Tuesday 7 December 2010

আইনশৃঙ্খলায় আরও ধস : উদাসীন সরকার



আলাউদ্দিন আরিফ

ভেঙেপড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। ইভটিজিং, ক্রসফায়ার, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল-পাল্টা দখল, সংঘর্ষ ঘটেই চলছে। বেড়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক সহিংসতা ও ভয়ঙ্কর অপরাধ। ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললেই এরকম অসংখ্য খবর নজরে আসে। বর্তমান সরকারের ২৩ মাসে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভাগগুলো। মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার ছিল। বাস্তবে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বরাবরই ক্রসফায়ারকে বেছে নেয়া হয়েছে। সরকার ক্ষমতায় আসার পর র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ারে কমপক্ষে ২৭৫ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষও আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। ঢাকার কদমতলীতে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল পাঁচ ডাকাত। গতকালও কুমিল্লার মুরাদনগরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ব্যবসায়ী মারা যাওয়ার জের ধরে গণপিটুনিতে মারা গেছে তিন সন্ত্রাসী।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেন, চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। এরপর ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী জরুরি সরকারের সময়েও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা হয়। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে কাজ করছে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তারা কতটুকু সফল হয়েছে এটা মূল্যায়ন করবে দেশের মানুষ। আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ও দেশের মানুষের নিরাপত্তায় তারা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এরমধ্যে যেটুকু তারা করতে পারেননি সেটুকুই তাদের ব্যর্থতা।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে মহাজোট সরকার ক্ষতায় আসার পরই সর্বত্র শুরু হয় দখল, পাল্টা দখল আর রাজনৈতিক সহিংসতা। এসব নিয়ে ব্যাপক খুনখারাবিও হয়েছে। বাস, লঞ্চ টার্মিনাল, ফুটপাত, মাদক স্পট, এমনকি পাবলিক টয়লেট পর্যন্ত দখলে নেয়ার অভিযোগ ওঠে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে।
চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও বর্তমান সরকারের সময়ে পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থীরা আবার ফিরে এসেছে। তারা মাঠে নেমেছে পুরো শক্তি নিয়ে। তারা চালিয়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তাদের অপ্রতিরোধ্য কর্মকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত ক্রসফায়ারকেই বেছে নিয়েছে সরকার। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যখন অস্থির ঠিক ওই সময়ে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউপিডিএফ-জেএএসসহ সশস্ত্র গ্রুপগুলো। তাদের হাতেও ঘটছে একের পর লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। চরমপন্থী ও সশস্ত্র গ্রুপগুলো র্যাব-পুলিশ কাউকেই তোয়াক্কা করছে না। বরং পুলিশকেও তারা খুন করছে অকম্পিত হাতে। পাবনার সাঁথিয়ায় চরমপন্থীদের হাতে তিন পুলিশকে হত্যার পর অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটেছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর তথ্যমতে, গত মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ১৪ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে র্যাব কর্তৃক ১০ জন এবং পুলিশ কর্তৃক ৪ জন নিহত হয়েছেন। বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১০ জন ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। এদের সবাই র্যাবের হাতে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের মতে, দেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করতে না পারায় রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যাকারীদের দায়মুক্তির সুযোগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। বিচার ছাড়া অভিযুক্তদের খুন করার রেওয়াজের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি লাভ করেছে। অধিকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে ইভটিজিং নামে এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। এটি দেশে মহামারী আকার ধারণ করেছে। গতকালও ইভটিজারদের হাতে বরগুনার নিজের পা খোয়াতে বসেছেন কলেজ ছাত্রী সোমা। থানায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি এই কলেজ ছাত্রী ও তার বাবা। ইভটিজারদের ভয়ে ৬ মাস কলেজে যাননি সোমা। গতকাল গিয়েছিলেন বাবা ইউনুস হাওলাদারকে সঙ্গে নিয়ে। দুর্বৃত্তরা বাবা-মেয়ে দু’জনকেই কুপিয়ে আহত করেছে। এর আগে মঙ্গলবার চাঁদপুরের মতলবে নিজের কন্যাকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় এক বাবাকে খুন করেছে ইভটিজাররা। দেশের কোনো অঞ্চলেই এখন নারীদের নিরাপত্তা বলে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। সরকারি দল আশ্রিত গুণ্ডারা যৌন লালসা মেটাতে নিরীহ নারীদের ওপর হামলে পড়ছে। নরপিশাচদের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে গিয়ে মা, কোথাও বাবা, স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে স্বামী, পুত্রবধূকে রক্ষা করতে গিয়ে শ্বশুর, নাতনিকে রক্ষা করতে গিয়ে মাতামহ এবং ছাত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে শিক্ষক খুন হয়েছেন। এমন সব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এক দেড় মাসের মধ্যে।
