Tuesday 7 December 2010

সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নানা অভিযোগ : সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থার একশ’ কারণ

জাহেদ চৌধুরী

সরকারি দল আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার মতো শত কারণের জন্ম দিয়েছে। সংসদে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করানোর মতো কাছাকাছি আসনও বিরোধী দলের নেই জেনেই তাদের মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবির প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অনাস্থা পাসের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তবে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তার মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবির যুক্তিগুলো জনগণের সামনে এখনও সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেননি। তবে তিনি ও তার দলের অন্য নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার পালনে নানা ব্যর্থতার অভিযোগ আনছেন বিভিন্নভাবে। সুধীজনের পক্ষ থেকেও সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা আসছে। বিরোধী দল সংসদে গিয়ে আনুষ্ঠানিক অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারেন। পাস না হলেও এ ধরনের অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের নজির আমাদের দেশে ও বিভিন্ন দেশে রয়েছে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারি দল আওয়ামী লীগ তাদের শাসন মেয়াদের প্রায় মধ্যভাগে রয়েছে।
সংসদের বাইরে রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার মতো শত কারণ জনসমক্ষে এসেছে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া, লোডশেডিংয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ, চরম গ্যাস ও পানি সঙ্কট, কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, দলীয় লোকদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও ভর্তি-বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে দেশকে বাজিকরদের হাতে তুলে দেয়া, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের নির্লজ্জ দলীয়করণ, ফি ছাড়াই ট্রানজিটসহ ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক দেশবিরোধী নানা চুক্তি করা, সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধে ব্যর্থতা, চুক্তি লঙ্ঘন করে জিরো লাইনের দেড়শ’ গজের পরিবর্তে মাত্র ৫০ গজের মধ্যে ভারতকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অনুমতি, পিলখানায় সেনাহত্যা ঠেকানোর ব্যর্থতা এবং এরই ধারাবাহিকতায় বিডিআর ধ্বংস, জরুরি সরকারের মতো বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দিতে ১৪৪ ধারা জারি, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ও নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব না দেয়া, নানা অজুহাতে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, আমার দেশ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকা, একাধিক টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া, ৬ হত্যাসহ সহস্রাধিক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় মূলত সরকারি দলের সম্পৃক্ততা, ঢাকার যানজট নিরসনে ব্যর্থতা, উপজেলা প্রশাসনকে কার্যকর করাসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচন করতে না পারা, রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করে লক্ষাধিক সরকারদলীয় আসামিকে মামলা থেকে মুক্তি দেয়া ইত্যাদিসহ শতাধিক কারণ রয়েছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার। বিভিন্ন মহলে এসব নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম বছরের শাসন ব্যবস্থার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন তার লিখিত বক্তব্যে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজি—এসব বিভিন্ন ধরনের বাজির রকমফের দেখে দেশের লোক দিশেহারা। সরকার মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সীমাহীনভাবে ব্যর্থ হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্যও ৩ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের সরকার সুখকর হয়নি। ৫ অক্টোবর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে দেয়া তার দীর্ঘ বক্তব্যের চুম্বক অংশেই দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার একটি চিত্র ও ভবিষ্যদ্বাণী স্পষ্ট। প্রতিদিনের জাতীয় দৈনিকগুলো যেসব খবর ও রাজনৈতিক নেতারাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত প্রকাশিত হচ্ছে—তাতে কমবেশি দেশের চিত্র পাওয়া যায়।
