Friday 17 December 2010

গার্মেন্টে আগুন : নিহত ৩০ : আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের কারখানার ৩টি ফ্লোর পুড়ে গেছে



আলাউদ্দিন আরিফ ও নজমুল হুদা শাহীন

এবার ভয়াবহ আগুনে জীবন দিতে হলো প্রায় অর্ধশত গার্মেন্ট শ্রমিককে। অধিকার আদায়ের সংগ্রামকালে চট্টগ্রামে পুলিশের গুলিতে তিন শ্রমিক নিহত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটল আরেক ট্র্যাজেডি। রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার নরসিংহপুরে এফবিসিসিআই সভাপিত এ কে আজাদের মালিকানাধীন হা-মীম গ্রুপের ১১ তলা গার্মেন্ট ভবনে গতকাল দুপুরে এ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে পুড়ে গেছে ১১ তলা ভবনের ৩টি ফ্লোর। নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। তবে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ৩০টি লাশ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮টি লাশ আনা হয়েছে। হাসপাতালে মারা গেছে আরও একজন। অন্য লাশগুলো সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে রয়েছে। ভবনের ১১ তলায় আরও কিছু লাশ থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুড়ে কয়লা হয়ে যেতে পারে বেশ কিছু লাশ। সেখানে ক্যান্টিনে কয়েকশ’ শ্রমিক ছিল বলে তাদের সহকর্মীরা মিডিয়াকে জানিয়েছেন। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জোর দিয়ে বলেছেন
কারখানা শ্রমিকরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মৃতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে যাবে। তবে সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর কড়াকড়িতে হতাহতের স্বজনরা ভেতরে ঢুকতে বা উদ্ধার কাজে সহায়তা করতে পারছেন না। রাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ মোট ২২টি লাশ উদ্ধারের কথা জানান।
অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন ৫ শতাধিক শ্রমিক। নিহতদের অধিকাংশই আতঙ্কে লাফিয়ে অথবা আটকা পড়ে নির্মম পরিণতির শিকার হন। অনেক শ্রমিক পুড়ে কয়লা হয়ে গেছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের কারণে রাত ৯টা পর্যন্ত উদ্ধারকারী দল পুড়তে থাকা ১১ তলায় পৌঁছাতে পারেনি। এ ঘটনায় আহতদের ঢাকা মেডিকেল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শিন শিন জাপান হাসপাতাল, নাইটেঙ্গেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হা-মীম গ্রুপের মালিকানাধীন ‘দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার’ নামের ওই কারখানাটিতে গতকাল দুপুর ২টার দিকে আগুন লাগে। ১০ তলার ফিনিশিং বিভাগের খাবার ঘরে আগুনের সূত্রপাত। মুহূর্তেই তা ১১ তলায় ছড়িয়ে পড়ে। নবম তলারও আংশিক পুুড়ে গেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর ইউনিটসহ ১২টি ইউনিট আগুন নেভানো এবং উদ্ধার কাজ শুরু করে। ডেকে আনা হয় হেলিকপ্টার। উদ্ধার কাজে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ সন্ধ্যা ৬টায় সাংবাদিকদের বলেন, দশমতলার আগুন নিভেছে। তবে ১১ তলার আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ১১টায়। সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। রাতে স্নোকেল লেডারের সাহায্যে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ১০ তলায় প্রবেশ করেছেন। সেখানে ১২টি লাশ পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়।
আগুন লাগার দেড় ঘণ্টা পর বহুতল ওই ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক মনির হোসেন জানান, দুপুরের খাবারের সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তার অভিযোগ, এ সময় নবমতলার গেট বন্ধ করে দেয়া হলে শত শত শ্রমিক আটকা পড়েন। বাধ্য হয়েই শ্রমিকরা জিন্সের কাপড় জোড়া দিয়ে দশম ও ১১তলা থেকে নামার চেষ্টা করেন। এতে অনেকেই পড়ে মারা যান।
কারখানার পরিচালক (অপারেশন) সুনীল কুমার সরকার জানান, ১০ তলায় ফিনিশিং বিভাগে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর তা ১১ ও ৯ তলার ক্যান্টিনে ছড়িয়ে পড়ে। এ ভবনটিতে প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। আগুন লাগা ফ্লোরগুলোতে ৬ হাজার শ্রমিক কাজ করছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় মধ্যাহ্নভোজের বিরতি ছিল। তাই অধিকাংশ শ্রমিক ক্যান্টিনে ছিলেন বলে তিনি জানান। এ ক্যান্টিনেই আগুনের সূত্রপাত। এখানে নাশকতার অভিযোগ উড়িয়ে দেন তিনি।
অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা গেছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে। ওপরের দুটি ফ্লোর থেকে দাউ দাউ করে আগুন বেরিয়ে আসছে। হাজার হাজার মানুষের ভিড় করছেন এলাকায়। হতাহত শ্রমিকদের আহাজারিতে পুরো এলাকায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এরই মধ্যে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাবের হুইসেল আর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির কানফাটা শব্দে পুরো এলাকায় ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
মিলন বড়ুয়া নামে কারখানার এক শ্রমিক জানান, দুপুরে লাঞ্চ করছিলাম। হঠাত্ দেখি দাউ দাউ আগুন। কোনোদিকে সরার উপায় নেই। খেলাধুলার কাপড় তৈরির সরঞ্জাম বোঝাই ছিল ফ্লোরগুলোতে। এর সবই উচ্চদাহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। তাই আগুন লেগে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি। শ্রমিক মাসুদ জানান, কেরোসিন তেলে আগুন লাগলে যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফ্লোরে। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারদিকে দাউ দাউ আগুন জ্বলতে থাকে। নামার সময় দেখেন কলাপসিবল গেট আটকানো। পরে জানালা দিয়ে বেরিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের দেয়া রশি ধরে নেমে আসেন তিনি। অপর শ্রমিক নজরুল জানান, নামার সময় তিনটি অগ্নিদগ্ধ লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। আগুন লাগার সময় তিনি ১০ তলায় ছিলেন। ওই সময় ভবনের মূল সিঁড়ির কলাপসিবল গেট আটকে দেয়া হয়। ফলে শ্রমিকরা নামতে পারেননি। দাউ দাউ আগুনে অনেক শ্রমিকের শরীর ঝলসে গেছে। তাই জীবন বাঁচাতে যে যেখান দিয়ে পেরেছেন নেমে এসে চিত্কার শুরু করেন।
হাবিবুর রহমান নামে অপর এক শ্রমিক জানান, এরই মধ্যে ১০ ও ১১ তলার বহু শ্রমিক পুড়ে কয়লা হয়ে গেছেন। তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ওই দুটি ফ্লোরে ৬ হাজার শ্রমিকের মধ্যে তার মতে অর্ধেক শ্রমিক আটকা পড়েছেন। ফ্যাক্টরিতে মোট ২২ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। আগুন জ্বলছে—এমন ফোরগুলোতে ৬ হাজার শ্রমিকের অবস্থান ছিল বলে কারখানার সুপারভাইজর আবুল কাশেম জানান।
ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে ঘটনাস্থলেই দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে ঢাকা জেলার সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সালাম সাংবাদিকদের জানান। তিনি আরও বলেন, সিঁড়ি খোলা থাকলে শ্রমিকরা দ্রুত নেমে আসতে পারত। কলাপসিবল গেট আটকে দেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ৪টি অত্যাধুনিক স্নোকেল ল্যাডার দিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। ফ্লোরগুলোতে পানি ছিটিয়েছেন ফায়ার ব্রিগেড সদস্যরা। তাদের কয়েকজন কারখানার দশম ফ্লোরে গেছেন। সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে সন্ধ্যা ৭টায়। ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আগুন নেভানোর কাজে সরকারের সহযোগিতাও কামনা করেন।
কত লাশ : আগুনে ঠিক কতজন মারা গেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। কেউ বলছেন নিহত ৩০। কেউ বলছেন অর্ধশতের বেশি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ জানান, তারা মোট ২২টি লাশ উদ্ধার করেছেন। এরপরও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ জন মারা গেছেন। সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল, শিমশিম জাপান হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে আরও বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। এসব হিসাবে লাশের সংখ্যা ৩০ ছাড়িয়ে যেতে পারে। যেহেতু উদ্ধার কাজ চলছে এবং সর্বশেষ সার্চ করলে আরও লাশ পাওয়া যেতে পারে। তাই লাশের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আগুন লাগার পর বিকল্প সিঁড়ি দিয়ে কিছু শ্রমিক নেমে আসে। অনেকে কাপড়ের রোল তৈরি করে তা দিয়ে নেমে আসার সময় হাত ফসকে পড়ে মারা যান। নিহত শ্রমিক তানিয়ার স্বামী আবুল বাশার জানান, তারা ১০ তলায় ছিলেন। আগুন লাগার পর সিঁড়ি বন্ধ থাকায় তারা কয়েকজন মিলে কাপড়ের রোল বানিয়ে নিচে নেমে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার স্ত্রী তানিয়া দাঁত দিয়ে কামড়েও দড়ি ধরে রাখতে পারেননি। রক্তাক্ত অবস্থায় তানিয়া পড়ে মারা যান। একইভাবে পড়ে আরও অনেক শ্রমিক মারা গেছেন।
