Friday 10 December 2010

নগরীতে পেশাদার খুনি বাড়ছে : ১০ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যায় পিস্তল



নাছির উদ্দিন শোয়েব

যাত্রাবাড়ী তিন খুনের আসামি সন্ত্রাসী হীরা গেয়েন্দা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে ভাড়ায় মানুষ খুন করা তার পেশা। হীরা বলেছে, ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মিল্টন, তার বৃদ্ধ মা সফিয়া খাতুন এবং পুত্রবধূ বীথি রহমানকে খুন করতে তাকে ভাড়া করা হয়েছিল। ১০ হাজার টাকা পেয়েছিল অগ্রিম। হত্যার পর বাকি ৪০ হাজার টাকা পাওয়ার আগেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পুলিশের তালিকায় নগরীতে ৫০৬ পেশাদার খুনি রয়েছে। এরা ভাড়ায় মানুষ খুন করে। গত বছর ডিএমপির সন্ত্রাসী তালিকায় ৪১ থানা এলাকায় পেশাদার খুনিদের একটি তালিকা তৈরি করে মহানগর পুলিশ। বিভিন্ন থানায় তাদের তালিকা টানানো আছে। কিন্তু গত এক বছরেও তালিকাভুক্ত পেশাদার খুনিরা গ্রেফতার হয়নি। তারা এখনও বিভিন্ন এলাকায় ঘাপটি মেরে আছে। মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সময়-সুযোগমতো চুক্তিবদ্ধ হয়ে টাকার বিনিময়ে খুন করছে। এসব খুনির পেছনে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের মদত থাকতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত কয়েকজন পেশাদার খুনির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ১০ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যায় পিস্তল। একটি অস্ত্র একবার ভাড়া নিয়ে একটি অপারেশন চালানো যায়। অপারেশন শেষে মালিককে ফেরত দেয়া হয় অস্ত্রটি। কিলিং মিশন শেষ হলে খুনিরা কিছুদিন গা-ঢাকা দেয়। পালিয়ে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ঢাকায় এসে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে। সম্প্রতি নগরীতে কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনায়
গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হয় কয়েকজন পেশাদার খুনি। জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারে পুলিশ কর্মকর্তারা। গ্রেফতারকৃত কয়েকজন খুনি হত্যাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।
ডিএমপির অপরাধী তালিকা অনুযায়ী নগরীর ৪১ থানা এলাকায় আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে ৫০৬ জন পেশাদার খুনি। এসব খুনির সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে থেকে সহযোগীদের দিয়ে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আগ্নেয়াস্ত্রের ভাণ্ডারও রয়েছে সহযোগীদের কাছে। তারা পলাতক থেকে বড় বড় ব্যবসায়ী, গার্মেন্ট মালিক, শিল্পপতি, পরিবহন ব্যবসায়ীসহ নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে চাঁদা দাবি করে। দাবি করা চাঁদা না পাওয়া, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে বাধা হওয়ায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এছাড়াও পূর্ব শত্রুতার জের অথবা প্রতিশোধ নিতে টাকার বিনিময়ে যে কেউ পেশাদার খুনিদের ভাড়া করে। কারাগারে আটক থেকেও কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে সূত্র জানায়। টাকা পেলেই তারা ঠাণ্ডা মাথায় কোনো ব্যক্তিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। চুক্তি হওয়ার পর নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার জন্য পেশাদার খুনিদের পাঠায়।
সম্প্রতি রাজধানীতে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, বড় বড় হত্যাকাণ্ড পেশাদার খুনিদের দিয়ে ঘটানো হচ্ছে। পেশাদার খুনিরা গুলশানে বাসায় ঢুকে এক দম্পতিকে, স্বর্ণ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, খিলগাঁওয়ে প্রকৌশলী, মহাখালীতে কর্মচারী নেতা সিদ্দিক, বংশালে পুলিশের এস আই হত্যা এবং এর আগে কারওয়ানবাজারে দিনেদুপুর গুলি করে তিন ব্যবসায়ী বাড্ডায় শিল্পপতি দেলোয়ার হোসেনের শ্বশুর মোবারক আলী, মিরপুরে একটি মার্কেটে গুলি করে এক ব্যবসায়ী হত্যা ও সাতজনকে আহত করার ঘটনায় পেশাদার খুনিরাই জড়িত বলে পুলিশ জানিয়েছে।
কারওয়ানবাজারে তিন ব্যবসায়ী খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ছয় সন্ত্রাসী ডিবির কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ ১০ হাজার টাকা, কেউ ২৫ হাজার, কেউ কারওয়ানবাজারের মার্কেট থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলার সুযোগ পাবে—গডফাদারের সঙ্গে এসব বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েই তারা ৩০ জনের একটি গ্রুপ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, নগরীতে দিন দিন পেশাদার খুনির সংখ্যা বাড়ছে। এর আগে মিরপুরে প্রিন্স গ্রুপের মালিক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী শহিদুল্লাহ, ব্যবসায়ী আফতাব আহমেদ হত্যাকাণ্ডের পেছনে পেশাদার খুনিরা জড়িত। পেশাদার খুনিরা হত্যার উদ্দেশ্যে ছদ্মবেশও ধারণ করে। বাড্ডার দক্ষিণ আনন্দনগরে বাসায় ঢুকে ব্যবসায়ী অপুকে হত্যার আগে খুনিরা ভিক্ষুক সেজে তাকে অনুসরণ করেছিল বলে জানা যায়। সূত্রমতে, মিরপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় পেশাদার খুনিদের তত্পরতা বেশি। মিরপুরে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের নির্দেশে। ব্যবসায়ী আফতাব আহমেদ হত্যা মামলায় সম্প্রতি তাকে অব্যাহতি দেয়ার খবরে তার সহযোগীরা গাঝাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে বড় ধরনের অপরাধ করেও পার পাওয়া যায় এটি তার উদাহরণ।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, পেশাদার খুনিদের সংখ্যা সব সময় ঠিক থাকে না। তবে নগরীতে কত সংখ্যক অপরাধী রয়েছে তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ৫০৬ পেশাদার খুনির তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। তালিকার বাইরেও হয়তো অনেক খুনি রয়েছে। আবার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের মধ্যেও বিভিন্ন সময় কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে

No comments:

Post a Comment