Thursday 2 December 2010

অধিকারের মাসিক রিপোর্ট : খালাস পেয়েও হযরত আলী একযুগ কারাগারে : গত মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যা ১৪, বিএসএফের হাতে নিহত ৭, রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৯, ধর্ষিত ৩৮

স্টাফ রিপোর্টার
খালাস পেয়েও দীর্ঘ এক যুগ কারাগারে আটক আছেন সাভারের ফিরিঙ্গীকান্দা এলাকার হযরত আলী। ১৯৯৮ সালে গ্রেফতার হয়ে এখন পর্যন্ত তিনি কারাগারে আছেন বলে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের নভেম্বর মাসের প্রতিবেদনে জানিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ১৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ নিরীহ বাংলাদেশী। সাংবাদিক আহত হয়েছেন ৩৮ জন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৪ নারী। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৮ জন। যৌতুকের কারণে সহিংসতার শিকার ২৬ জন। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে মারা গেছে ৩ কিশোরী। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন। এছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান বিলম্বিত হওয়ায় অধিকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অধিকার জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক হাজতি নং ১৮৩৪৫/১০ ঢাকার সাভার থানাধীন ফিরিঙ্গীকান্দার বাহেরচর নিবাসী সুমন আলীর ছেলে হযরত আলীকে কেরানীগঞ্জ থানার ৬২(৬)৯৮ নম্বর মামলায় পুলিশ ১৯৯৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে। সেদিন থেকে হযরত আলী আজ পর্যন্ত এ কারাগারে বন্দি আছেন। দীর্ঘ ১২ বছরে কখনোই তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। গত ২৪ আগস্ট হযরত আলী তার বিষয়টি মীমাংসার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারের মাধ্যমে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করেন। হযরত আলীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার মামলাটি কোথায় কী অবস্থায় আছে, তা জানার জন্যে তল্লাশি শুরু হয়। বেশ কয়েকটি কোর্টে তল্লাশির পর দেখা যায়, ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট শাহিনের আদালতে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং এতে হযরত আলীকে খালাস দেয়া হয়েছে। এর পরও জেল কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে আটক করে রাখে।
অধিকার জানায়, এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটছে, কিন্তু ঘটনার জন্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না ভুক্তভোগী ব্যক্তিও কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। অবিলম্বে এ ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যে সরকারের প্রতি দাবি জানায় অধিকার।
গত মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নিহত ১৪ জনের মধ্যে র্যাবের হাতে ১০ জন এবং পুলিশের হাতে ৪ জন নিহত হন। এই বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১০ জন ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নির্যাতনে মৃত্যু ও মিথ্যা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট : গত ১৪ নভেম্বর নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের হেফাজতে শরীফ মিয়া (২৩) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। শরীফ মিয়ার মা অভিযোগ করেন, তার ছেলে ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। সে ছিল তাঁত শ্রমিক। তাকে থানা হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, শরীফ মিয়ার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তিনি আরও বলেন, তার সামনেই তার ছেলেকে থানায় নেয়ার আগে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। গত ২২ নভেম্বর যশোরের কোতোয়ালি থানা হেফাজতে ইমরান হোসেন বাপ্পী নামে এক যুবক মারা গেছেন। পুলিশের দাবি, বাপ্পী ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। নিহতের বাবা আলী হোসেন অভিযোগ করেন, কোনো কারণ ছাড়াই কোতোয়ালি থানার এসআই আবদুর রহমান তার ছেলেকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরে পুলিশ তার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকার করায় এসআই আবদুর রহমান বাপ্পীকে বেদম মারধরের পর হিরোইন ব্যবসায়ী হিসেবে প্রচার করে। নির্যাতনের একপর্যায়ে এসআই আবদুর রহমান বাপ্পীর মাথা দেয়ালের সঙ্গে ঠুকে দিলে তার মাথা ফেটে যায়। নির্যাতনে বাপ্পী মারা গেলেও পুলিশ তা আত্মহত্যা বলে প্রচার করছে।
গত ২৯ জুন সিএনজি অটোরিকশা চালক বাবুল গাজী পুলিশ হেফাজতে মারা যান। পুলিশ জানায়, পুলিশের গাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি মারা যান। নিহতের পরিবার অভিযোগ করে, র্যাব বাবুল গাজীর কাছ থেকে দুটি অটোরিকশা উদ্ধার এবং তার কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করে। কিন্তু তিনি মাত্র ৭০ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারেন। পুরো ২ লাখ টাকা না দেয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ময়নাতদন্তকারী ডা. প্রদীপ বিশ্বাস বাবুল গাজীর মৃত্যুর ঘটনাকে দুর্ঘটনাজনিত বলে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেন। কিন্তু হাইকোর্টের কাছে ওই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। এরপর হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ ময়নাতদন্ত রিপোর্টের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এর প্রেক্ষিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ তিন সদস্যের ফরেনসিক সায়েন্স এক্সপার্ট কমিটি গঠন করেন। বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলে, বাবুল গাজীর মৃত্যুর ঘটনা হত্যা প্রকৃতির। কিন্তু ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এ মৃত্যুর ঘটনাকে দুর্ঘটনাজনিত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা সঠিক নয়। এই প্রতিবেদনের পর সম্প্রতি ময়নাতদন্তকারী ডা. প্রদীপ বিশ্বাস স্বীকার করেন, বাবুল গাজীর শরীরে যে জখমের চিহ্নগুলো ছিল তা হত্যাজনিত কারণে হয়েছে।