দ্রব্যমূল্যকে নাগালের মধ্যে রাখা, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দলনিরপেক্ষ মেধাভিত্তিক প্রশাসন, দুর্নীতিমুক্ত দেশসহ সুশাসন প্রতিষ্ঠার নির্বাচনী অঙ্গীকার করে দিনবদলের স্লোগান দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ। ৫ বছরমেয়াদি সরকারের প্রায় দু’বছর পার হয়েছে। কথা উঠেছে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে জনমত যাচাইয়ের। দাবি করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াও। জবাব দিয়েছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বলেছেন, সংসদে এসে অনাস্থা আনুন। সংবিধান অনুযায়ী অনাস্থা ভোটে জিততে পারলে আমরা ক্ষমতা ছেড়ে দেব। ৩০০ আসনের সংসদে ৩২ আসনের বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের পক্ষে কোনো অনাস্থা প্রস্তাব পাস করানো সম্ভব নয়, সেটা সরকারি দল ভালো করেই জানে। তবে সংবিধানে এও সুযোগও আছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যে কোনো সময় চাইলেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের আস্থা যাচাই করে নিতে পারে। অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি দেখা গেছে। যদিও শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশে এ ধরনের জনমত দেখার কোনো সুযোগ নেই। তবে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় কিংবা সরকারি দলের হস্তক্ষেপে বারবার ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার ঘটনায় জনমত নিয়ে সরকারের শঙ্কার বহিঃপ্রকাশ কিছুটা হলেও প্রকাশ পাচ্ছে।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়িছাড়া করার আয়োজন করে সরকার দেশকে রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সংবিধানে সভা-সমাবেশের অধিকার লঙ্ঘন করে সম্প্রতি বিরোধী দলের সমাবেশে সরকার বাধা দিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের লোকদের দিয়ে পাল্টা সমাবেশ আহ্বান করে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হচ্ছে। নাটোরে উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করে তাদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী সাফাই গেয়েছেন। পাবনায় সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর যুবলীগের ক্যাডাররা হামলা করার পর উল্টো প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে।
সাংবাদিক নির্যাতনে বর্তমান সরকার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ঠুনকো অজুহাতে আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১২ দিন রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। এ সরকারের আমলে এরই মধ্যে ৬ সাংবাদিক খুন হয়েছেন আর সহস্রাধিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমার দেশ বন্ধ করে দেয়ার পর আদালতের রায়ে পত্রিকাটি আবার চালু হয়েছে। কিন্তু চ্যানেল ওয়ান, যমুনা টিভিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতনের সঙ্গে সরকারি দলের ক্যাডাররা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশে ইভটিজিং বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে ৪ জন প্রাণ দিয়েছেন।
দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ঘোষণা দিয়ে সরকার ক্ষমতায় এলেও ১ বছরে ১৮ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে।
অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক ছড়িয়ে চামড়া শিল্পকে ধ্বংসের মুখোমুখি নিয়ে গেলেও সরকার যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এর আগে বার্ড ফ্লুর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেশের পোলট্রি শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থার

একশ’টি কারণ তুলে ধরা হলো :

এক. দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি; দুই. আইনশৃঙ্খলার অবনতি; তিন. লোডশেডিংয়ে রেকর্ড; চার. কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা;পাঁচ. সভা-সমাবেশে বাধা এবং বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে না দেয়া; ছয়. দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি; সাত. প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণ; আট. দলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি দখলবাজি; নয়. বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া; দশ. আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ;
এগার. দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার; বারো. মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব না দেয়া; তের. পিলখানায় সেনা হত্যাযজ্ঞ ও বিডিআর ধ্বংস ঠেকাতে ব্যর্থতা; চৌদ্দ. অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা না করে ভারতকে ট্রানজিট প্রদান; পনের. স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থতা;ষোল. প্রায় দু’বছর আগে নির্বাচিত হওয়ার পরও উপজেলা চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিয়ে উপজেলা পরিষদকে কার্যকরে ব্যর্থতা; সতের.চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পরাজয়ের পর ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নির্বাচনের কমিশনের উদ্যোগে সরকারি দলের বাধাদান; আঠার. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার নির্বাচনী অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থতা; উনিশ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথককরণের পরও বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয়সহ কার্যকর স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা; বিশ. দুর্নীতি দমন কমিশন, পিএসসিসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা;
