে সেম্লাগান দেয়। এদিকে তাকে গ্রেফতারের খবরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় উল্লাস করেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এসময় তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সেম্লাগান দেয় এবং মিষ্টি বিতরণ করে। পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানার বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা উল্লাস প্রকাশ এবং মিষ্টি বিতরণ করেছে। আদালত থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের বেশ কিছু কর্মী গাড়ি লক্ষ্য করে ঝাড়ু ও জুতা প্রদর্শন করে। এছাড়া মিরপুরের ১নং গোলচত্বর, পল্লবী, পাইকপাড়া, কল্যাণপুর, শ্যাওড়াপাড়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগ আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা পরিকল্পিতভাবে তাদের কর্মীদের আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো করে। এ সময় তাদের হাতে নতুন ঝাড়ু ও জুতা ছিল।

No comments:

Post a Comment