Monday 6 December 2010

ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে কেউ আইনের আশ্রয় নেয়নি : নগরীতে যুবলীগ-ছাত্রলীগ পরিচয়ে কোরবানির পশুর চামড়া ছিনতাই

শামসুস সালেহীন

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়া ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী পরিচয়ে একটি চক্র কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে গেছে। পরে খামে ভরে নামমাত্র মূল্য ধরে টাকা পাঠিয়েছে তারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি, র্যাবের ডিজি এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কঠোর নির্দেশ থাকার পরও নগরীতে চামড়া ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এলাকার যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে ঈদের আগের রাতেই এলাকায় যারা কোরবানি দেবেন তাদেরকে এ বিষয়ে বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, কোরবানির পশুর চামড়া তারা কিনবেন, বাইরে বিক্রি করা চলবে না।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা দীন মোহাম্মদ মল্লিক বলেছেন, কোরবানির পশুর চামড়া মহল্লার নেতাদের হাতেই তুলে দিতে হয়েছে। এলাকায় যারা কোরবানি দেবেন তাদেরকে নেতারা আগেই বলে রেখেছিলেন। তাদের নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য ছিল না কারোই। ফলে দরদাম করে চামড়া বেচার সুযোগ হয়নি। তিনি আরও জানান, র্যাব-পুলিশের টহল দলের কাছে বা থানায় এ বিষয় নিয়ে কেউই কোনো অভিযোগ করেননি। মহল্লার নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে, এই ভয়ে এলাকার কেউই ঝুঁকি নেননি।
মুগদাপাড়া এলাকার একটি গলিতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা ঈদের দিন কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে স্তূপ করেছেন। এলাকাবাসী জানান, এলাকার কোন বাসায় কয়টি গরু বা ছাগল কোরবানি হচ্ছে তার তালিকা আগেই করেছেন ওই নেতা। তালিকা ধরে বাসায় বাসায় গিয়ে চামড়া কেনার অনুরোধ জানিয়ে আসেন। এরপর প্রতিটি বাসা থেকে গুনে গুনে কোরবানির পশুর চামড়া কর্মীদের দিয়ে এনে স্তূপ করেন। পরে ওই চামড়া পোস্তায় নিয়ে বিক্রি করে নিজের ইচ্ছেমতো নামমাত্র মূল্য পাঠিয়ে দেন।
ফয়সাল আলম একজন ব্যবসায়ী। তিনি শাহজাহানপুরের বাসিন্দা। তিনি জানান, চামড়া নিয়ে এলাকা পর্যায়ের হরিলুট বন্ধ করার সাধ্য কারো নেই। এটা হয় নীরবে এবং অতিগোপনে। এলাকার ঘরে ঘরে কোরবানির পশুর চামড়া দেয়ার আগাম নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফলে কোরবানির পশুর চামড়া অন্য কোথাও নিজের ইচ্ছেমতো বিক্রি করার সাধ্য ছিলো না কারোই। ওই এলাকার বাসিন্দা নজরুল আমিন জানান, একটি গরু এবং একটি খাসি কোরবানি দিয়েছেন তিনি। আগের রাতেই এলাকার কয়েকজন যুবলীগ নেতা পরিচয়ে বাসায় এসে চামড়া তাদের কাছে বিক্রি করতে বলেন। কোরবানি করার সময় ওই নেতারা বাসায় আসে। চামড়া ছাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দু’টি চামড়া তারা নিয়ে যায়। রাতে একটি খামে করে নামমাত্র মূল্য পাঠিয়ে দেয় তারা। এলাকার ছেলে বলে তাদের কিছুই বলার সাহস হয়নি। তার ওপর ওই ছেলেরা সরকারি দলের নেতা, এ কারণে এলাকার কেউই তাদের ওপর কোনো কথা বলার সাহস রাখে না বলে নজরুল আমিন জানান।
নগরীর মগবাজার এলাকার এক যুবলীগ নেতাও এলাকাবাসীর কাছ থেকে কোরবানির পশুর চামড়া কিনেছেন। এলাকার বাসিন্দা নিজাম মিয়া জানান, ওই নেতা এলাকার বাসিন্দাদের আগের দিন অনুরোধ করে বলেছেন, চামড়া বাইরে বিক্রি না করে তার কাছে বিক্রি করতে। এ কারণে কেউই পশুর চামড়া অন্য কোথাও বিক্রি করার সাহস পায়নি। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী র্যাব-পুলিশের কাছেও অভিযোগ করেনি। কারণ, ওই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এলাকায় থাকাটাই বিপজ্জনক হবে বলে নিজাম মিয়া জানান।
ধলপুর এলাকায় নামমাত্র মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া কিনেছেন এলাকার যুবলীগের নেতাকর্মীরা। চামড়া কেনার জন্য মতদ্বৈধতার কারণে যুবলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। দুই গ্রুপের নির্দেশ—তাদেরকেই চামড়া দিতে হবে। এনিয়ে এলাকার বাসিন্দারা পড়েন বেকায়দায়। এলাকার বাসিন্দা জামিরুল হক, নাসিরউদ্দিন ও আবুল কালাম জানান, ঈদের আগের রাতে এক গ্রুপ বাসায় বাসায় গিয়ে চামড়া তাদের জন্য রাখতে নির্দেশ দিয়ে আসে। কিন্তু ঈদের দিন সকালে অপর গ্রুপটি বাসায় বাসায় হাজির হয়ে কোরবানির পশু টার্গেট করে দাঁড়ায়। ফলে কোরবানিদাতারা পড়েন বিপাকে। এলাকার মানুষ কোরবানির পর চামড়া বিনা পয়সায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগকারীরা জানান। তারা বলেছেন, র্যাব-পুলিশের সহায়তা নেয়ার অর্থই হলো স্থায়ীভাবে শত্রুতা কেনা। এ কারণে এলাকার কেউই আইনের আশ্রয় নেননি বলে জানান।
নগরীর উত্তর কমলাপুর, গাবতলী বড়বাগ বাজার, যাত্রাবাড়ী ছনটেক, ডেমরা, কামরাঙ্গীর চর, উত্তরার আশকোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়া ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলাকার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পরিচয়ে নামমাত্র মূল্যে চামড়া ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে বলে এলাকাবাসী জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, র্যাবের ডিজি মোখলেছুর রহমান এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ পৃথকভাবে ঈদের আগে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সভা করেছেন। সভায় তারা সবাই বলেছেন, ঈদে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে কোনো অঘটন ঘটতে দেয়া হবে না। এজন্য র্যাব-পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

No comments:

Post a Comment