একুশ. তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ব্যর্থতা; বাইশ. ’৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি লঙ্ঘন করে জিরো লাইনের দেড়শ’ গজের পরিবর্তে মাত্র ৫০ গজের মধ্যে ভারতকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অনুমতি প্রদান; তেইশ. বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা বৃদ্ধি; চব্বিশ. নবম সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনার জন্য বিরোধী দলের উত্থাপিত সহস্রাধিক মুলতবি প্রস্তাবের একটিও গ্রহণ না করা; পঁচিশ. শিল্পায়নে ব্যর্থতা; ছাব্বিশ. বাজিকরদের হাতে দেশকে তুলে দেয়া; সাতাইশ. গার্মেন্ট শিল্পে সহিংসতা রোধে ব্যর্থতা; আঠাশ. মানবাধিকার লঙ্ঘন; ঊনত্রিশ. ক্রসফায়ার বৃদ্ধি; ত্রিশ. সীমান্তে বিএসএফের হত্যাযজ্ঞ বৃদ্ধি;
একত্রিশ. গুপ্তহত্যা চালু। ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ গুম হওয়া নেতাদের উদ্ধারে ব্যর্থতা; বত্রিশ. সম্পাদকসহ মিডিয়া কর্মীদের দলন; তেত্রিশ. বিএনপি আমলের চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গিয়ে ৬ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়া; চৌত্রিশ. মূল্যস্ফীতিতে বিএনপি আমলের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি; পঁয়ত্রিশ. সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে যাওয়া; ছত্রিশ. চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত মাল ওঠানামাসহ কার্যক্রম গতিশীল করার নির্বাচনী অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থতা; সাইত্রিশ. এখন পর্যন্ত কয়লা নীতি চূড়ান্ত করতে না পারা; আটত্রিশ. বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে সীমান্তে যৌথ হাট চালু; ঊনচল্লিশ. ভারত থেকে আড়াইশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির কথা বলে প্রায় ১১শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশী টাকায় ভারতের অভ্যন্তরে গ্রিড লাইন চালুর চুক্তি; চল্লিশ. বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে কঠিন শর্তে ভারতের কাছ থেকে ১শ’ কোটি ডলার সমমূল্যের প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করে ভারতীয় ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করার কাজে ব্যবহার;
একচল্লিশ. ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশের সম্মতি দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া;বিয়াল্লিশ. আঞ্চলিক অপরাধ দমনের নামে ভারত-বাংলাদেশ গোয়েন্দা সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাজ করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির গোপন চুক্তি; তেতাল্লিশ. ভারতের কাছ থেকে তিনবিঘা করিডোর আদায়ে ব্যর্থতা;চুয়াল্লিশ. উলফাসহ সেভেন সিস্টারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নেতাদের গোপনে ভারতের হাতে তুলে দিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া; পঁয়তাল্লিশ. সীমান্তে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের যৌথ টহল চালু; ছয়চল্লিশ. ভারতীয় বিমানের নিরাপত্তার নামে ভারতীয় কমান্ডোদের স্কাই মার্শাল হিসেবে নিয়োগ ও দূতাবাসের নিরাপত্তায় কমান্ডো নিয়োগের ইতিবাচক সায় দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া; সাতচল্লিশ. রূপগঞ্জের ঘটনার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষা করতে না পারা;আটচল্লিশ. ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে ব্যর্থতা; ঊনপঞ্চাশ. রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সঙ্কট নিরসনে ব্যর্থতা; পঞ্চাশ. ৫০ বছরের মধ্যে রাজধানীতে ভয়াবহ খাবার পানির সঙ্কট;
একান্ন. রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতা; বায়ান্ন. রাজধানীর খালগুলোকে দখলমুক্ত করতে ব্যর্থতা; তেপ্পান্ন. বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা ও ঢাকাকে পরিবেশবান্ধব করতে ব্যর্থতা; চুয়ান্ন. সরকারদলীয় লোকদের চাঁদাবাজির রেকর্ড; পঞ্চান্ন. সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের ব্যাপক ভর্তি-বাণিজ্য; ছাপ্পান্ন. ভর্তি-বাণিজ্যে ইডেন কলেজসহ দেশের বিভিন্ন কলেজে মেয়েদের ব্যবহার; সাতান্ন. দলীয় অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়া; আটান্ন. সরকারি দলের ক্যাডারদের হাতে নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য অবস্থান; ঊনষাট. পাবনায় ডিসি অফিসে লোক নিয়োগের পরীক্ষা ভণ্ডুল করতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা হামলা চালিয়ে এডিসিসহ ১৫ সরকারি কর্মকর্তাকে মারধরের পর উল্টো সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি; ষাট. সিরাজগঞ্জে ট্রেনের চাকায় ৭ জন বিএনপি কর্মী নিহত হবার ঘটনায় ট্রেন জ্বালিয়ে দেয়ার পর বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতাসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়ে তাদের বাড়িছাড়া করা;