এর আগে গত ১ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার রায়পুর উপজেলার নিঝুড়ি গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্রী রুপালি রানী টুনি কোচিংয়ে যাওয়ার সময় একই এলাকায় ছাত্র লীগ কর্মী পরিচয় দেয়া সুশীল চন্দ্র মণ্ডল তাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে জোরপূর্বক সিঁদুর পরিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখে। সুশীল চলে যাওয়ার পর টুনি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। জীবন দিয়ে সিঁথির সিঁদুর মোছে রুপালি।
অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী গত নভেম্বর মাসে বখাটেদের দৌরাত্ম্যে তিন কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। দুই পুরুষ বখাটের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে ............নিহত এবং ৫৪ জন আহত হয়েছেন।
গত ২ নভেম্বর বখাটেদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে সারাদেশে হাই অ্যালার্ট জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। একই সঙ্গে এই অপরাধে অভিযুক্তদের বিবুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ এ অপরাধের শিকার কিশোরী, তরুণী ও নারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেও সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করা হলেও ইভটিজিং রোধ হয়নি।
আইনশৃঙ্খলার অবনতির পাশাপাশি যৌতুকের জন্যও সহিংসতা বেড়েছে। গত ১৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরের শহীদনগর এলাকায় আল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি যৌতুকের দাবিতে তার স্ত্রী নূপুরের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এলাকাবাসী আগুনে ঝলসে যাওয়া নূপুরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে। নভেম্বর মাসে ২৬ জন নারী এবং দু’জন পুরুষ যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ১৬ জন নারীকে এ সময়ে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। ১০ জন যৌতুকের কারণে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সময়কালে ছয় বছরের একটি ছেলেকে তার বাবা যৌতুকের জন্য তার মাকেসহ পুড়িয়ে মেরেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা। গত ২১ নভেম্বর হবিগঞ্জ বাহুবল উপজেলার রূপসংকর (বানিয়াগাঁও) গ্রামে ইউপি চেয়ারম্যান ডা. রমিজ আলীর বাড়িতে সুমি আক্তার (১৫) নামে এক কিশোরীকে একদল দুর্বৃত্ত ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। পুলিশ সাদ্দাম, জসিম, সোহেল ও স্থানীয় মিরপুর ইউপি চেয়ারম্যান ডা. রমিজ আলীর ছেলে কলেজ ছাত্র রাহেলকে আটক করে। নভেম্বর মাসে মোট ৩৮ জন নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে ২০ জন নারী এবং ১৮ জন মেয়ে শিশু। উক্ত ২০ জন নারীর মধ্যে ৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১২ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১৮ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে পাঁচজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ছয়জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
ইভটিজিং ও নারী নির্যাতনের মতোই দেশে অপ্রতিরোধ্যভাবে চলে আসছে গুপ্তহত্যা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে অপহরণের পর নিখোঁজ হওয়া। গত ৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানা বিএনপি সভাপতি ও করলডেঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে র্যাব সদস্যরা গাজীপুর থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। তিনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ৯ নভেম্বর এলাকাবাসী চট্টগ্রাম র্যাব কার্যালয় ঘেরাও করে। এ সময় র্যাবের লাঠিচার্জে স্থানীয় পত্রিকার সংবাদ কর্মীসহ প্রায় ১৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ৬/৭ জনের মাথা লাঠির আঘাতে ফেটে যায়। নজরুল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করে। এগুলোর সবক’টিতেই তিনি জামিনে আছেন। মামলার কাজে ঢাকায় হাইকোর্টে গিয়েছিলেন তিনি। হাইকোর্টের কাজের ফাঁকে তিনি গাজীপুরে তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় গাজীপুর-জয়দেবপুর বাইপাস রোডের চৌরাস্তা এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী চার থেকে পাঁচজন লোক র্যাব পরিচয় দিয়ে তার নোয়া (মাইক্রোবাস) গাড়ি থেকে জোর করে তাকে অন্য একটি গাড়িতে তুলে নেয়। নজরুল ইসলামের ছোট ভাই হামিদুল হক জানান, তারা বিভিন্ন মাধ্যমে থেকে জানতে পেরেছেন, তার ভাই র্যাব হেফাজতে আছেন। কিন্তু র্যাব তা স্বীকার করছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে আটকের পর অনেকেরই কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভিকটিমদের পরিবারগুলো দাবি করছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই তাদের আটক করে নিয়ে গেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় দলীয় ক্যাডারদের হাতে ইভটিজিং ও নারী নির্যাতন মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্রসফায়ারকেই পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। দেশজুড়ে একের পর এক ক্রসফায়ার চলছেই। এরপরও আইনশৃঙ্খলার কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী নভেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৯ জন নিহত এবং এক হাজার ৩৮০ জন আহত হয়েছেন। চলতি মাসে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ২৬টি এবং বিএনপির ২টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ২ জন নিহত এবং ৪৩৭ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১৬ জন আহত হয়েছেন। এর আগে আগস্ট মাসে নিহত হয়েছিলেন ১২ জন, আহত হয়েছিলেন ৮০০ জন। অক্টোবরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন, আহত হয়েছিলেন ৭৭০ জন।
আইনশৃঙ্খলা অবনতির চরম নজির স্থাপন হয় চলতি বছরের অক্টোবর মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। ২৩ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে ‘আর্মি হাউজিং স্কিম’ নামে সেনাবাহিনীর আবাসন প্রকল্পের জন্যে জমি গ্রহণের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে স্থানীয় জনগণ। এ সময় উত্তেজিত জনতার ওপর গুলি চালানো হলে জনতা হামলা চালিয়ে সেনাবাহিনীর একটি জিপ, দুটি গাড়িসহ কয়েকটি টিনশেড ব্যারাকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় সেনাসদস্য, র্যাব ও পুলিশের গুলিতে ১৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর রূপগঞ্জ থেকে ৪টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। ওইসব ক্যাম্পে থাকা সেনাসদস্যদের হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নেয়া হয়। গত ২৪ অক্টোবর গুলিবিদ্ধ মোস্তফা জামাল হায়দার হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান এবং মাসুদ, সাইফুল ইসলাম ও শমসের নামে তিন যুবক এখনও নিখোঁজ রয়েছেন বলে এলাকার মানুষ অভিযোগ করেন। কেউ কেউ বলছেন, মাসুদ, সাইফুল ইসলাম ও শমসের র্যাবের গুলিতে নিহত হন এবং শান্ত নিজে তাদের লাশ র্যাবের গাড়িতে দেখেছেন। র্যাব সদস্যদের নির্দেশে শান্ত নদী থেকে পানি এনে রাস্তায় জমাটবাঁধা রক্ত ধুয়ে দিয়েছেন বলে জানান। ওই ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাত ৪ হাজার গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় মামলা করেছে। গত ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঢাকা ক্যান্টমেন্টের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩৪ ইউনিটের ওয়ারেন্ট অফিসার আমিনুর রহমান বাদী হয়ে ৫০ থেকে ৬০ জন অজ্ঞাত গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় আরেকটি মামলা করেছেন। এসব ঘটনায় এখনও ক্ষোভের আগুন জ্বলছে রূপগঞ্জে।
গত ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া-১ আসনের আওয়ামী লীগদলীয় এমপি আফাজউদ্দিন আহম্মেদের বাড়িতে বোমার বিস্ফোরণে ৩ জন নিহত হয়েছেন। বোমা বিস্ফোরণের আগে কয়েকজনের উপস্থিতিতে সংসদ সদস্য আফাজউদ্দিন আহম্মেদের বাড়িতে দৌলতপুর উপজেলার তারগুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যলয় ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভা চলছিল। বৈঠকের একপর্যায়ে সংসদ সদস্য ও তার ছেলে আরিফ আহম্মেদ পাশের একটি ঘরে যান। ঠিক এই সময়ে কোমরে গামছাবাঁধা লুঙ্গিপরা তিন যুবক সেখানে প্রবেশ করে। তাদের একজন আহাদুল সোফায় বসামাত্রই একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে তারগুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশমত উল্লাহ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী সিদ্দিক হোসেন এবং বোমা বহনকারী আহাদুল নিহত হন। এ ঘটনায় ওবায়দুল হক নামে এক শিক্ষক আহত হন। সংসদ সদস্য আফাজউদ্দিন আহম্মেদ কোনো আঘাত পাননি। ১৪ নভেম্বর বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ দৌলতপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদ হোসেনকে এবং গত ১৯ নভেম্বর এই মামলার অন্যতম আসামি মরুকে গ্রেফতার করে। পরে জানা গেছে, আভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলের জের হিসেবে ওই বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।
