Tuesday 7 December 2010

রাষ্ট্রপতির ক্ষমাপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামিদের নাটোরে ফুল দিয়ে বরণ করলেন মন্ত্রী : বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : রাষ্ট্রপতির ক্ষমা বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক : অধ্যাপক মোজাফ্ফর

স্টাফ রিপোর্টার

রাষ্ট্রপতি যে ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা করে দিয়েছেন তাদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়েছে। যুবদল নেতা সাব্বির আহম্মেদ গামা হত্যা মামলার অভিযুক্ত সাজাপ্রাপ্ত আসামি নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফিরোজসহ মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজনকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। গতকাল বিকেলে নাটোর সার্কিট হাউসে এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এক ঘরোয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। হত্যামামলার আসামিদের ফুল দিয়ে বরণ করায় এলাকার সাধারণ মানুষ ও গুণীজনরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তি দেয়া এবং ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা কোনো শুভলক্ষণ নয়। অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা করে দেওয়াকে বিশিষ্ট নাগরিকগণ দেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তারা বলেছেন, যদি বিচার প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা না যায় তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাবে।
এ ব্যাপারে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিচার শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমা করে দিলে বিচার ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে। যদি বিচার প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা না যায় তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেন, এ ক্ষমা বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর করা উচিত ছিল। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমা করাটা বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করি।
হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া কারাবন্দি ২০ আসামিকে রাষ্ট্রপতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পর ১৪ জনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহম্মেদ তালুকদার গামা হত্যা মামলায় এদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সোমবার মধ্যরাতে ১০ জনকে মুক্তি দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। গতকাল আরও ৪ জনকে রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেলসুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ফাঁসি মওকুফ হওয়া সবাই নাটোরের নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। মুক্তির আদেশ সোমবার কারা অধিদফতরে পৌঁছার পর রাত সোয়া বারোটার দিকে মুক্তি দেয়া হয় ঢাকা কারাগারে বন্দি ১০ আসামিকে। মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী কারাগার থেকে আরও চারজনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। রাজশাহী কারাগারে বন্দি অপর ছয়জনের বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় তাদের মুক্তি দেয়া হয়নি। ওইসব মামলায় জামিন পেলেই তারাও মুক্ত হবেন বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আকবর আলী নামে এক আসামি পলাতক রয়েছেন।
গতকাল রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্তরা হলেন—জহুরুল ইসলাম শাহ, সোহাগ শাহ, বাবলু ও ফরমাজুল। সোমবার মধ্যরাতে ঢাকা কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ১০ জন হলেন—এসএম ফিরোজ, আনিসুর রহমান আনসার, বাদল, সেন্টু, আব্দুল জলিল, শাহজাহান, ফজলুল হক শাহ, ফয়সাল, ফারুক ও জাহেদুল। রাজশাহী কারাগারে বিভিন্ন মামলায় জামিনের অপেক্ষায় থাকা ছয় আসামি হলেন—আবুল হোসেন, আতাউর রহমান, আশরাফ, সাজ্জাদ শাহ, ফকরউদ্দিন ও ওহিদুর রহমান। প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট গামা হত্যা মামলায় নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফিরোজসহ ২১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক ফিরোজ আলম।
ফাঁসির আসামিকে সংবর্ধনার ব্যাপক আয়োজন : নাটোর থেকে আবদুস সালাম জানান, নাটোরে যুবদল নেতা ও তত্কালীন ভূমি উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির হোসেন গামা হত্যা মামলার রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২১ জনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণায় ২০ জন মুক্তি পাওয়ায় তাদের গণসংবর্ধনার ব্যাপক আয়োজন করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। মুক্তি পেয়ে ঢাকা ও রাজশাহী থেকে নাটোরে আসার পর নাটোর সার্কিট হাউসে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার মুক্তিপ্রাপ্ত মো. বাদল উদ্দিন, ফারুক শাহ, শাহজাহান, মো. আবদুল জলিল, সোহাগ, ফরমাজুল হক, জহুরুল মেম্বার ও বাবলুসহ ৮ জনকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেন। এ সময় তাদের গলায় ফুলের মালা দেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হানিফ আলী শেখ ও সিনিয়র সহ-সভাপতি নাটোরের পিপি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। ফাঁসির আদেশ মওফুফ হওয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হওয়া ১০ জনের মধ্যে নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফিরোজসহ ছয়জন এখনও ঢাকায় অবস্থান করছেন। বাকি ৬ জন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিকেলে নাটোর এসে পৌঁছাবে। এদিকে বিকেলে নলডাঙ্গা এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা ও সদর উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদের নেতৃত্বে মুক্তিপ্রাপ্তদের নাটোর থেকে নলডাঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণায় মুক্তি পাওয়া ২০ জনকে বৃহস্পতিবার প্রথমে নাটোর সদরের আমতলি হাইস্কুল মাঠে সংক্ষিপ্ত সংবর্ধনা ও পরে বাসুদেবপুর হাইস্কুল মাঠে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হবে। গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। ২১ জনের মধ্যে আকবর আলী নামে একজন প্রথম থেকেই পলাতক রয়েছে। বিগত ২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নাটোরের নলডাঙ্গা থানার শাহপাড়া আমতলী গ্রামের একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করার সময় যুবদল নেতা সাব্বির আহম্মেদ তালুকদার গামাকে প্রকাশ্য দিবালোকে অনেক মানুষের সামনে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলি ও কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহতের বাবা ও দুলুর বড় ভাই মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বাদী হয়ে নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফিরোজসহ ১৬ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে এসএম ফিরোজ, আনিসুর রহমান শাহ, ফাইসাল, জাহিদুল, সেন্টু, বাদল, আকবর, আশরাফ রানা, আব্দুল জলিল, ফরমাজুল, ফজলুল হক, শাহজাহান আলী, আবুল হোসেন, ওহিদুল, ফারুক, ফকর উদ্দীন, জাহিরুল মেম্বার, সাজ্জাদ হোসেন, সোহাগ, বাবলু, আতাউর রহমান ওরফে মোবারকসহ মোট ২১ জনকে আসামি করে নলডাঙ্গা থানায় চার্জশিট দাখিল করেন । পরে এই হত্যা মামলাটি ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিয়ে নেয়া হয়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের ৩ নম্বর আদালতের জজ মো. ফিরোজ আলম গামা হত্যা মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ শেষে অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে ২১ জনকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন। ঘোষিত এ রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত আসামিদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স করা হয়। যার নম্বর ৯৪/২০০৬। হাইকোর্টের আপিল বিভাগে রায়টি শুনানির অপেক্ষায় ছিল।

No comments:

Post a Comment