একষট্টি. রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্প প্রতিষ্ঠা নিয়ে সেনাবাহিনী ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার ঘটনা ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতা; বাষট্টি. সরকার থেকে অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক ছড়িয়ে চামড়া শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া; তেষট্টি. বার্ড ফ্লু ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য পোলট্রি শিল্পে বিপর্যয়; চৌষট্টি. বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়া করার উদ্যোগ নিয়ে রাজনীতিকে সংঘাতময় করে তোলা; পঁয়ষট্টি. দিন বদলের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় আসার পরও প্রতিহিংসার রাজনীতি অব্যাহত রাখা; ছিষট্টি. জিয়া বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনসহ সারাদেশে গণহারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের হিড়িক; সাতষট্টি. নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রত্যেক পরিবারের অন্তত একজনের চাকরি নিশ্চিত করতে না পারা; আটষট্টি. রাজনৈতিক মামলার কথা বলে সরকারদলীয় লক্ষাধিক নেতাকর্মীর খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতিসহ নানা ধরনের মামলা প্রত্যাহার; ঊনসত্তর. বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক নতুন নতুন মামলা দায়ের; সত্তর. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতা;
একাত্তর. ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হবে বলে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের আলীর ঘোষণার মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমঅধিকারের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা লঙ্ঘন; বাহাত্তর. পুলিশে ব্যাপক দলীয়করণ; তেহাত্তর. ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধ নির্মূলে ব্যর্থতা; চুয়াত্তর. সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের চাপাতি লীগ উপাধি; পঁচাত্তর. জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও ইস্যুগুলো সংবিধান অনুযায়ী সংসদে উত্থাপন না করা; ছিয়াত্তর. বাজার সিন্ডিকেটের কথা মন্ত্রীদের স্বীকার করে নেয়ার পরও সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের ব্যর্থতা; সাতাত্তর. জনশক্তি রফতানিতে ধস ঠেকাতে ব্যর্থতা; আটাত্তর. খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্যে কেরোসিন, বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারা; ঊনআশি. খাসজমি পুনর্বণ্টনে দুর্নীতি; আশি. কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে দুর্নীতি;
একাশি. ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতা; বিরাশি. জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফলভাবে মোকাবিলা করতে না পারা; তিরাশি. পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করে সে অঞ্চলের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া; চুরাশি. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি নিয়ে ব্যাপক দলীয়করণ, মন্ত্রীর লিস্ট বাদ দিয়ে উপদেষ্টা দিয়ে দলীয় তালিকা প্রণয়ন; পঁচাশি. খুনের মামলার আসামি ও সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুরকারি ব্যক্তিদের হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ; ছিয়াশি. দলীয় বিবেচনায় তৃতীয় শ্রেণী প্রাপ্ত অধিকাংশ বিচারপতি নিয়োগ; সাতাশি.প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয় ও জ্বালানি উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে একটি রিপোর্ট প্রকাশের দায়ের নজিরবিহীনভাবে সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে আমার দেশ-এর সম্পাদকের বিরুদ্ধে ২৬টি মামলা দায়ের; আটাশি. আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ঠুনকো অজুহাতে গ্রেফতার করে ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন; ঊননব্বই. আফগানিস্তানে সেনা পাঠানোর মতো আত্মঘাতী প্রস্তাবে সায় দিয়ে দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া; নব্বই. সরকারদলীয় এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের গাড়িতে যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের পরও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া;
একান্নবই. সরকারদলীয় মুখপাত্র মাহবুবুল আলম হানিফ বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দেশ ছাড়া করার ঘোষণা;বিরানব্বই. বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে একের পর এক মামলা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির নজির স্থাপন; তিরানব্বই. কোকোর প্যারোল বাতিল করে অমানবিক কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন; চুরানব্বই. মন্ত্রীদের সংসদ ও সংসদের বাইরে অসত্য তথ্য প্রদান; পঁচানব্বই. প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত না করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু;ছিয়ানব্বই. আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিদেশ ভ্রমণে বাধা প্রদান; সাতানব্বই. নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া; আটানব্বই. স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে বাধা প্রদান, নিরানব্বই. রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে নাটোরে গামা হত্যা মামলার বিশ আসামিকে ছেড়ে দেয়া; একশ. দেশের রাজনৈতিক সুষ্ঠু পরিবেশন সৃষ্টির পরিবর্তে প্রতিহিংসার রাজনীতি চালু।

সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থার শত কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ উল্লেখ করা হলো।

দ্রব্যমূল্য : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল গত বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগ জনগণের তরফ থেকে। আর এটাকেই আওয়ামী লীগ লুফে নিয়েছিল। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি শাসনামলের শেষদিকে ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের নির্বাচনী জনসভায় এবং একই দিনে জামালপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই জনগণের কাছে ওয়াদা করে বলেছিলেন নির্বাচিত হলে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াবেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ওইদিন ও জাতীয় দৈনিকে পরদিন খবরটি প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় ‘টাঙ্গাইল ও জামালপুরে শেখ হাসিনা...’ ডাবল কলাম শিরোনামের খবরে বলা হয়, ‘...টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী হাইস্কুলের জনসভায় তিনি ড. আবদুর রাজ্জাককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, জোট সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসন থেকে মুক্তি ও অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনে নৌকায় ভোট দিন। তিনি স্লোগান দেন, নৌকা মার্কায় ভোট দেব ১০ টাকা সের চাল খাব। ধানের শীষে ভোট দেব না ২০ টাকা সের চাল খাব না।’ একই দিনে জামালপুরের মাদারগঞ্জ বালিয়াজুড়ী এফএম উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মির্জা আজমের জন্য নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশকে বাঁচাতে হলে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশে ১০০ ভাগ লোককে শিক্ষিত করা হবে, দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। চালের সের ১০ টাকা হবে। দেশ আবার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।’ ১৭ সেপ্টেম্বর আমার দেশ পত্রিকার প্রথম পাতায় ডাবল কলাম শিরোনাম ছিল ‘টাঙ্গাইল ও জামালপুরে শেখ হাসিনা : ২০ টাকার চাল ১০ টাকায় খেতে হলে নৌকায় ভোট দিন।’ এরপর অসংখ্যবার শেখ হাসিনা এ বক্তৃতা দিয়েছেন। জাতীয় দৈনিকে তার ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতির কথা প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাত্র ৫ দিন আগে বগুড়ার শেরপুর বাসস্ট্যান্ডের সমাবেশে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি সেখানকার প্রার্থী হাবিবুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ১০ টাকায় চাল খেতে হলে নৌকায় ভোট দিতে হবে। ২৫ ডিসেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠ, সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকায় খবরটি প্রকাশ হয়। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের অন্যতম স্লোগান ছিল ১০ টাকা কেজিতে চাল খাব, নৌকা মার্কায় ভোট দেব। আর বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ২০০৮ সালের ২ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত সভায় বলেন, তার দল ক্ষমতায় গেলে প্রতি কেজি চালের দাম কমিয়ে ১০ টাকা ও কাঁচামরিচের কেজি ৫ টাকা করা হবে। ৩ ডিসেম্বর নয়া দিগন্তসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খবরটি প্রকাশ হয়। নির্বাচনের আগে সারাদেশে আওয়ামী লীগের অন্যতম স্লোগান ছিল—নৌকায় ভোট দেব, ১০ টাকা সের চাল খাব।

প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দল এখন বেমালুম ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা অস্বীকার করছেন। কিছুদিন আগে বলেছেন, ২০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা বলেছিলেন। যদিও ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ার কথা তারা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, তার অসংখ্য প্রমাণ টিভি ফুটেজ ও পত্রিকার পাতায় রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৩৫ টাকার নিচে এখন বাজারে মোটা চাল নেই। মোটা ইরি চাল ৪০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলেই কাঁচামরিচ ২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার দিনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২৪ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল। ঢাকায় টিসিবির হিসাবে সেদিন মোটা চাল ছিল ২৭ টাকা কেজি। সে চাল এখন প্রায় দ্বিগুণ। বিএনপি আমলের শেষ বছরের তুলনায় মোটা চালের দাম ১০০ ভাগেরও বেশি বেড়েছে। আটার কেজি এখন ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা। বিএনপি আমলে যা ছিল এর অর্ধেক। ২০ টাকা কেজি রসুনের দাম ১২০০ ভাগ বেড়ে অর্থাত্ ১২ গুণ হয়ে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। হলুদের দামও সে সময়ের তুলনায় ১০০০ ভাগ বা ১০ গুণ বেড়েছে। রাঁধুনি ব্র্যান্ডের আধাকেজির গুঁড়ো হলুদের দাম ২২২ টাকা। সে হিসাবে কেজি পড়ে ৪৪৪ টাকা। রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল এক লিটারের দাম ১০৫ টাকা। মুগ ও মসুরের ডাল ১০৫ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা কেজি ধরে ব্রিকি হচ্ছে। এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম ৪ বছরের ব্যবধানে ১০০ ভাগ থেকে সর্বোচ্চ ১২০০ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে। এ কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।