অধিকার জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের ময়নাতদন্তগুলো সম্পন্ন হচ্ছে প্রভাবান্বিত হয়ে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ময়নাতদন্তের দায়িত্বপালনকারী কিছু অসত্ ডাক্তার। এর ফলে নির্যাতনে নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ বলা হচ্ছে অসুস্থতা, আত্মহত্যা অথবা দুর্ঘটনাজনিত। আর এই মিথ্যা ময়নাতদন্ত রিপোর্টের কারণে হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।
সহিংসতা অব্যাহত : অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৯ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩৮০ জন আহত হয়েছেন। চলতি মাসে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ২৬টি এবং বিএনপির ২টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ২ জন নিহত এবং ৪৩৭ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির আভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১৬ জন আহত হয়েছেন।
সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত : প্রতিবাদ ও প্রতিশ্রুতির পরও বিএসএফ সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রেখেছে। গত ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের জামালপুর সীমান্তের কাছে কয়েকজন কৃষক ঘাস কাটতে যান। এসময় ভারতের নাসিরাপাড়া ৯০ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে কৃষক মুক্তার হোসেন (৩০) নিহত হন। ১৩ সাতক্ষীরার চান্দুরিয়া সীমান্তে গত ১২ নভেম্বর বিএসএফ বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ী ইশার আলী মল্লিকের দুই কান কাটার পর প্লাস দিয়ে তার নাকও উপড়ে ফেলে।
গত ১৫ নভেম্বর সাতক্ষীরার ভোমরা ইমিগ্রেশন অফিসে ভারতের জিরো পয়েন্টে বিএসএফের নির্যাতনে এক বাংলাদেশীর মৃত্যু ও তার স্ত্রী ধর্ষিত হন। এ ঘটনায় বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে এক পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে জবানবন্দি দেন।
গত ২৩ এপ্রিল সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা সীমান্তের বিপরীতে ভারতের ঘোষডাঙ্গা জেলাপাড়ায় ভারত থেকে চিকিত্সা নিয়ে দেশে ফিরে আসার পথে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ধলবাড়িয়া গ্রামের এক গৃহবধূকে বিএসএফ সদস্যরা ধর্ষণ করে। ধর্ষণে বাধা দেয়ায় তার স্বামী রবীন্দ্রনাথ মণ্ডলকে (৪২) বিএসএফ সদস্যরা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে।
অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে বিএসএফ ৭ বাংলাদেশীকে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে ৫ জনকে এবং ২ জনকে নির্যাতন করে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সময়কালে অপহৃত হয় ২ জন।
সাংবাদিকের ওপর হামলা : দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকার সাতকানিয়া প্রতিনিধি রাজা মিয়াকে একটি সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সাতকানিয়া থানার এসআই শ্রীকান্ত সদরবাজারে প্রকাশ্যে কিলঘুসি মেরে শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যান। রাজা মিয়া জানান, থানা পুলিশের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বীর চট্টগ্রাম মঞ্চে তার লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সাতকানিয়া থানার ওসি আবদুল লতিফ ক্ষুব্ধ হন এবং এসআই শ্রীকান্তকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। গত ১৪ ও ৩০ নভেম্বর বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালে অনেক সাংবাদিক পুলিশি হয়রানির শিকার হন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করার কারণে সাংবাদিকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলার ঘটনায় অধিকার উদ্বেগ প্রকাশ করছে। নভেম্বরে সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সময়ে ৩২ সাংবাদিক আহত, ৩ জন হুমকির সম্মুখীন, ২ জন লাঞ্ছিত হন এবং এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন করায় চাকরিচ্যুতি : ট্রেড ইউনিয়ন করার অপরাধে খুলনার হিমায়িত চিংড়ি শিল্পের ৯৫ শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গত আগস্টের ১১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এদের মৌখিকভাবে চাকুরিচ্যুত করা হয়। শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী নিয়োগপত্র, সার্ভিস বুক, ন্যায্য মজুরি ও পরিচয়পত্র পাওয়ার দাবিতে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। এতে চিংড়ি শিল্পের মালিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে কোনো লিখিত নোটিশ বা চিঠি না দিয়েই বেআইনিভাবে শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করেন।

No comments:

Post a Comment