Tuesday 7 December 2010

এবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ক্ষমতাসীনদের তাণ্ডব

হাসান শান্তনু

তালিকা অনুযায়ী দলীয় লোকদের চিকিত্সক হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য করতে পাবনাসহ দেশের অন্য এলাকার মতো এবার ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বাচিপ ও বিএমএ নেতারা গতকাল তুলকালাম কাণ্ড ঘটান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। ‘চিকিত্সা কর্মকর্তা’ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় দলীয় প্রার্থীরা পাস না করায় তারা বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাকে কিছুক্ষণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। শুক্রবার অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরদিন গতকাল দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ও সমর্থক সংগঠনের নেতাকর্মীদের মারমুখী আচরণ, হট্টগোলে হাসপাতালের রোগী, তাদের অভিভাবক, দর্শনার্থীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় র্যাব, পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চিকিত্সকের ৭০টি পদের বিপরীতে মন্ত্রী, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, স্বাচিপ ও বিএমএ নেতাদের কাছ থেকে তদবির আসে ৪০০ প্রার্থীর পক্ষে। তদবিরের তালিকা থেকে বাদ পড়া প্রার্থীরা এ কাণ্ড ঘটান বলে বিএসএমএমইউ সূত্র জানায়।
জানা যায়, গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত একাডেমিক কাউন্সিলের সভা শেষ হয় বেলা সাড়ে ১২টায়। সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিলন হলের সামনে এলে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তকে ঘিরে ধরেন প্রায় ৫০ জনের একটি দল। তালিকা অনুযায়ী কেন দলের লোকদের নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করানো হয়নি, তারা তা উপাচার্যের কাছে জানতে চান। তারা উপাচার্যের কাছে নিজেদের পরিচয় দেন ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা, স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ) ও বিএমএ’র (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) সদস্য বলে। উপাচার্যের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে নেতারা উপাচার্যের ওপর চড়াও হন। তাকে গালাগাল করেন। তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন বলেও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী আমার দেশকে জানান। খবর পেয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর পুলিশ এলে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়। এ সময় র্যাব, পুলিশের পাহারায় ডা. প্রাণ গোপাল নিজের কক্ষে চলে যান। এ সময় ভিসির কক্ষের সামনে পুলিশ পাহারা ছিল। পুলিশের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, ভিসিকে কিছুক্ষণ ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল এবং ঘেরাওকারীরা তাকে ধাক্কাও দেয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপালের বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আমার দেশ-এর কাছে তিনি ঘটনা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘একাডেমিক কাউন্সিলের সভা শেষে কক্ষ থেকে বের হয়ে ৫০ থেকে ৬০ জনের জটলা দেখি। কি হয়েছে বা কিছু বলবেন কি-না জানতে চাইলে তারা স্বাচিপ ও বিএমএ মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান। এ দুই সংগঠনের মহাসচিব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য। তারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। আমার সঙ্গে কারও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যের সত্যতা জানতে দুপুর ২টায় মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি লাঞ্ছিত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। উল্লেখ্য, আমার দেশ-এর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার সময় ডা. প্রাণ গোপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন না। একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য তিনি তখন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ছিলেন। পুলিশ পাহারায় দুপুর ১টায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সেখানে যান বলে জানা যায়। যোগাযোগ করা হলে বিএমএ মহসচিব অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, ‘নিয়োগ পরীক্ষায় যারা পাস করতে পারেননি, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। উপাচার্যকে তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিছুক্ষণের জন্য অবরুদ্ধ করেন। তবে বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাবুল জানান, বিক্ষুব্ধরা উপাচার্যকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন প্রথমে। এরপর তার জামার কলার চেপে ধরেন। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে বাবুলের আত্মীয় মজিবুল হক চিকিত্সাধীন। গতকাল তাকে দেখতে তিনি হাসপাতালে আসেন।
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিন পর এক সভায় বলেন, এ চিকিত্সা কেন্দ্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় রাখা হবে। তাছাড়া তিনি স্বাচিপের মনোনীত প্রার্থী হওয়ায় সরকার তাকে এ পদে নিয়োগ দেয়। রাজনৈতিকভাবে তিনি আওয়ামী লীগের অনুগত। গত ২৭ জুন হরতাল চলাচালে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং স্বাচিপ সদস্যরা বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেন। এ ঘটনার পর ডা. প্রাণ গোপাল সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। তিনিও এবার রেহাই না পাওয়ায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দেশের একমাত্র এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ঘটছে। একদিকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় অভিজ্ঞ চিকিত্সকদের বরখাস্ত করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ৭০টি পদে দলীয় ও পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ৪০০ জনের তালিকা এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে উপাচার্যের কাছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের তিন নেতার তিনটি তালিকায় আছে ৭০ যুবলীগ চিকিত্সকের জন্য তদবির। এক মন্ত্রী পাঠিয়েছেন ৬০ জনের নামের তালিকা; যার মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা আছেন ২০ জন। এছাড়া সরকার সমর্থক চিকিত্সকদের সংগঠন স্বাচিপ ও বিএমএ নেতাদের আছে ২০০ প্রার্থীর নিয়োগের জন্য সুপারিশ রয়েছে। জানতে চাইলে উপাচার্য ডা. প্রাণ গোপাল তালিকার বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘নিয়োগ দেয়া হবে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে। প্রার্থীর দেয়া তথ্য যাচাই করা হবে। বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) নিবন্ধন আছে কি-না, অন্য কোথাও চাকরি করছেন কি-না, এসব বিষয়ে খোঁজ নেয়া হবে। এরপরে অক্টোবরের মাঝামাঝি প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হবে।’
তথ্যমতে, এ চিকিত্সা কেন্দ্রের বিভিন্ন বিভাগে চিকিত্সক নিয়োগের জন্য গত শুক্রবার সকাল ১০টায় প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। ৭০টি শূন্য পদে নিয়োগের জন্য এ পরীক্ষা নেয়া হয়। তাতে অংশ নেন ৬০০-এর বেশি প্রার্থী। তাদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে পাস করেন ২০৭ জন। পাস করা প্রার্থীর নামের তালিকা শুক্রবার পরীক্ষা নেয়ার এক ঘণ্টা পরই প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে দলীয় লোকদের নিয়োগ নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরে একাধিকবার একইরকম ঘটনা ঘটে। তাতে সরকার সমর্থক কর্মকর্তা, চিকিত্সক নেতারা লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হন। সহকারী সার্জন পদে স্বাচিপ সদস্যরা বাদ পড়ায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গত ৩১ মে। ওইদিন চূড়ান্তভাবে মনোনীত ৩ হাজার ৫৫১ সহকারী সার্জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বাদ পড়া স্বাচিপ সদস্যরা ওইদিন এ চিকিত্সা কেন্দ্রের চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমদ ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের কক্ষে ঢুকে চেয়ার, টেবিল, দরজা, জানালা ভাংচুর করেন। তারা সেদিন ডা. ইকবাল আর্সলানকে প্রায় তিন ঘণ্টা তার কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখেন। গত জুলাইয়ে চিকিত্সক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিয়ে ঘটে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাচিপ ও বিএমএ নেতাদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা। এর জের ধরে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত সপ্তাহে যশোর, পঞ্চগড়, পটুয়াখালীতে স্বাস্থ্য বিভাগে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পদে নিয়োগ পরীক্ষায় দলীয় লোকেরা পাস না করায় সেসব জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ভাংচুর, লুটপাট, পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র ছিনতাই করেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতারা।

No comments:

Post a Comment