অতীতে বাজার সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিভিন্ন ভবনের জড়িত থাকার অভিযোগও উঠেছিল। কিছুদিন আগে বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ৫/৬ জনের একটি সিন্ডিকেটের হাতে চিনির বাজার জিম্মি হয়ে আছে। বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সরকারি দলের একাধিক মন্ত্রী এ সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করেছেন।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল আইনশৃঙ্খলার উন্নতি। কিন্তু বাস্তবে এর অবনতির কথাও একাধিকবার সরকারের মন্ত্রী ও এমপিরা স্বীকার করেছেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর সংসদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের দেয়া একটি হিসাব থেকে দেখা যায়, প্রতিদিন দেশে ১০টি খুনের ঘটনা থানায় নথিভুক্ত হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রতিদিন গড়ে ৯টি, তার দেয়া হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ১১ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ১৭ হাজার ৫৫৭টি। এর মধ্যে খুন ১ হাজার ৯৫১, ধর্ষণ ১ হাজার ৫৮৬, নারী নির্যাতন ৭ হাজার ২৮৫। প্রতিদিন জাতীয় দৈনিকের পাতায় অসংখ্য খুনের খবর ছাপা হচ্ছে। সে তুলনায় আসামিরা গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে না।
দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতির অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে সরকারদলীয় লোকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রথম ২০ মাসে সারাদেশে ৮৮ জন খুন হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৮৮০ জন। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৮৮টি। দলীয় আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার দখল, চাঁদাবাজি, হাটবাজার, বিল, হাওর-বাঁওড়ের ইজারা, শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মূলত এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
আইনশৃঙ্খলার অবনতির আরেকটি বড় নজির হচ্ছে গুপ্তহত্যা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গড়ে প্রতিদিন ১০টি করে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হচ্ছে। তারা মূলত গুপ্তহত্যা কিংবা অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রভাবশালী ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম এ ধরনের ঘটনার শিকারের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি।
ক্রসফায়ারে প্রতিনিয়ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল মানবাধিকারবিরোধী ক্রসফায়ার বন্ধ করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা; কিন্তু দেখা গেছে, ক্রসফায়ার এখন আগের চেয়েও অনেক বেড়ে গেছে।
দেশব্যাপী ভয়াবহ লোডশেডিং : অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সরকারের আমলে লোডশেডিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, কিছুদিন প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং হয়েছে ঢাকায়। সে হিসাবে দিনরাতে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুিবহীন ছিল নগরবাসী। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। অনেক জায়গায় দিনে ৬ ঘণ্টাও বিদ্যুত্ থাকছে না। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২ বছরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এর মধ্যে সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ প্ল্যান্ট, ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির জন্য চুক্তি, তেলনির্ভর বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের মতো বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অতি উচ্চমূল্যে এসব কর্মসূচি দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে লাভজনক হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে বলে এখন মধ্যরাতে লোডশেডিং হচ্ছে।
পানি ও গ্যাস সঙ্কট : বিদ্যুতের পাশাপাশি ঢাকায় পানি ও গ্যাসের ভয়াবহ সঙ্কট গত দু’বছর থেকে লেগেই আছে। সঙ্কট একপর্যায়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল ঢাকার এমপিরা বৈঠক করে নিজেরাই মন্তব্য করেছেন, গত ৫০ বছরে ঢাকা শহরে এমন পানির সঙ্কট দেখেননি। ঢাকায় গণবিস্ফোরণের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন তারা। গ্যাস সঙ্কটের কারণে রাজধানীর বহু এলাকায় এখনও দিনে কয়েক ঘণ্টা চুলা জ্বলে না। এ সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার ৬ ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় গত রমজান থেকে। ফলে সিএনজিচালিত যানবাহনগুলোর জন্য নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার : গত সপ্তাহে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও খারাপ হয়েছে। টিআই সূচকেও দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান একধাপ নিচে নেমেছে। অতি সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মন্তব্য করেছেন, তৃতীয় শ্রেণীর একটি সরকারি চাকরির জন্য এখন ৩ লাখ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। সিএনজি অটোরিকশার দুর্নীতির কথা ব্যাপক প্রচলিত ছিল গত বিএনপি সরকারের আমলে। দেড় লাখ টাকার সিএনজি তখন ৩ লাখ টাকায় ঘুষ দিয়ে রাস্তায় নামাতে হয়েছে। সেই সিএনজি-অটোরিকশা রাস্তায় নামাতে খরচ হয় এখন সাড়ে ৮ লাখ টাকা। টাকা ছাড়া এখন ফাইল নড়ে না।