গত ১৭ নভেম্বর ঈদুল আজহার দিন বাসার সামনে সন্ত্রাসীদের মদপান করতে নিষেধ করায় রাজনৈতিক পরিচয়বহনকারী একদল দুর্বৃত্ত ঢাকার বাসাবো এলাকায় এক ব্যাংক কর্মকর্তা মাহফুজুল হক খানের ওপর হামলা করে। এতে তার মৃত্যু হয়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করায় তার বাড়ি ঘেরাও করে আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা। এতে মাহফুজুল হক খানের পরিবার আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। তারা জানায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রশ্রয়ে দৃর্বৃত্তরা তাদের হুমকি দিচ্ছে। তারা সাবের হোসেন চৌধুরীকে আসামি করে মামলাও করেছেন।
সন্ত্রাসী হামলা থেকে নিরাপদ নন দেশের বিচারপতিরাও। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের মতো নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা সংবেদনশীল এলাকাতেও বোমার বিস্ফোরণ হয়েছে। এর আগে হামলা হয়েছিল আওয়ামী লীগ এমপি ফজলে নূর তাপসের ওপর। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বিরোধী দলের কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে যাতে তারা জামিন নিতে না পারেন সেজন্য পুলিশি পাহারাও বসানো হয়েছে হাইকোর্ট চত্বরে। ফজলে নূর তাপসকে লক্ষ্য করে বোমা হামলার মামলায় মেহনাজ রশীদ ও ফ্রিডম পার্টির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। দফায় দফায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। পরে জানা যায়, ওই মামলায় তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ৫ সেনা কর্মকর্তাকে ওই মামলায় গ্রেফতার করে সামরিক আইনে সাজা দেয়া হয়েছে।
দেশজুড়ে অসংখ্য সহিংস ঘটনা ঘটছে। এগুলোর ক্ষুদ্র একটি অংশই মিডিয়ায় আসছে। প্রতিকার না পাওয়ায় ভুক্তভোগী বহু মানুষ থানা-পুলিশের কাছেও যেতে চান না। প্রতিদিন দেশে এত বেশি হত্যা, সংঘর্ষ, ডাকাতি, অপহরণের ঘটনা হচ্ছে যে তা শুধু পিলে চমকানো ব্যাপার নয়, রীতিমতো উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও আতঙ্কেরও বড় কারণ। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, আমি-আপনি কারও জীবনই এখন আর নিরাপদ নয়! আপনি-আমি কারোরই নিরাপদে কর্মস্থলে যাওয়া বা কর্মস্থল থেকে নিরাপদে বাড়ি ফেরার গ্যারান্টি পর্যন্ত নেই।
শাসকদলের সুবিধাভোগী নেতাকর্মীদের এই বেপরোয়া আচরণের কারণেই দেশের আইনশৃঙ্খলার এই পরিস্থিতি বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। দলীয় গুণ্ডাবাহিনীর হাতে প্রতিনিয়তই নিজ দলের নেতারাও খুন, জখম ও হামলার শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে পুলিশ সম্প্রতি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ধস নেমেছে। প্রতিটি ঘটনাকে একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ধরে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মন্তব্য করলেও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে বলেই সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি ও ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে হানাহানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অশান্ত হয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া, অস্ত্রবাজির অনেক ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ছাত্রলীগ কর্মীদের একটি ঘটনা সামাল দিতে না দিতেই আরেকটি ভয়াবহ ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এই বাহিনীর মধ্যে দলবাজির আছর পড়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন দলের অপরাধীদের বিরুদ্ধে দলীয় নেতারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকারের নীতিনির্ধারক ও মন্ত্রীরা যে বক্তব্য দিচ্ছেন বাস্তবে তা প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কিছুদিন আগে পাবনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষায় স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলার পাশাপাশি সারাদেশে সরকার সমর্থিত লোকদের সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর রিপোর্টে বলা হয়, এতে প্রশাসনের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসবে। এর পরও ওইসব গুণ্ডাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
গত ৫ অক্টোবর একটি অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজি ও দখলবাজির মতো বিভিন্ন ধরনের বাজির রকমফের দেখে দেশের মানুষ দিশেহারা।
এদিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও র্যাব-পুলিশের ভূমিকা, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছিলেন, দেশ এভাবে চলতে পারে না। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশকে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পরিচালিত হতে দেয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলার অবনতি প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, এমনটি বলা যাবে না। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু খুনখারাবি হয়েছে

No comments:

Post a Comment