আগুন লাগার পর আশুলিয়ার শিন শিন জাপান হাসপাতালে আনা হয় ১০টি লাশ। নারী ও শিশু হাসপাতালে নেয়া হয় ৭টি লাশ। ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয় ৬টি। এনাম মেডিকেলে নেয়া হয় ৩টি। আরও ৪টি লাশ থাকে ঘটনাস্থলে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ৩০টি লাশের সন্ধান মেলে। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭টি লাশ আনা হয়। এছাড়া আহত অবস্থায় দেলোয়ার হোসেন নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
নিহত কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আশরাফুল ইসলাম ও আজিজুল হক নামে। আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালে ছয়টি লাশ দেখা গেছে। সেখানে আহত অবস্থায় ভর্তি আছেন ২৫ জন। আশুলিয়া নাইটেঙ্গেল হাসপাতালে দু’জনের লাশ রয়েছে। এর মধ্যে এক নারীর পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম হালিমা বেগম। আশুলিয়া শিন শিন জাপান হাসপাতালে রয়েছে ১০ জনের লাশ। তার মধ্যে একরামুল হক, রুহুল আমিন ও মাসুদ নামে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এছাড়া নিহত আরও যাদের পরিচয় মিলেছে তারা হলেন—নওগাঁ সদরের জয়নাল আবেদীনের ছেলে ফরিদ, একই এলাকার জহিরুলের ছেলে ফ্লোর ইনচার্জ এমরান, জামালপুরের শারমিন, ফরিদপুরের মধুখালীর অহিদুর রহমানের কন্যা মানসুরা, ময়মনসিংহ নান্দাইলের টুটুল ওরফে বাবুল, নেত্রকোনার হিমেল ও বরগুনার ইকরাম।
ঢাকা মেডিকেলে ১৮ লাশ : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ১৮ জনের লাশ। ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় চারজনকে হাসপাতলে পাঠানো হয়। চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনজন মারা যায়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আরও ১৫টি লাশ পাঠানো হয় মর্গে। এরমধ্যে ১০ জন পুরুষ ও পাঁচজন মহিলা। এদের মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া যায়ানি। রাত ৯টা পর্যন্ত আহত অবস্থায় তিনজন চিকিত্সাধীন ছিলেন।
এদিকে আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের গার্মেন্টে আগুন লাগার পর দুপুর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মর্গ সূত্রে জানা যায়, রাত পৌনে ৯টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি টিকআপ ভ্যানে করে ১৫ জনের লাশ আনা হয়। লাশবাহী প্রতিটি গাড়ির সঙ্গে পুলিশ সদস্য ছিল।
পুড়ে কয়লা হওয়ার আশঙ্কা : কারখানা ভবনের ১১ তলায় বহু শ্রমিক পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভবনের ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন কক্ষে আটকেপড়া অনেক শ্রমিক বেরিয়ে আসতে পারেনি। রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরাও সেখানে পৌঁছতে পারেনি। ফলে ভবনের উপরের তলায় আসলে কী ঘটেছে কত শ্রমিক মারা গেছে তারও সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় উঁচু এ ভবনে উদ্ধার কাজও ব্যাহত হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মী জানান, খালি চোখে আগুন দেখা যায় না। কিন্তু দিনভর আগুনে ভবনটি যে মাত্রায় উত্তপ্ত হয়েছে তাতে প্রবেশ করলে তারা কাবাব হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে। সেখানে অগ্নিরোধ জ্যাকেট ব্যবহার করেও ভেতরে প্রবেশ করা যাচ্ছে না।
গার্মেন্টের মেশিন অপারেটর জাহিদুল আলম জানান, ক্যান্টিনে অনেক শ্রমিক ছিল। তাদের অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। কেউ কেউ বিকল্প সিঁড়ি বা জানালা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু যারা আটকা পড়েছে ধোঁয়ার কারণে বা আগুনের তাপে তাদের অনেকেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কেউ কেউ কয়লা হয়ে গেছে। এসব শ্রমিকের লাশ উদ্ধার হলেও হয়তোবা কোন দিনই তাদের পরিচয় পাওয়া যাবে না। উপস্থিত লোকজন বলেন, ঢাকার নিমতলীতে গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে অনেক মানুষ কয়লা হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকেরই লাশ শনাক্ত করা যায়নি। এভাবে দ্যাটস ইট স্পোর্টস ভবনেও অনেক শ্রমিকের লাশ পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। তাদের লাশ কখনোই শনাক্ত করা সম্ভব হবে না।
আগুন লাগার নেপথ্যে : হা-মীম গ্রুপের এ গার্মেন্টটিতে কী কারণে আগুন লেগেছে তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। কেউ কেউ বলছেন, এটি হা-মীম গ্রুপের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। কারণ, এর আগেও কয়েকবার হা-মীম গ্রুপের কারখানায় আগুন লেগেছিল। গত বছরের জুন মাসেও একই এলাকায় আরও একটি গার্মেন্টে আগুনে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছিল। এর আগে ২০০৯ সালেও আগুন লেগেছিল হা-মীম গ্রুপের গার্মেন্টে। ঢাকার তেজগাঁও এই গ্রুপের গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক হতাহত হয়েছিল। এখন একই গ্রুপের গার্মেন্টে আগুন লাগল। আগুন লাগার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, এটা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে হতে পারে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষও বলছে আগুন লাগার কারণ শর্ট সার্কিট। তবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের তদন্তে সঠিক কারণ বেরিয়ে আসবে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও অগ্নিকাণ্ডের কারণে সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম লে. কর্নেল (অব.) দেলোয়ার হোসেন জানান, ভবনটির ৬টি গেটের মধ্যে সবই খোলা ছিল। সিঁড়ির দিকে ধোঁয়া দেখে শ্রমিকরা লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে অনেকেই পড়ে আহত বা নিহত হয়েছেন। কোনো ধরনের নাশকতার সন্দেহের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, সাধারণ কারও পক্ষে কোনো অবস্থাতেই কারখানার ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
আগুন ভয়াবহ হওয়ার নেপথ্যে : দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার নামের এ কারখানাটিতে রফতানির জন্য ৬ লাখ পিস পোশাক তৈরি করা হচ্ছিল। এর মধ্যে দুই লাখ পিস তৈরি পোশাক ১০ তলায় রাখা ছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা জানান, সিনথেটিক জাতীয় উচ্চদাহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল এসব পোশাক। তৈরি করে রাখা পোশাকগুলোতে আগুন লাগায় প্রচণ্ড ধোঁয়ায় দাউদাউ কারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক শ্রমিক শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পানি সঙ্কটে কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। এরপর ঢাকা থেকে ওয়াসার পানির গাড়ি ঘটনাস্থলে যায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক বলেন, এ ধরনের আগুন নেভাতে অনেক বেশি সময় লাগে। ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের আগুন থেকে আগুন ও ধোঁয়া বেরিয়ে আসে। ফলে আগুন সহজে নিয়ন্ত্রণে আসে না। তিনি বলেন, যেহেতু এটা কাপড়ের আগুন তাই এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক সময় লাগে। প্রায় একইরকম বক্তব্য দেন উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাও।
হেলিকপ্টারে উদ্ধার কাজ করা যায়নি : অগ্নিকাণ্ডের পর আটকেপড়া শ্রমিকদের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়। আটকেপড়া শ্রমিকরা যাতে লাফিয়ে নামতে পারেন সেজন্য নিচে জাল বিছানো হলেও সে উদ্যোগও কোনো কাজে লাগেনি। এত ওপর থেকে কেউ লাফ দিতে চায়নি। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ওই ২টি হেলিকপ্টার আসার পর এটির বাতাসে আগুন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা সেটিকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।
ভয়াবহ যানজট : অগ্নিকাণ্ডের কারণে কারখানা সংলগ্ন আবদুল্লাহপুর-ডিইপিজেড সড়কে গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার উত্সুক মানুষ, গার্মেন্ট শ্রমিক ও স্বজনদের ভিড়ে এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। তাদের ভিড় সামাল দিয়ে উদ্ধার কাজ চালানো দুরূহ হয়ে পড়ে। নরসিংহপুরে অগ্নিকাণ্ডের কারণে আশুলিয়া, মিরপুর বেড়িবাঁধ, উত্তরা, টঙ্গী, সাভার ইপিজেড, নবীনগর সড়কেও ভয়াবহ যানজট দেখা দেয়। এই যানজটের কারণে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
মালিকের বক্তব্য : হা-মীম গ্রুপের এমডি ও এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদ এ ঘটনার পরপরই তার কার্যালয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগুন এখনও জ্বলছে। তবে তা দ্রুত নেভানোর লক্ষ্যে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে সন্ধ্যা ৭টায় তিনি আসেন ঘটনাস্থলে। ঘোষণা দেন নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ও আহতদের চিকিত্সা ব্যয় বহন করার। তিনি বলেন, কী কারণে আগুন লেগেছে তা পরিষ্কার নয়। আগুনের নেপথ্যে কোনো নাশকতা আছে কিনা? এর উত্তরে তিনি জানান, নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে আগুন লাগার কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কথা বলেন তিনি। তিনি আরও জানান, নিহতদের পরিবারের সদস্যদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া আহতদের ২৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
দুটি তদন্ত কমিটি গঠন : আগুন লাগার ঘটনা তদন্ত করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি করা হয়েছে এক সদস্যের। এতে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ইস্রাফিল আলম শাহিন।
বিজিএমইএ গঠন করেছে ৩ সদস্যের আরেকটি কমিটি। বিজিএমইএ’র সভাপতি সালাম মুর্শেদী সাংবাদিকদের বলেছেন, আগুনের ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের জন্য এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এছাড়া লাশ পৌঁছানোর জন্য আরও ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।
তিনি আরও জানান, হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের জন্য আরও এক লাখ টাকা ও আহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।
ঘটনাস্থলে মন্ত্রী-এমপিরা : অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম, সাভারের সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ ঘটনাস্থলে আসেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামী সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরও ৫০ জন। এদের চিকিত্সার পুরো খরচ বহন করবে হা-মীম গ্রুপ। আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব না হলেও তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ : বিজিএমইএ’র সভাপতি সালাম মুর্শেদী সাংবাদিকদের বলেছেন, আগুনের ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের জন্য এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এছাড়া লাশ পৌঁছানোর জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। তিনি আরও জানান, হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের জন্য আরও এক লাখ টাকা ও আহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক : রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান হা-মীম গ্রুপের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তদন্তের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ অনুসন্ধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আহতদের সর্বোচ্চ চিকিত্সা দেয়ারও নির্দেশ দেন। তিনি রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
খালেদা জিয়ার শোক : প্রাণহানির ঘটনায় গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল এক শোকবার্তায় বেগম জিয়া বলেছেন, আগুনে পুড়ে এতগুলো লোকের জীবনহানিতে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীরভাবে ব্যথিত। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে পোশাক তৈরি শিল্পে অসন্তোষ বিরাজ করছে, অথচ তা নিসরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
বিজিএমইএ : অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)। এক বিবৃতিতে তারা নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। অগ্নিকাণ্ডের পরপরই বিজিএমইএ’র সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর নেতৃতে বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। উদ্ধারকাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

No comments:

Post a Comment