সর্বত্র ব্যাপক টেন্ডারবাজি : সরকারি দল বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে গেছে, টেন্ডার দখলের জন্য চাপাতি হাতে ছাত্রলীগ কর্মীদের আক্রমণের দৃশ্য পত্রিকায় ছাপার পর প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা ছাত্রলীগকে চাপাতি লীগ বলে অভিহিত করেছেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান এসব বাজিকরের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় টেন্ডার দখল নিয়ে সরকারি দলের উপদলগুলোর সশস্ত্র মহড়ার কোনো না কোনো খবর ছাপা হচ্ছে। সর্বশেষ পশুর হাটের টেন্ডারও সরকারি দলের ক্যাডারদের দখলে গেছে। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হাতে মেয়রের দু’ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে থাকার মতো ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের টেন্ডার দখল নিয়ে সরকারি দলের বিভিন্ন গ্রুপের মহড়া মাঝেমধ্যেই হচ্ছে।
অকার্যকর সংসদ : জাতীয় সংসদ এরই মধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। আসন বণ্টনসহ নানা ইস্যুতে বিরোধী দল সংসদ বর্জন করছে। এরই মধ্যে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে দেয়া একটি মুলতবি প্রস্তাবও সংসদে গৃহীত হয়নি। ভারতের সঙ্গে করা চুক্তিসহ কোনো চুক্তিই জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়নি। এসব নিয়ে কোনো আলোচনাও করা হয়নি। একতরফাভাবে চলছে এ সংসদ। সংসদ অকার্যকর করার জন্য সরকারি ও বিরোধী দল একে অপরকে দোষারোপ করছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বিতর্কিত চুক্তি : ভারতের সঙ্গে গত বছর জানুয়ারি মাসে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এছাড়া ৫০ দফা সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ধারাবাহিকতায় ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়ার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু অতিসম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের বিনিময়ে বাংলাদেশ কোনো শুল্ক নেবে না। অল্প ফি নেবে। ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ৫ বছরে যেখানে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে সেখানে ৫ হাজার কোটি টাকা আয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থায় ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়া নিয়ে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত বিতর্ক ছাড়াও নতুন করে অর্থনৈতিক বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী এরই মধ্যে বাংলাদেশ বেশকিছু পদক্ষেপ এগিয়ে নিলেও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যাসহ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার এখনও কোনো চুক্তি হয়নি। তিনবিঘা করিডোরও বাংলাদেশ পায়নি। চুক্তি অনুযায়ী ভারত ১০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিলেও এই ঋণের উচ্চহার ও ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের স্বার্থে আসবে না—এমন প্রকল্পে এই অর্থ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ নিরাপত্তাজনিত যে চুক্তি করেছে সেগুলো এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ঘটনা এরই মধ্যে ঘটেছে। সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বাংলাদেশের ভেতর থেকে গ্রেফতারে যৌথ গোয়েন্দা তত্পরতা ছিল। বাংলাদেশ ওইসব নেতাকে ভারতের হাতে অনানুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিয়েছে।
সীমান্তে হত্যাযজ্ঞ চলছে : বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশীদের হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরে ৪৯ জন বাংলাদেশী প্রাণ দিয়েছে বিএসএফের হাতে। ২০০৯ সালে প্রাণ দিয়েছিল ৯৬ জন। যেখানে ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬২ জন। বন্ধুভাবাপন্ন সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও এবং বারবার সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধের আশ্বাস সত্ত্বেও বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী খুনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। উপরন্তু বিডিআরের সাবেক ডিজি এ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, রাতের বেলায় কেন বাংলাদেশীরা সীমান্তে যায়। সীমান্তে রাতে কারফিউ জারির ভারতীয় প্রস্তাবে বাংলাদেশ অনেকটা সায় দিয়ে রেখেছে। যদিও সীমান্ত এলাকায় এখনও কার্যকর হয়নি। ভারতের জৈন্তাপুরে বিরোধপূর্ণ জমি যা এতোদিন বাংলাদেশের দখলে ছিল সেটা কিছুদিন আগে ভারতীয় খাসিয়াদের দখলে চলে গেছে। অতিসম্প্রতি ’৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি লঙ্ঘন করে সীমান্তে জিরো লাইনের ১৫০ গজের বাইরে স্থাপনা নির্মাণের পরিবর্তে মাত্র ৫০ গজের মধ্যে ভারতকে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment