Friday 17 December 2010

অধিকার ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আলোচনা : প্রতি চারদিনে একজন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করছে বিএসএফ



স্টাফ রিপোর্টার

ভারতের বিএসএফ প্রতি চারদিনে একজন বাংলাদেশীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করছে। সীমান্ত এলাকায় লাখ লাখ বাংলাদেশীর প্রতিটি দিন কাটে আতঙ্কে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আয়ো-জিত আলোচনায় বক্তারা একথা বলেন। আলো-চনার আগে বিএসএফের গুলিতে নিহত এবং তাদের হাতে নির্যাতিত বাংলাদেশীদের নিয়ে চ্যানেল-ফোরে প্রচারিত ৪ মিনিটের একটি প্রতিবেদন দেখানো হয়।
অধিকার এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের যৌথ প্রকাশনা ‘ট্রিগার হ্যাপি : এক্সিসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় বক্তারা বলেন, ইসরা-ইলের গাজা সীমান্তের চেয়ে ভয়ঙ্কর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। গাজায় যুদ্ধের সময়ও জনসাধারণকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় না। অথচ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা বাসিন্দাদের বিএসএফ নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সরকারগুলো ব্যক্তিত্বহীন, কাপুরুষ, অথর্ব ও ভাবলেশহীন। বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা করছে, গরু-মহিষ ও মাছ নিয়ে যাচ্ছে, অথচ সরকার এসব ব্যাপারে নির্বিকার। সরকারের উচিত বিরোধী দলসহ একটি জাতীয় কনভেনশন করে বিএসএফের বাংলাদেশী হত্যার প্রতিবাদ করা। এখনই বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালতে দাবি তুলতে হবে। বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরকালেও সীমান্তে বাংলাদেশীকে নির্বিচারে হত্যা করেছে বিএসএফ।
বক্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, সীমান্তের মানুষ কাকে ভোট দিয়েছিল। এর কি একটুও দায়বদ্ধতা নেই? তার ওপর এখন বলা হচ্ছে, আমাদের নাকি ট্রানজিট দেয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে। এটা দিয়েও কি সীমান্তে মানবাধিকার রক্ষা করা গেছে। আজও (গতকাল) সাতক্ষীরা সীমান্তে এক বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ভারতে বানরকে গুলি করার অপরাধে এক চিত্রনায়ককে সাজা দেয়ার কথা উল্লেখ করে এক বক্তা বলেন, ভারতের কাছে বাংলাদেশী মানুষের দাম বানরের চেয়ে কম। তারা আবার জোর গলায় মানবাধিকারের কথা বলে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে।
‘ট্রিগার হ্যাপি : এক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস ইন দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ নামের ৮১ পৃষ্ঠার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নির্বিচারে বলপ্রয়োগ, নির্যাতন, আটক করা ও হত্যাসহ অসংখ্য প্রমাণ পেয়েছে অধিকার এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। প্রতিবেদনে ভারত সরকারের প্রতি দায়মুক্তি ব্যবস্থা বাতিল করে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী বিএসএফ সৈন্যদের বিচার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, বিএসএফ নিয়ন্ত্রণহীন। সন্দেহজনক যে কারও ওপর গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের। তারা নির্দোষ থাকার ন্যূনতম সম্ভাবনার বিষয়টিও আমলে না নিয়ে সবচেয়ে মৌলিক অধিকার সংশ্লিষ্ট আইন লঙ্ঘন করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব হলো, সীমান্তের অপরাধ দমন করা। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রায়ই অত্যন্ত দরিদ্র ও নিরীহ কৃষক বা শ্রমিকরা হত্যা এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন বিশ্বাস চলতি বছরের মার্চে বিএসএফের গুলিতে সন্দেহভাজন গরু পাচারকারী হিসেবে তার ভাতিজা হত্যার বিষয়টি বর্ণনা করে বলেছেন, ‘আমি লাশ দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ি থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে পড়েছিল। সেখানে বেশ কয়েকজন পুলিশ ও রাজনীতিবিদ জড়ো হয়েছিলেন। সে যখন চিত্ হয়ে শুয়েছিল, তখন বিএসএফ তাকে গুলি করে। তারা তার কপালে গুলি করেছিল এবং বুলেট মাথা ভেদ করে মাটির কয়েক ইঞ্চি গভীরে ঢুকে পড়েছিল। সে যদি দৌড়াত, তবে গুলি লাগত তার পিঠে। তারা (বিএসএফ) স্রেফ তাকে হত্যা করেছে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত নওগাঁর সাপাহার উপজেলার কৃষক ফারুক হোসেন। যুবক ফারুক জানান, ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি তারা মাঠে কাজ করছিলেন। সীমান্তে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অনেক ভেতরের ওই মাঠে আসে বিএসএফ সদস্যরা। তারা মদ্যপ ছিল। পাশের নদীর জেলেদের কাছে মাছ চেয়ে না পেয়ে তারা ক্ষুব্ধ হয়। তারা মাঠে এসে কৃষকদের লক্ষ্য করে অতর্কিতে গুলি ছোড়ে। ফারুকের পায়ে গুলি বিদ্ধ হয়।
বিএসএফের গুলিতে নিহত ১৫ বছরের কিশোর আবদুর রাকিবের পিতা আবদুস সামাদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেশি-বিদেশি মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তাদের উদ্দেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার কিশোর ছেলে হত্যার বর্ণনা দেন। আবদুস সামাদ জানান, তার বাড়ি নওগাঁর সাপাহার উপজেলায়। তার ছেলে রাকিব সকালে মহিষ চরাতে বাড়ির পাশের মাঠে যায়। বিএসএফ ওপার থেকে রাকিবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বিএসএফ এসে তার ছেলের লাশের পা ধরে টেনে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যায়। তারা আবদুস সামাদের প্রায় ৬০ হাজার টাকা মূল্যের মহিষটিও নিয়ে গেছে। দুপুর ১২টায় দিনেদুপুরে এ ঘটনা ঘটে বলে তিনি জানান। নিহত রাকিব তার ছোট ছেলে। বড় ছেলেও কৃষিকাজ করে।
‘ট্রিগার হ্যাপি : এক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস ইন দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে বিএসএফ নয় শতাধিক বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশী নাগরিকরা সীমান্তের ভেতর থেকেই বিএসএফের নির্বিচার গুলির শিকার হয়ে আহত বা নিহত হয়েছেন। ভারত সরকার বাংলাদেশের ভেতরে থেকেই অনুপ্রবেশ রোধে সীমান্তের খুব কাছে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। ফলে এর পাশেই যাদের জমি রয়েছে, তারা সেখানে যেতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এতে করে সীমান্তের অধিবাসীদের জীবনে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে। অনুসন্ধানকারীদের কাছে অধিবাসীরা অভিযোগ করেছেন, বিএসএফ প্রায়ই তাদের ভীতি প্রদর্শন, গালিগালাজ ও মানবেতরভাবে প্রহার করে থাকে। সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কাজ হলো, অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা। কিন্তু তারা স্থানীয় অধিবাসীদের যেভাবে হত্যা ও নির্যাতন করেছে, তাতে মনে হয় তারা যেন যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছে।
অধিকার এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএসএফের হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত ৩ ছেলের পিতা কৃষ্ণচন্দ্র মণ্ডল বলেন, সন্দেহভাজনরা পালিয়ে যাওয়ায় বিএসএফ সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েছিল। তারা ৩ ছেলেকে ঘেরাও করে কোনো কারণ না বলেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেটাতে, লাথি ও চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে। সৈন্যরা ছিল নয়জন। তারা আমার ছেলেদের নির্দয়ভাবে পেটায়। এমনকি ছেলেরা মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরও বিএসএফ সদস্যরা নির্মমভাবে তাদের বুক ও অন্য স্পর্শকাতর স্থানে লাথি মারতে থাকে।
নগরীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উপ-পরিচালক (এশিয়া) ফিল রবার্টসন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, অধিকারের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান, নরওয়েজিয়ান দূতাবাসের প্রতিনিধি শায়লা, আল-জাজিরা টিভির তানভীর, মো. আশ্রাফুজ্জামান, সাইফুল হক প্রমুখ। বক্তারা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান।

No comments:

Post a Comment